চার স্পিনার, এক পেসার নিয়ে ‘আদর্শ’ টেস্ট সংস্কৃতি!
ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজ। ১৮ জনের বড় স্কোয়াড। সেখানে পেসার পাঁচজন। আশাবাদী হওয়ারই রসদ। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের একাদশে দেখা গেছে সেই পুরনো চিত্র। পেসার হিসেবে আছেন কেবল মোস্তাফিজুর রহমান। চট্টগ্রামে বুধবার থেকে শুরু হওয়া ম্যাচে আবু জায়েদ রাহী, ইবাদত হোসেন, তাসকিন আহমেদ ও হাসান মাহমুদের ভূমিকা তাই দর্শকের।
কিন্তু নিজেদের মাটিতে ক্রিকেটের সবচেয়ে কুলীন সংস্করণে বাংলাদেশ যেটাকে জয়ের ‘আদর্শ’ উপায় মেনে নিয়েছে, সেই সংস্কৃতি কি সত্যিই ‘আদর্শ’? এই পরিস্থিতি থেকে কোনো কি ইতিবাচক বার্তা পাওয়ার উপায় আছে পেসারদের? যদি স্পিনারদের প্রাধান্য দিয়েই একাদশ সাজানো হবে, তাহলে এত পেসার ডেকে একজন বাদে বাকিদের বসিয়ে রাখার অর্থই কী?
এমন একাদশ অবশ্য অনুমিতই ছিল। কন্ডিশন ও উইকেট অনুসারে ঘরের মাটিতে নিজেদের শক্তির জায়গাকে প্রাধান্য দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সব দলই এই পথে হেঁটে থাকে। তাই একাদশে জায়গা পেয়েছেন স্কোয়াডে থাকা সাকিব আল হাসান, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম ও নাঈম হাসানের অর্থাৎ চার স্পিনারের সবাই।
বাংলাদেশের কোচ রাসেল ডমিঙ্গো আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এমন কিছুর, ‘আমাদের হাতে বেশ কিছু দারুণ তরুণ পেসার আছে। তাসকিন বেশ ভালো গতিতে বোলিং করছে। হাসান খুবই এক্সাইটিং। ইবাদত, রাহী খুবই ভালো করেছে। খালেদও (আহমেদ) আছে। কিন্তু চট্টগ্রামের পিচ... আমরা গত দুই দিনে যতটা দেখেছি, তাতে পেসারদের হুমকিস্বরূপ মনে হয়নি। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে পিচ এরকম।’
‘আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা আমাদের শক্তির জায়গা অনুযায়ী খেলব। আমরা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পেসার বের করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যেটা আমরা ওয়ানডেতে করে দেখিয়েছি। আমরা চাচ্ছি, পেসারদের একটা সুনির্দিষ্ট দল তৈরি করতে। কারণ, দেশের বাইরে তারা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যদি আপনি পেসারদের সাহায্য করে না এমন উইকেটে পেসারদের নিয়ে আক্রমণ সাজান, সেটি বোকার মতো কাজ হবে। আর অভিষিক্ত কোনো পেসারের জন্য এমন পিচে খেলা কঠিন ব্যাপার।’
দেখাই যাচ্ছে, কোচের বক্তব্যের পূর্ণ প্রতিফলন মিলেছে চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের একাদশে। সিরিজ জয়ই যেহেতু মুখ্য বিষয়, সেহেতু উইন্ডিজকে ফাঁদে ফেলতে টিম ম্যানেজমেন্টের স্পিন-নির্ভর এই পরিকল্পনা যথার্থ। অতীতেও তাতে ব্যাপক সুফল মিলেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আগের সফরে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হেরেছিল ক্যারিবিয়ানরা। সেবার তাদের ৪০ উইকেট ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন সাকিব, মিরাজ, তাইজুল আর নাঈম। প্রথম টেস্টে একমাত্র পেসার হিসেবে খেলেছিলেন মোস্তাফিজ। দুই ইনিংস মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে তিনি করতে পেরেছিলেন- দুই ও দুই অর্থাৎ চার ওভার। দ্বিতীয় টেস্টে তাকে ছাড়াই সাজানো হয়েছিল একাদশ।
এবারও হয়তো একই নাটকের নতুন করে মঞ্চায়ন হবে। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের শুষ্ক উইকেটে টপাটপ উইকেট তুলে নেবেন স্পিনাররা। পরের টেস্টে মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামেও হয়তো ঘটবে একই ঘটনা। সিরিজ জিতে আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকায় বাংলাদেশের উন্নতির হাতছানিও জোরালো। তবে সফলতা পাওয়ার উদ্দেশ্যের এই ছক নিয়ে কিছু প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকেই যায়। কারণ, তা স্বল্পমেয়াদী, নির্দিষ্ট স্থানের উপর নির্ভরশীল। স্থায়িত্বের বালাই নেই এতে!
সাম্প্রতিক সময়ে টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম পছন্দের পেসার রাহী। তার সঙ্গী হিসেবে ইবাদত। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সবশেষ টেস্টে তারা দুজনই ছিলেন একাদশে। ওই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৭১ রানে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন রাহী। যা তার টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার। ইবাদত দুই ইনিংস মিলিয়ে ২২ ওভারে মাত্র ৪২ রান দিলেও ছিলেন উইকেটশূন্য। দুজনের কারোরই জায়গা হয়নি চট্টগ্রাম টেস্টে।
মজার ব্যাপার হলো, ক্যারিয়ারের নয় টেস্টের সাতটিই রাহী খেলেছেন দেশের বাইরে। সেখানে ৩২.১৫ গড়ে তার শিকার ১৯ উইকেট। আর ঘরের মাঠে দুই ম্যাচে ৩৩.৬০ গড়ে তিনি পেয়েছেন ৫ উইকেট। ছয় টেস্টে মোটে ৬ উইকেট দখল করা ইবাদতের ক্যারিয়ার গড় (৮৯.৩৩) একেবারে হতশ্রী হলেও তিনিও রাহীর মতো দেশের মাটিতে উপেক্ষিত। কেবল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই টেস্টেই তার জায়গা হয়।
এই দুজনকে বাদ দিয়ে তবে মোস্তাফিজকে বেছে নেওয়া হলো কেন? অবশ্যই, তিনি দক্ষতায় ও কার্যকারিতায় এগিয়ে। টিম ম্যানেজমেন্টের ভাবনাচিন্তাতেও নিশ্চয়ই এসব বিষয় অগ্রাধিকার পেয়েছে। কিন্তু বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজ নেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) লাল বলের চুক্তিতে। অন্যদিকে, দুই ডানহাতি পেসার রাহী ও ইবাদতকে রাখাই হয়েছে কেবল লাল বলের চুক্তিতে।
টেস্টের আগে উইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে দুর্দান্ত ছন্দে দেখা যায় মোস্তাফিজকে। ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপরীতে ইন স্যুইং করিয়ে নতুন করে নজর কাড়েন তিনি। সঙ্গে তার বলের গতিও ছিল বেশ। মাত্রই ভাণ্ডারে নতুন অস্ত্র যোগ করা এই পেসার তাই নির্বাচকদের বিবেচনার ক্ষেত্রে যোজন যোজন ব্যবধানে বাকিদের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু ক্যারিয়ারের নিত্যসঙ্গী চোট সমস্যার শুরুটাও মোস্তাফিজের হয়েছিল টেস্ট খেলতে গিয়েই। হঠাৎ করেই তিন সংস্করণেই ফের টানা খেলিয়ে তাকে ফিটনেস ঘাটতির মুখে ফেলে দেওয়ার শঙ্কা তাই থাকছেই।
তবে এখানেও আছে ফাঁক। মোস্তাফিজ চট্টগ্রামে নান্দনিক পারফরম্যান্স দেখিয়ে উইকেট শিকার করবেন, এমনটা ভাবছে না বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। বরং তার কাজ হবে স্পিনার সতীর্থদের কাজটা সহজ করে দেওয়া। কদিন আগে ডমিঙ্গোর বলা কথাগুলোতেই যা স্পষ্ট, ‘সে অভিজ্ঞ, সে একজন বাঁহাতি, যা একটু ভিন্ন (বাকি পেসারদের থেকে)। সে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে (পিচের) অফ সাইডে ফাটল তৈরি করতে পারবে, যা আমাদের অফ স্পিনারদের সাহায্য করবে।’
বাকি দুই পেসারের দিকেও নজর দেওয়া যাক। ২০১৭ সালের পর তাসকিন আর কোনো টেস্ট খেলতে পারেননি জাতীয় দলের জার্সিতে। মূলত, ফর্মহীনতা আর চোটের কারণে। আর তরুণ হাসানের এখনও অভিষেক হয়নি। এখন পর্যন্ত খেলা দুই ওয়ানডেতে দুর্দান্ত বোলিং করে অবশ্য নিজের প্রতিভার জানান দিয়েছেন তিনি। তবে একদশের নিয়মিত মুখ ও টেস্টে অন্তত ২০ উইকেট নেওয়া বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে শীর্ষ গড়ধারী রাহী (৩২.৪৫) যেখানে বেঞ্চ গরম করছেন, সেখানে তাসকিন-হাসানের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখাটা বাড়াবাড়ি রকমের স্বপ্নই মনে হয়!
এই টেস্ট শুরুর আগে ডমিঙ্গো আরও বলেছিলেন, ‘আমরা নির্বাচকদের সঙ্গে আলোচনা করব পেস ও স্পিন মিলিয়ে একটি আদর্শ বোলিং লাইনআপের ব্যাপারে।’ সেই আলাপের ফল কী দাঁড়িয়েছে, তা চোখের সামনেই পরিষ্কার। স্পিনকেই উইন্ডিজকে ঘায়েলের মূল চাবিকাঠি ধরে এগোনো হয়েছে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে সাফল্য পাওয়ায় এই একমুখী পথের নেই কার্যকারিতা।
দেশের বাইরে শেষ পাঁচ টেস্টের কথা ধরা যাক- পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি এবং ভারত ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি করে। পাঁচ ইনিংসে বাংলাদেশের আদায় করা ৩৭ (!) উইকেটের ২৭টিই গেছে পেসারদের ঝুলিতে। খুব আহামরি হয়তো নয়। কিন্তু দেশে উপযুক্ত উইকেট না পাওয়ার কমতি তো আর সফরে পাঁচ-দশ দিনের অনুশীলনে পুষিয়ে দেওয়া যায় না!
বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে বহুদিন ধরে বহু কথা হচ্ছে। বিশেষ করে, টেস্টে ‘আদর্শ’ সংস্কৃতি যে গড়ে ওঠেনি, তা চোখে আঙুল দিয়ে বলে না দিলেও চলে। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে কেবলই বেরিয়ে আসে এই সংস্করণে পেসারদের হতাশা জাগানোর গল্প। কিন্তু তাদেরকে আসলে কতটুকু সুযোগ দেওয়া হচ্ছে নিজেদেরকে প্রমাণের? এ ব্যাপারে বোর্ডের সদিচ্ছা কতখানি? থাকলেও তার নমুনা কোথায়? এক ম্যাচে কিংবা এক সিরিজে খেলিয়ে ফের বসিয়ে আবার খেলানো, আবার বাদ দেওয়া- এই চক্র কী পেসারদের জন্য যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আর এই দুষ্টচক্রের ফাঁদে আর যা-ই হোক, পেস বোলাররা যে কোনো আশার আলো দেখবেন না, তা নির্দ্বিধায়ই বলা যায়।
Comments