সব দেখেছি, শুনেছি: আমরা কী করব?

‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ দেখার পর অনেক পাঠকের মনেই ভেসে উঠেছে ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’-এর পেছনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গল্প।
ছবি: সংগৃহীত

‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ দেখার পর অনেক পাঠকের মনেই ভেসে উঠেছে ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’-এর পেছনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গল্প।

পার্থক্য বলতে ‘প্রেসিডেন্ট’ এর জায়গায় ‘প্রাইম মিনিস্টার’, ১৯৭২ এর জায়গায় ২০২১ সাল এবং যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় বাংলাদেশ। আর এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি কাতারভিত্তিক নিউজ চ্যানেল আল জাজিরার, আমেরিকার দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের নয়।

দুটি গল্পেই অভিযুক্ত চরিত্রটি একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব, যিনি সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন এবং আইনের বাইরে গিয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়েছেন বা সমর্থন দিচ্ছেন।

তাড়াহুড়া করে এবং সম্পূর্ণ প্রমাণ ছাড়া এই দুটি অনুসন্ধানের মধ্যে তুলনা করা অনুচিত। তারপরও, আমরা যদি দুটি প্রতিবেদনের তুলনা করি তাহলে দেখতে পাব, ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’ পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ সমৃদ্ধ এবং ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ প্রমাণগুলোকে সেনসেনালাইজ করার দিকে বেশি ঝুঁকেছে।

১৯৭২ সালে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের বিখ্যাত প্রতিবেদন ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’ করেছিলেন কিংবদন্তি সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইন। প্রতিবেদনটি কার্যকরভাবে প্রমাণ করেছিল যে কুখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জড়িত ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হোয়াইট হাউস ছাড়তে হয়েছিল। এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি কয়েক বছর ধরে আমেরিকা ও বিশ্ব মিডিয়াগুলোর প্রধান শিরোনাম হয়ে ছিল। এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি সিনেমাও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই প্রতিবেদন আজ অবধি বিশ্বজুড়ে তরুণ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

বিপরীতে, ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ যা প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পেরেছে সেটা যেন কিছুটা সাদামাটা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এটা নিয়ে আলোচনা করলেও বাংলাদেশের মিডিয়া ‘শুনব না, দেখব না, বলব না’ নীতি গ্রহণ করেছে। সরকার দৃশ্যত কোনো সেন্সরশিপ চাপিয়ে না দিলেও বাংলাদেশি মিডিয়া সম্ভবত উগান্ডার প্রয়াত স্বৈরশাসক ইদি আমিনের কথায় প্রভাবিত হয়েছে। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘বাকস্বাধীনতা আছে, তবে বলার পর স্বাধীনতা থাকবে কিনা সে নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছি না।’

কাজেই যে প্রতিবেদনটি আমরা প্রকাশ করিনি তার গুণমান যাচাই করার যেকোনো প্রচেষ্টাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তারপরও মোরালি ডিসকুয়ালিফাইড বলে নিন্দিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই একটু গুণমান বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের লোকেদের গ্যাং রাষ্ট্রীয় চুক্তির জন্য উৎকোচ নিচ্ছে’। প্রতিবেদনে এটা প্রমাণ করতে পারেনি যে এই গ্যাং প্রধানমন্ত্রীর লোক এবং তারা ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমেই সুযোগগুলো নিচ্ছে’।

কাজেই প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘অল দ্য চিফ’স ব্রাদার্স’ বা ‘দ্য মাফিয়া ব্রাদার্স’ দিলে প্রদর্শিত তথ্যের সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ হতো। এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের প্রতিবেদনে তথ্যকে, দাবি ও কিছু অভিযোগে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। এটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হিসেবে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারত, যদি বাংলাদেশেরর প্রধানমন্ত্রীর কথিত আশীর্বাদের বিপরীতে কোনো প্রমাণ দেখানো যেত।

অতিরঞ্জনের বিষয়টি বাদ দিলে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুই বছর ধরে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে দৌড়ে, তদন্ত করে এবং হাইটেক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে আল জাজিরা করে দেখিয়েছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কি ভীষণ শক্তিশালী।

সরকার তার প্রতিক্রিয়ায় বলছে, জামায়াতে ইসলামী চরমপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত কুখ্যাত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে, এটি তারই একটি অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এমন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরে সরকারের আরও অনুসন্ধান হতে পারে। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য।

চাঞ্চল্যকর এমন বিষয় প্রকাশের পর আর দশটি বিষয়ের মতো একেও সেভাবে অস্বীকার করা হলে, জাতিকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হতে পারে। এবং শেষ পর্যন্ত এর মাধ্যমে সরকারের ভালো হওয়ার চেয়ে আরও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তথ্যকে গ্ৰহণ ও অতিরঞ্জনকে বর্জন। এভাবেই সরকার একটা দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

এখন দেখা যাক ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ এ কী তথ্য দেখানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে ইসরায়েলের নাম গোপন করে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল টেলিফোনে আড়িপাতার যন্ত্র কেনার জন্য এক পলাতক ভাই সহযোগিতা করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ, ইসরায়েলকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয়নি এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের দেশটিতে ভ্রমণ আইনত নিষিদ্ধ। ওই পলাতক ভাই সামরিক বাহিনীতে তার ভাইয়ের অফিসের প্রভাব ব্যবহার করে ছদ্ম নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভুয়া পাসপোর্ট নিয়েছিলেন।

যদি দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে এর সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সরকারের দায়িত্ব। কেবলমাত্র আল জাজিরার প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলা যথেষ্ট নয়।

দুজন পলাতক এবং একজন রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাওয়া ভাই ঢাকায় এসে পুলিশের নাকের ডগায় বড় ভাইয়ের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল। পলাতক এই দুজন এখনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি। তারপরও কোন কারণে তারা পুলিশের কাছে এমন অদৃশ্য হয়ে রইল সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার।

পলাতক দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই দাবি করেছে, শীর্ষ আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ক্ষমতাসীন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার আশীর্বাদে তারা অর্থ পাচার করছেন। কিছুদিন আগে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানের দিক থেকে দ্বিতীয় হয়েছিল। আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন এই প্রতিবেদনটিতে উত্থাপন করা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে পারে।

বাংলাদেশে আল জাজিরার প্রতিবেদনটি দেখতে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি না করায় সরকারের প্রশংসা অবশ্যই করতে হবে। প্রযুক্তির এই যুগে এ জাতীয় ব্যবস্থাগুলো আর কোনো কাজে আসে না।

সরকার সব দেখেছে এবং সব শুনেছে। তারা কি আদৌ কিছু করবে? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

 

আরও পড়ুন: আল-জাজিরার প্রতিবেদনটি মিথ্যা, মানহানিকর ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত: বাংলাদেশ সরকার

আলজাজিরায় প্রচারিত ‘All the Prime Minister’s Men’ শীর্ষক সংবাদের প্রতিবাদলিপি

আল জাজিরার প্রতিবেদন ও কয়েকটি কথা

আল জাজিরার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago