কবিতা, সাংবাদিকতায় ঋদ্ধ ফজল শাহাবুদ্দীন
কবিতা শিল্পের এমনি এক মাধ্যম যা গতানুগতিকভাবে বিচার করা যায় না। অসংজ্ঞায়িত ও অমীমাংসিত শিল্পের কঠিন এই মাধ্যম নিয়ে যিনি কাজ করেন তিনি কবি। কাব্য মনীষী মেকলে বলেছেন, কবিতা হচ্ছে সেই রচনা যেখানে শব্দ এমনভাবে ব্যবহৃত হয়, যা পাঠকের কল্পলোকে ঐ শব্দ একটি চিত্রিত সৌন্দর্যের বিশ্ব উন্মুক্ত করে দিতে পারে। শিল্পী রঙ দিয়ে যে কাজ করেন, কবি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে তাই করে থাকেন।
আমি মনে করি— কবিতা কবিতাই, এর সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘কবিতা এক অমীমাংসিত শিল্প।’
এ অমীমাংসিত শিল্প আধুনিক বাংলাসাহিত্যে ধরা দেয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। পরবর্তীতে ১৯৩০ এর দশকে ‘পঞ্চ পাণ্ডব’দের আর্বিভাব দেখা যায় বাংলা সাহিত্যে। কবি বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষু দে, অমিয় চক্রবর্তী ও জীবনানন্দ দাশকে ‘পঞ্চ পাণ্ডব’ বলা হয়। তারা রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র ভাবধারায় বাংলা সাহিত্যের গায়ে নতুন চাদর জড়িয়েছিলেন। তবে, আমার কাছে কবিতা মানেই দ্রোহের আগুনে পোড়া ভস্ম। সেই দ্রোহের চিত্র পুরোপুরি উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন নজরুল।
ফজল শাহাবুদ্দীন ১৯৩৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার নবীনগরে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শুরুতে কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন তিনি। তার ধ্যান-জ্ঞান ভাবনা ও বিচরণ ছিল কবিতার সংসারে। মন-মননের সব শক্তি সমর্পণ করে কাব্য রচনা করে গেছেন তিনি। সাংবাদিকতা করেও পত্রপত্রিকায় নিজের কবিতার উপস্থিতি রেখেছিলেন। কবি ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি সমানভাবেই পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রচলনে তিনি অন্যতম পথিকৃতের ভূমিকা রেখেছিলেন।
পঞ্চাশের দশকের ফজল শাহাবুদ্দীন দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন কবিতার সঙ্গে। যাপন করেছিলেন সাহিত্য-সাংবাদিকতার এক বিরল জীবন। তিনি কবিতার পরতে পরতে যুক্ত করেছেন এমন এক আধ্যাত্মিক চেতনা যা বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেই সঙ্গে তার রচিত দীর্ঘ কবিতার অধিকাংশ প্রকৃতি ও প্রেমের আন্দোলনের দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়েছে।
সার্বিক ভাবনায় বলা যায় বাংলা কবিতাকে ঋদ্ধ করেছেন বহুমুখী প্রতিভার এই প্রাণপুরুষ। তার অন্যতম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘অনাকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর’, ‘আততায়ী সূর্যাস্ত’, ‘অন্তরীক্ষে অনন্য’, ‘আলোহীন অন্ধকারহীন’, ‘আমার নির্বাচিত কবিতা’, ‘আর্তনাদ’, ‘সনেটগুচ্ছ’ ও ‘পৃথিবী আমার পৃথিবী’। তার শেষ বই ‘একজন কবি একাকী’ও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
খ.
স্বাধীকারবোধ, প্রেম ও বিপ্লবের জীবন ছিল কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের। তিনি শুধুমাত্র কবিতার জন্য সুপরিচিত এমন নয়— খ্যাতি পাওয়ার ঢের পরিসর তার আঙিনায় রয়েছে। ফলে তাকে দেখে বিস্ময় অনুভব করেছি প্রথমেই। সময়টা ২০১৩ বা ২০১৪ সাল হবে। আভিজাত্য ছিল তার কথায়, চলায়। ব্যক্তিজীবনের রসবোধে সতত মন সজীব, সমাজ-কালের প্রেক্ষিতে নিজেকে আপডেটেড রাখায় তিনি ছিলেন অগ্রগামী। চেতনে-অবচেতনে মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ছিল।
একজন কবি যেকোনো দেশে জন্মাতে পারেন। কিন্তু, তার থাকতে হয় আর্ন্তজাতিক মনন ও উদার দৃষ্টি। জানতে ও বুঝতে হয় চারপাশ, থাকতে হয় মানুষ পড়ার অসামান্য ক্ষমতা। এটি ফজল শাহাবুদ্দীনের মধ্যে শতভাগ ছিল। তার ছিল শিল্পের সব শাখা সম্পর্কে সম্যকজ্ঞান। বই পড়ার সঙ্গে ছিল মানুষ পড়ার চোখ। তাই কবির ভাষায় এসেছে— ‘পৃথিবীর সব দুঃখ মিশে আছে মেঘনার কালো জলে’। কবি পাখির চোখে নীরবে দেখতে পারেন আকাশ। সাবলীলভাবে বলতে পারেন স্বপ্নকথা। উচ্চারণ করতে পারেন— ‘জীবনের জীবনকে উপলব্ধি করতে পেরেছি, জীবনহীনতার জীবনকে উপলব্ধি করতে পরিনি।’
সাহস-সংগ্রাম-প্রেম ও জীবনের গল্প না থাকলে কবি হওয়া যায় না। ফজল শাহাবুদ্দীনের জীবনের শুরু থেকেই ছিল অকল্পনীয় গল্প। বিখ্যাত কবি লোরকা মারা যান যে বছর সে বছর ফজল শাহাবুদ্দীনের জন্ম। তিনি সাত মাসে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন এক পাউন্ড ওজন নিয়ে। এমন শিশু জন্মালেও বাঁচানো অসম্ভব ছিল। তিনি বেঁচে গেছেন। বলা যায় প্রায় অসম্ভব।
তার জীবন কেটেছে ঢাকায়। হই-হুল্লোরের মধ্যেই প্রথম বই ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে’ প্রকাশিত হয়। কবির বয়স তখন ছিল ১৭ বছর। সে বয়সেই দুঃসাহসিক রচনা। কবির ২১ বছরের রচনা ‘অরণ্য রাত্রি’ প্রকাশিত হলে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। কবি শামসুর রাহমানের আবেদনে জামিনে মু্ক্তি পেয়েছিলেন তিনি।
১৯৫২ সালে ফজল শাহাবুদ্দীন ছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। ভাষা আন্দোলন তার তারুণ্যকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রথম শহীদ মিনার যখন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। কলেজের বন্ধু আনোয়ারুল করীমের সঙ্গে ভাষা আন্দোলন নিয়ে পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন।
১৯৭১ সালে কবিতা ‘কোথাও যেতে পারিনি’ লিখেছিলেন। বাহাত্তর সালে অন্নদাশঙ্কর রায় কবিতাটি দিয়ে একটা সংকলনের শুরু করেছিলেন। পাঠকপ্রিয় কবিতাটির উৎসর্গে ছিল- একাত্তরের বাংলাদেশ।
তার রচিত জনপ্রিয় গান ব্যবহৃত হয় ‘সূর্যকন্যা’ চলচ্চিত্রে। তার লেখা ‘আমি যে আঁধারে বন্দিনী’ গানটি গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তার লেখা ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ গানটি গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। এ গানগুলো আজও কোটি মানুষের মুখে মুখে রয়ে গেছে।
কেবল লিখেই ক্ষান্ত হননি তিনি। তার সাংগঠনিক হাত ছিল অসামান্য। তার একান্ত প্রচেষ্টায় ঢাকায় আয়োজন করা হয়েছিল বসন্তকালীন কবিতা উৎসব। আন্তর্জাতিকমানের উৎসবটিতে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বের বেশ কটি দেশের প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক।
গ.
ফজল শাহাবুদ্দীনের ছিল চারপাশ দেখার জীবনবোধ ও ব্যক্ত-অব্যক্ত হাহাকার। পৃথিবীর বহু খ্যাতিমান কবি, শিল্প-সাহিত্যের মানুষের সঙ্গে সখ্যতায় সমৃদ্ধ করেছিলেন নিজেকে। আবিস্কার করেছিলেন নিজেকে। জনমানুষকে জানিয়েছিলেন কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, আড্ডায় ও গানে।
এ প্রসঙ্গে তার বন্ধু কবি আল মাহমুদ এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও ফজল শাহাবুদ্দীন, এই ত্রয়ীর চুম্বকে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। ফজল শাহাবুদ্দীন সবসময় বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। সেই সঙ্গে প্রায় ছয় দশক তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কবিতার চর্চা করে গেছেন। বাংলা কবিতার আধুনিক ধারায় তিনি অন্যতম প্রধান। ফজল শাহাবুদ্দীন ছিলেন সত্তর দশকের সাড়া জাগানো সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র প্রাণপুরুষ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন তিনি শামসুর রাহমানের সঙ্গে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন দেশের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য পত্রিকা ‘কবিকণ্ঠ’।’
বাংলা ভাষায় তার সমকালীন বন্ধুদের চেয়েও অগ্রগামী ছিলেন ফজল শাহাবুদ্দীন। আধুনিক ভাবনায় সাধারণ কিন্তু কবিতায়-ভাবে অসাধরণ জীবন উদযাপন করেছিলেন তিনি। নিমার্ণ করেছিলেন নিজস্ব কাব্যশৈলী। গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ভাবনার আকাশ। আপদমস্তক বাংলাদেশের মা-মাটি-মানুষে সাজিয়েছিলেন কবিতা সংসার।
আপাতত শেষ করবো একটি সাক্ষাৎকারের একটি প্রশ্ন ও উত্তর দিয়ে। যদি মৃত্যুর আগে আপনাকে কিছু বলে যেতে বলা হয়, তাহলে আপনি কী বলবেন? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি আমরা কেউ মরি না। আমিও মরব না— আমি অন্তহীনতার ভেতর বেঁচে থাকব চিরকাল অনন্তকাল।’
এই ভয়াবহ করোনা মহামারির সময়ে কবি জামসেদ ওয়াজেদ প্রকাশ করেছেন ‘জলছবি’ সাহিত্য পত্রিকা। মাঘ ১৪২৭ / জানুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় কবি ফজল শাহাবুদ্দীনকে নিয়ে রয়েছে ৪০০ পাতার বিশেষ আয়োজন। এতে আরও রয়েছে কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আল মাহমু্দ, আবিদ আজাদ, আবু বকর সিদ্দিকী, আসাদ চৌধুরী, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, হাবিবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখের লেখা। এটি কবির অনুরাগীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করি।
ইমরান মাহফুজ: কবি, গবেষক
Comments