মিরাজের দারুণ সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের বড় সংগ্রহ
বল খুব একটা টার্ন করছে না, আচমকা লাফ দিয়ে উঠছে না। কিংবা কোন বল অস্বাভাবিক নিচুও হয়নি। এমন উইকেটে প্রথম ইনিংসে অন্তত সাড়ে তিনশো রান তো ভীষণ দরকার। শঙ্কা থাকলেও সাড়ে তিনশো তো বটেই বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেল চারশো রানও। সেই পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। আটে নেমে দারুণ এক সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনের চা বিরতির ঠিক আগে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ থেমেছে ৪৩০ রানে। অথচ মিরাজ অমন ব্যাটিং না করলে তারা থেমে যেতে পারত সাড়ে তিনশোর বেশ আগে। দলকে বড় পুঁজি পাইয়ে দিয়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি ফিরেছেন ১০৩ রানে। ১৬৮ বলের ইনিংসে ১৩টি বাউন্ডারি এসেছে তার ব্যাট থেকে।
টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের অনেকেই দৃষ্টিকটু ভুলে বিদায় নিয়েছিলেন। উইকেটে তেমন কিছু না থাকলেও তাদের এমন খামখেয়ালিপনা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। মিরাজ তাদের ভুলকে যেন আরও চড়াও করলেন নিজের ব্যাটের মুন্সিয়ানায়।
প্রতিপক্ষের ব্যাটিং শক্তি, দিন গড়াতের উইকেটের আভাস মিলিয়ে মনে হচ্ছে এই টেস্টে বেশ ভালো অবস্থায় চলে গেছে বাংলাদেশ।
তা নিয়ে যাওয়ার বড় কৃতিত্ব মিরাজের। প্রত্যাশা ছাপিয়ে ক্যারিয়ার সেরা ব্যাটিং করেছেন তিনি। আগের ৬৮ রান ছাপিয়ে তুলে নিয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এটি তার প্রথম তিন অঙ্কের দেখা।
দ্বিতীয় দিন একদম তৃতীয় ওভারে আসতে হয়েছিল মিরাজকে। জোমেল ওয়ারিকনের বলে কাট করতে গিয়ে পরাস্ত হয়ে বোল্ড হন ৩৮ রান করা লিটন দাস। শ্যানন গ্যাব্রিয়েল এসব ক্ষেত্রে লোয়ার অর্ডারে দাপিয়ে বেড়ান। মিরাজ গ্যব্রিয়েলকে প্রথমেই সামলালেন দারুণভাবে। নিজের ধরনের বিপরতে গিয়ে সতর্ক ব্যাট করা সাকিব আল হাসানের সঙ্গে পেয়ে যান জুতসই জুটি। সেঞ্চুরির আভাস দেওয়া সাকিব পুরো ইনিংসের বিপরিত ধর্মী শটে আউট না হলে জুটি হতো অনেক লম্বা।
কিন্তু এই ৬৮ রানের ইনিংসেই বাংলাদেশ শক্ত পূজি পাওয়ার পথে চলে যায়। দলের ৩১৫ রানে সাকিব ফেরার পর তাইজুলকে এক পাশে রেখে দলকে টেনেছেন মিরাজ। নিজের প্রায় ভুলতে বসা ব্যাটিং সামর্থ্যের দিয়েছেন সর্বোচ্চ প্রমাণ। এই সেঞ্চুরিতে তেমন কোন সুযোগও দেননি তিনি। ৮৫ রানে তার ক্যাচ ফেলেছিলেন রাহকিম কর্নওয়াল।
প্রস্তুতি ম্যাচে বিসিবি একাদশের আনকোরা স্পিনারদের খেলতেই বেশ সমস্যা হয়েছে উইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের। দেশের সেরা স্পিনার নিয়ে নামা বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে সফরকারীদের জন্য তাই বেশ বড় এক পরীক্ষা।
বাজে শটে আউট হওয়া, তালগোল পাকিয়ে ভুল করে ফেলা এইগুলা খেলারই অংশ। কিন্তু এক ইনিংসে সেই সংখ্যা যদি হয় একাধিক তাহলে তা আক্ষেপেরও বড় কারণ। মিরাজের ইনিংস দেখে তাদের সেই আক্ষেপ নিশ্চিতভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশের আউটগুলো একটু বিশ্লেষণ করলেই তা ধরা পড়ে। অধিনায়ক মুমিনুল হক হাঁসফাঁস করে উইকেট ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। বোলারের এখানে তেমন কোন কৃতিত্ব নেই। আগের দিন দারুণ খেলে তরুণ সাদমান ইসলাম দেখিয়েছিলেন টেম্পারমেন্ট। বেশ সাবলীল খেলে ফিফটি পেরুনো এই ওপেনারের প্রথম সেঞ্চুরিটা মনে হচ্ছিল পাওনা।
তিনি তো কাটা পড়লেন সাংঘাতিক এক ভুলে। আউটের বর্ণনা পুনরাবৃত্তি না করে ঘটনার কথাই ফের বলা যাক। রিভিউ নিলেই যে বাঁচতেন সাদমান। সুযোগ হাতছাড়ার হাহাকার তাকেই বিদ্ধ করার কথা বেশি। তার আগে নাজমুল হোসেন শান্তর রান আউট নিয়ে কি বলা যায়? সাদমানেরই ভুল ডাকে নিজেকে সেক্রিফাইস করেছিলেন তখন ঝলমলে খেলে ২৫ রানে থাকা শান্ত।
তামিম ইকবাল কেমার রোচ প্রিয় শিকার হয়েছিলেন ম্যাচের একদম শুরুতেই। মুশফিকুর রহিম জোমেল ওয়ারিকনকে ক্যাচ দেন স্লিপে। এই আউটগুলতেও ব্যাটসম্যানদের ভুল শটের দায় দেওয়া যায়। কিন্তু বেশিরভাগই আউটেই তো ব্যাটসম্যানদের কোন না কোন ঘাটতি থাকেই। আক্ষেপের তালিকায় না হয় তারা নাইবা থাকলেন।
সাকিব আল হাসানকে কিন্তু আক্ষেপের তালিকায় রাখতেই হবে। সবার জানা যেকোনো পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে খেলেই রান করেন সাকিব। টেস্টে খুব কমই তাকে ধৈর্যের পরিচয় দিতে দেখা গেছে। এই টেস্টে দেখা গেল। প্রথম থেকেই থাকলেন সতর্ক। তাড়াহুড়োর কোন লক্ষণ দেখা গেল না তার মাঝে। প্রথম দিনে ৩৯ রানের মধ্যে চার বাউন্ডারি মেরেছিলেন।
দ্বিতীয় দিনে নেমে সাকিব যেন আরও সতর্ক। ফিফটি পেরুতে বাউন্ডারি মারলেন আর কেবল একটি। দেড় বছর পর টেস্টে ফিরে সেঞ্চুরির দিকেই এগুচ্ছিলেন তিনি। এদিন মাত্র এক বাউন্ডারি তুলেন আরও ২৯ রান। কিন্তু রাহকিম কর্নওয়ালের বলে যেভাবে আউট হলে তা তার পুরো ইনিংসের সঙ্গে বেশ বেমানান। এক বল আগেই কর্নওয়ালের সামান্য লাফানো বলে কাট করে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়েছিলেন। ফিল্ডারের সামান্য আগে পড়ায় বেঁচে যান। এরপর পয়েন্ট ফিল্ডারকে সামান্য এগিয়ে আনেন উইন্ডিজ অধিনায়ক। পরের বলে সেখানেই একই শট খেলে ক্যাচ দিয়ে দেন তিনি।
দারুণ সম্ভাব্য এক সেঞ্চুরির ‘অপমৃত্যু’ ছাড়া এ আর কি! শেষ পর্যন্ত তা দলের আক্ষেপের কারণ হলো না বলেই রক্ষা। হতে তো দিলেন না মিরাজ। সাকিব ফিরে যাওয়ার পরও অষ্টম উইকেটে তাইজুল ইসলামকে নিয়ে ৪৪, নবম উইকেটে নাঈম হাসানকে নিয়ে ৫৭ আর শেষ উইকেটে মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে আরও ১৪ রান যোগ করেন তিনি।
ভাগ্যের কিছু সহায়তা ছিল বটে। নাঈম তিনবার জীবন পেয়েছেন। মিরাজেও ৮৫ রানে পেয়েছেন জীবন। তবু টেল এন্ডারদের নিয়ে লড়ে দলকে একটা স্বস্তির জায়গায় ঠিকই নিয়ে গেছেন তিনি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
(দ্বিতীয় দিনের চা বিরতি পর্যন্ত)
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ১৫০.২ ওভারে ৪৩০ (সাদমান ৫৯, তামিম ৯, শান্ত ২৫, মুমিনুল ২৬, মুশফিক ৩৮, সাকিব ৬৮, লিটন ৩৮, মিরাজ ১০৩, তাইজুল ১৮, নাঈম ২৪, মোস্তাফিজ ৩*; রোচ ১/৬০, গ্যাব্রিয়েল ০/৬৯, কর্নওয়াল ২/১১৪, মেয়ার্স ০/১৬, ওয়ারিকান ৪/১৩৩, ব্র্যাথওয়েট ০/১৩, বোনার ১/১৬)।
Comments