দিনশেষে সুযোগ হাতছাড়া করার আফসোসটাই বড়
![Mushfiqur Rahim Mushfiqur Rahim](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/_f758028.jpg?itok=dcH8zPYZ×tamp=1612349263)
বাংলাদেশ চার স্পিনার নিয়ে নামায় মনে হচ্ছিল, উইকেট থাকছে সেই আগেরবারের মতোই। প্রথম দিন থেকেই মিলবে টার্ন আর অসমান বাউন্স। কিন্তু খেলা শুরু হতেই বদলে গেল সে ধারণা। শুষ্ক আর সমান বাউন্সের উইকেট ব্যাটসম্যানদের জন্য ছিল বেশ উপযুক্ত। প্রথমে ব্যাটিং পাওয়া হয়েছে তাই সোনায় সোহাগা। কিন্তু তা কতটা কাজে লাগাতে পারল বাংলাদেশ? বেশিরভাগ আউটেই যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের খাটনির চেয়ে বড় হয়ে গেল স্বাগতিক ব্যাটসম্যানদের ভুল!
বুধবার চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিন শেষে ৫ উইকেটে ২৪২ রান করেছে বাংলাদেশ। আরও অন্তত ২ উইকেট কম হারালে বলা যেত দিনটা স্পষ্টই মুমিনুল হকদের। তবে দিনের শেষ সেশনটাই হয়েছে ভালো। প্রথম দুই সেশনে রান তোলার মন্থর গতির সঙ্গে ২টি করে উইকেট পড়েছিল। শেষ সেশনে ১ উইকেট হারিয়ে রান বাংলাদেশের রান ওঠে ১০২।
৩৯ রান নিয়ে অপরাজিত আছেন সাকিব আল হাসান। ২ রানে জীবন পেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলা লিটন দাস ব্যাট করছেন ৩৪ রান নিয়ে।
পাঁচ আউটের তিনটিতেই থাকবে আক্ষেপ। বাকি দুটিতে সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুজনের দায়। টস জিতে ব্যাটিংয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ওপেনারদের থিতু হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান পেসাররাই। প্রথম তিন-চার ওভার শ্যানন গ্যাব্রিয়েল আর কেমার রোচকে দেখে গেছে বেশ আলগা।
ব্যাটের সামনে পেয়ে প্রথম বলেই চার মেরে শুরু করেছিলেন সাদমান ইসলাম। পুরো দিনে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে আস্থার নাম ছিলেন তিনিই। অথচ কী নিদারুণ আক্ষেপেই না বিদায় তার! সেই গল্প পরে।
তার আগে তামিম ইকবালের কথা বলা যাক। ওভার দ্য উইকেট বল করে তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না রোচ। লেন্থে বেশ ঝামেলা হচ্ছিল। রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে অ্যাঙ্গেল তৈরি করলেন। পঞ্চম ওভার সেখান থেকেই সাফল্য। তার ভেতরে ঢোকা বলটা বেশ ভালো ছিল। কিন্তু ব্যাট-প্যাডের মধ্যে বেশ বড় ফাঁক রেখে দিয়েছিলেন তামিম। প্যাডে সামান্য লেগে ভেঙে যায় তার স্টাম্প।
৯ রানে করে টেস্টে বাংলাদেশের সফলতম ব্যাটসম্যানের বিদায়ের হাহাকার বড় হতে দিচ্ছিলেন না সাদমান আর নাজমুল হোসেন শান্ত। সাবলীল ব্যাট করে জুটি গড়ছিলেন তারা। দিনের প্রথম আক্ষেপের শুরু এই জুটির পতনেই।
ফাইন লেগে ঠেলে সহজ এক রান নিয়েছিলেন সাদমান। হুট করে কী মনে করে দুই রানের জন্য ছুটলেন। শান্ত প্রস্তুত ছিলেন না। সঙ্গীকে ফিরিয়ে দেওয়ারও সময় পেলেন না। সাদমানকে এতখানি এগিয়ে আসতে দেখে ২৫ রান করা শান্ত উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে নিজেকে কোরবানি দিলেন। উইন্ডিজ বোলাররা যখন বিপদ আনতে পারছিলেন না, তখন যেন তাদের উপহারই দেয় বাংলাদেশ। এতে ভাঙে ১১২ বলে ৪৩ রানের জুটি। যা অনায়াসে তিন অঙ্কের উপরে যেতে পারত।
লাঞ্চের আগে নেমে অধিনায়ক মুমিনুল হক গ্যাব্রিয়েলের গতি আর বাউন্সে বেশ ভুগতে থাকলেন। আউট হই হই করে কোনোরকমে টিকে গেলেন। লাঞ্চের আগের এক ঘণ্টায় রান এলো শম্ভুক গতিতে (মাত্র ২৬)। লাঞ্চ থেকে ফিরেও প্রথম ঘণ্টায় অতি সতর্ক বাংলাদেশ। উইকেটে সময় কাটিয়ে বোলারদের অস্থির করে তোলার এই অ্যাপ্রোচই ছিল কার্যকর। ১৫ ওভারে বাংলাদেশ যোগ করল আরও ৩৩ রান।
দ্রুত রান না আসাই হয়ত চাপ তৈরি করল মুমিনুলের মাথায়। অকারণে অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। রাহকিম কর্নওয়ালকে উড়িয়ে মারতে গেলেন। ফাঁকায় পড়ল বলে রক্ষা। ওয়ারিকানকেও এভাবে খেলতে গিয়ে বাঁচলেন অল্পের জন্য।
কিন্তু হুঁশ ফেরেনি তার। ওয়ারিকানকে সেই উড়িয়ে মারতে গিয়েই হয়েছে বিপদ। শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে অধিনায়ক ফেরেন ৯৭ বলে ২৬ রান করে।
চা-বিরতির আগে আর কোনো বিপদ হওয়ার অবস্থা ছিল না। উইন্ডিজ বোলারদের কেউই খুব একটা আতঙ্ক হয়ে দেখা দেননি। কর্নওয়াল নবম ওভারে বল করতে এসে টানা হাত ঘুরিয়েছেন, নিজের সহজাত স্কিলে শার্প টার্ন আদায় করেছেন। কিন্তু উইকেটে খুব বেশি সহায়তা না থাকায় তাকে সামলানো যাচ্ছিল।
১৪ মাস পর টেস্ট খেলতে নেমে ১২৮ বলে ফিফটি করে সাদমান দিচ্ছিলেন বড় কিছুর আভাস। শান্তকে নিজের ভুলে রান আউট করানোর দায়ও হয়তো ছিল তার মাথায়।
চা-বিরতির আগে আগে কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলেন তিনিও। গ্যাব্রিয়েলের অনেক বাইরের বল তাড়া করে লাগাতে পারলেন না। অতৃপ্তি ধরা দিল। মনে হচ্ছিল, তিনি বিলাসী শট খেলতে যাবেন। ওয়ারিকানকে সুইপ করতে গিয়েই ভুলটা হয়ে গেল। জোরালো আবেদনে সাড়া আম্পায়ারের। ৫৯ রানে আউট মেনে দ্বিধাগ্রস্ত সাদমান ভারী পায়ে এগোচ্ছিলেন। অপরপ্রান্তে থাকা মুশফিকুর রহিমের দিকে তাকিয়েছিলেন পরামর্শের জন্য। মুশফিক রিভিউ নেওয়ার সায় দেননি।
অথচ রিপ্লে দেখে সাদমানের আক্ষেপ হয়েছে কেবল চওড়া। ওয়ারিকানের লেগ স্টাম্পের উপর পিচড করা বল যে পরে বেরিয়ে গেল লেগ স্টাম্প অনেকখানি ছাড়িয়ে! রিভিউ নিলেই বেঁচে যেতেন। নতুন নিয়মে, প্রতি ইনিংসে মিলছে তিনটা রিভিউ। কেন একজন থিতু ব্যাটসম্যানের বেলায় তা ব্যবহার করা গেল না, এই প্রশ্ন তখন সবচেয়ে প্রবল।
অভিজ্ঞ মুশফিক নিজেও ওয়ারিকানের শিকার। থিতু হয়েছিলেন অনায়াসে। তার মতন ব্যাটসম্যান থিতু হলে বড় ইনিংস খেলবেন এমনই প্রত্যাশা। বাঁহাতি ওয়ারিকানের স্পিনও খুব অনুমিত। ডানহাতির বেলায় সব বলই টার্ন করে বেরিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ ক্রিজে থেকে তা না বোঝার কারণ নেই। এই ধরনের বলের সঙ্গে অতিরিক্ত বাউন্স থাকলে তা কেবল ভয়ের। ওয়ারিকানের তাও ছিল না। কিন্তু মুশফিক বেরিয়ে যাওয়া এক বলেই ব্যাট লাগিয়ে ক্যাচ দিলেন স্লিপে। নিচু সে ক্যাচ জমাতে কোনো ভুল করেননি কর্নয়ওয়াল। ৬৯ বলে ৩৮ করে বিদায় টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাটিং ভরসার।
লিটন আউট হতেন ২ রানেই। কর্নওয়াল ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ রেখে ফাঁদ তৈরি করেছিলেন। সেখানে সহজ ক্যাচ দিয়েও এনক্রুমা বোনারের সৌজন্যে বেঁচে যান তিনি।
এরপরই লিটন খেলেন দৃষ্টিনন্দন সব শট। ব্যাকফুট ড্রাইভ, কাভার ড্রাইভে নিজের ট্রেডমার্ক স্টাইলের ছাপ রেখে রান এগিয়ে নেন দ্রুত। প্রথম দুই সেশনের ওভার প্রতি দুইয়ের আশেপাশে রান আনা বাংলাদেশ তার কারণে শেষ সেশনে ওভারপ্রতি রান তুলল তিনের ওপরে। ৩৪ রানের ইনিংসে তিনি মারেন ৬ বাউন্ডারি।
উইকেটের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, এই উইকেটে সাড়ে তিনশর নিচে কোনো স্কোর করলে সেটা হতে পারে বিপদের কারণ। দ্বিতীয় দিনের সকালের সেশনটা তাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান তা কাটিয়ে দিতে পারলে বড় রানের সঙ্গে ম্যাচেও নিরাপদ অবস্থায় চলে যাবে বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
(প্রথম দিন শেষে)
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ৯০ ওভারে ২৪২/৫ (সাদমান ৫৯, তামিম ৯, শান্ত ২৫, মুমিনুল ২৬, মুশফিক ৩৮, সাকিব ব্যাটিং ৩৯*, লিটন ব্যাটিং ৩৪*; রোচ ১/৪৪, গ্যাব্রিয়েল ০/৫১, কর্নওয়াল ০/৫৬, মেয়ার্স ০/১৬, ওয়ারিকান ৩/৫৮, ব্র্যাথওয়েট ০/১৩)।
Comments