‘আর ফিরে আসেননি জহির রায়হান’

জহির রায়হান। ছবি: সংগৃহীত

ক্যামেরার কবি জহির রায়হান। ক্যামেরায় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের ছবি তুলে ধরেছেন তিনি। আজও তার পরিচালিত সিনেমার আবেদন একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে।

জহির রায়হান একজন কালজয়ী লেখকও। হাজার বছর ধরে, শেষ বিকেলের মেয়ে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী আজও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন পাঠকের কাছে। তার লেখা ছোট গল্পও বাংলা সাহিত্যে বড় জায়গা করে নিয়েছে।

জহির রায়হানের আরেকটি পরিচয় তিনি একজন ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলনে তার অবদান অনেক।

তবে, সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি একজন দেশ সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক। আজ ৩০ জানুয়ারি তার প্রয়াণ দিবস। জহির রায়হানের প্রয়াণ দিবসে তাকে নিয়ে কথা বলেছেন সুচন্দা, শবনম এবং ববিতা।

সুচন্দা: আর ফিরে আসেননি জহির রায়হান

সবাই জহির রায়হানকে ভুলে গেছে। সাহিত্য ও সিনেমায় তার অনেক অবদান। অথচ সেই মানুষটিকে স্মরণ করে অল্প কিছু মানুষ। জহির রায়হান ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার মানুষ। তার প্রতিভার কথা বলে শেষ করা যাবে না।

ভাষা আন্দোলনে ছিল তার অনেক অবদান। এদেশের মাটি ও মানুষকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। তার লেখায়, তার সিনেমায় উঠে আসত এদেশের মাটি ও মানুষের কথা।

সাহিত্য বলি আর চলচ্চিত্র বলি, সবখানে জহির রায়হানের ছিল সমান ভালোবাসা। তাকে এত দ্রুত হারাব কখনো ভাবিনি। সেই  যে জহির গেলেন  আজকের দিনে, আর ফিরে এলেন না। জহির রায়হান আর ফিরে আসেনি।

দুঃখ হয় জন্মদিন বা প্রয়াণ দিবসে জহির রায়হানকে কেউ সেভাবে স্মরণ করেন না। কিন্তু, তার মত মানুষকে কি ভোলা সহজ? আমি বলব জহির রায়হান ছিল সোনার মানুষ। এমন সোনার মানুষ যারা, তাদের আমরা যেন না ভুলি। জহির রায়হানকে যেন না ভুলি।

যাদের কারণে দেশ পেয়েছি, স্বাধীনতা পেয়েছি, জহির রায়হান তাদের একজন। অথচ তাকে কমই স্মরণ করা হয়। আমরা তো জাতি হিসেবে অকৃতজ্ঞ না, তাহলে তাকে মনে রাখব না কেন?

তার পরিচালনায় প্রথম অভিনয় করি বেহুলা সিনেমায়। ওটা ছিল আমার অভিনীত  দ্বিতীয় সিনেমা। বেহুলা করতে গিয়েই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় এবং প্রথম আলাপ। তারপর তো কত স্মৃতি, সেসব ভোলা  যায় না।

জহির রায়হান ছিলেন পুরোপুরি শিল্প ও সাহিত্যের মানুষ। সৃষ্টির নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল। লেখালেখি ও পরিচালনা ছাড়াও সিনেমা প্রযোজনাও করতেন।

তার প্রয়াণ দিবসে একটাই অনুরোধ, তাকে যেন শ্রদ্বাভরে স্মরণ করি। তাকে যেন সম্মান করি।

শবনম: কাজই ছিল তার সবকিছু

জহির রায়হান কাজ ছাড়া কিছু বুঝতেন না। কাজই ছিল তার সবকিছু। শুটিংয়ে অন্য এক মানুষ ছিলেন তিনি। ক্যামেরায় ভাষায় কথা বলতেন। ক্যামেরার কবি ছিলেন তিনি। এ দেশের মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা তুলে আনতেন ক্যামেরায়। যা কিনা সিনেমায় দর্শকরা  দেখতেন।

মেধাবী তো ছিলেন অবশ্যই। একটু বেশিই মেধাবী ছিলেন। সৃষ্টির নেশায় থাকতেন সর্বদা। কিছু কালজয়ী কাজ তিনি করে গেছেন। সেসব কাজ ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। আজও তার কাজ নিয়ে কথা হয়। আরও বহুদিন তার কাজ নিয়ে কথা হবে।

বাংলাদেশের সিনেমাকে তিনি অনেক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। আরও অনেক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতেন বেঁচে থাকলে ।

প্রয়াণ দিবসে তার প্রতি শ্রদ্ধা।

ববিতা: জহির রায়হান আমাকে সিনেমায় এনেছিলেন

জহির রায়হান আমাকে  সিনেমায় এনেছিলেন। তার মতো গুণী মানুষের হাত ধরে আমি চলচ্চিত্র জগতে এসেছিলাম। কী যে বড় মনের মানুষ ছিলেন! অনেক গুণ ছিল তার! তার গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

সত্যজিৎ রায়  অশনি সংকেত করার সময় আমাকে বলেছিলেন, তোমার দুলাভাই  এত বড় পরিচালক! তার জীবন থেকে নেয়া অসাধারণ একটি সিনেমা।

সত্যদার ওই কথাটি এখনো কানে বাজে।

জহির রায়হান সব সময় বলতেন, লেট দেয়ার বি লাইট আমার শেষ ছবি।

এই সিনেমার কোনো স্ক্রিপ্ট তিনি হাতে লিখেননি। সব তার মাথায় ছিল। এই সিনেমার ক্যামেরার কাজ তার ছিল। স্ক্রিপ্ট তার ছিল। পরিচালক ছিলেন তিনি। লাইটও তিনি দেখাশোনা করেছিলেন।

কিন্ত, কাজটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। এটা আমার বড় একটা দুঃখ। বলতে পারি-আমার প্রচণ্ড দুঃখ। কাজটি শেষ হলে বিশাল একটি কাজ হতো।

পরে অবশ্য খান আতাসহ কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্ত,  স্ক্রিপ্ট নেই বলে তা পারেননি।

সত্যি কথা বলতে জহির রায়হানের মত গুণী মানুষ দেখি না।

জহির রায়হানকে দেখতাম, যখন ওনার মাথায় কোনো চিন্তা আসত, সঙ্গে সঙ্গে সুচন্দা আপাকে বলতেন, এক কাপ চা দাও তো।

চা খেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসতেন। তারপর লেখা শেষ করে বের হতেন। এমনই ছিলেন তিনি। সৃষ্টির নেশায় থাকতেন সব সময়।

টাকা আনা পাই সিনেমা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সেটা জহির ভাইয়ের জন্যই হয়েছিল। সেসব কথা খুব মনে পড়ে।

আমার প্রথম সিনেমা সংসার। তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। জহির রায়হান পরিচালক ছিলেন। আমি তো সিনেমা করব না। জহির রায়হান ধরলেন, না করেও উপায় নেই। সংসার সিনেমায় রাজ্জাক আমার বাবা হয়েছিলেন।

জহির রায়হান বলেছিলেন, সিনেমাটি করো। এই সিনেমায় আমার নাম ছিল সুবর্ণা। তখনো ববিতা হইনি আমি।

১৯৬৯ সালে তার পরিচালনায় আমার অভিনীত সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়। মুক্তির দিন আমার মা মারা যান। এটাও একটা বড় দুঃখ।ৎ

এখন ভাবি, আমার যতটুকু অর্জন, সেই অর্জন আরও হতো যদি জহির রায়হান বেঁচে থাকতেন। এই দুঃখ থেকে যাবে।

Comments

The Daily Star  | English
AI-manipulated image of Shahbagh engineering students’ protest, DMP claims

Debunking DMP claim, frame by frame

The Daily Star photographer, who was present at the scene, described the incident as it unfolded

5h ago