অতিমানবীয় মায়ার্স, রোমাঞ্চকর রান তাড়ায় রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশকে হারাল উইন্ডিজ
![Kyle Mayers Kyle Mayers](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/_f751116_0.jpg?itok=KAYCUyQ8×tamp=1612694313)
অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় বা চোখ ধাঁধানো। এমন সব শব্দেও আসলে পূর্ণতা দেওয়া যাবে না কাইল মায়ার্সকে। পঞ্চম দিনের উইকেট, নিজের অভিষেক ম্যাচ। ৩৯৫ রান তাড়ায় চতুর্থ ইনিংসে যে ব্যাটিং করেছেন তিনি, বাংলাদেশের বোলারদের সমালোচনায় তাকে আড়াল করা যেন ক্রিকেটেই ছোট করা!
চোয়ালবদ্ধ দৃঢ়তায় বড় ভূমিকা আছে এনক্রুমা বোনারেরও। পরে মায়ার্সকে সঙ্গ দিয়েছেন জশুয়া ডা সিলভা। সাকিব আল হাসানকে ছাড়া বাংলাদেশের বাকি বোলিং আক্রমণ ছিল ধারহীন। উইকেট থেকেও মেলেনি আহামরি সহায়তা। কিন্তু পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বিচারে অসাধারণ মনোবল ও নজরকাড়া স্কিলের প্রয়োগে সব ছাপিয়ে মায়ার্সের ইনিংসের কোনো স্তুতিই যেন যথেষ্ট নয়। তার নৈপুণ্যে উপমহাদেশের মাঠে রান তাড়ার রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশকে হারিয়েছে উইন্ডিজ।
রোববার চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম সাক্ষী হয়ে থাকল একটি ক্লাসিক টেস্ট ম্যাচের। বাংলাদেশের জন্য তা অবশ্য চরম হতাশার। রূপকথা লিখে ৩৯৫ রান তাড়া করে যে ৩ উইকেটের ব্যবধানে জিতে গেছে উইন্ডিজ। সকল ভবিষ্যদ্বাণী ভুল করে খর্বশক্তির দল নিয়ে সিরিজেও এগিয়ে গেছে ১-০ ব্যবধানে।
দলকে জিতিয়ে অভিষেকেই ২১০ রানে অপরাজিত ছিলেন মায়ার্স। ২০ চারের সঙ্গে মেরেছেন ৭ ছক্কা। অভিষেকে ইতিহাসে ষষ্ঠ ডাবল সেঞ্চুরির ঘটনা এটি। তবে চতুর্থ ইনিংসে কোনো অভিষিক্ত ব্যাটসম্যানের এটাই সেরা ইনিংস। দলকে জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বোনার করেন ২৪৫ বলে ৮৬ রান।
এমন ম্যাচ জিতলে হবে একগাদা রেকর্ড। হয়েছেও তাই। টেস্ট ইতিহাসে এটি পঞ্চম সর্বোচ্চ রান তাড়ার ঘটনা। সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ডটিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ২০০৩ সালে ৪১৮ রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল তারা। তবে উপমহাদেশের মাঠে এটিই সর্বোচ্চ রান তাড়ার নজির। এর আগে ২০১৭ সালে জিম্বাবুয়ের দেওয়া ৩৯১ রান তাড়া করে কলম্বোয় জিতেছিল শ্রীলঙ্কা।
![mominul mominul](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/mominul_4.jpg?itok=Sd5zyDAm×tamp=1612698383)
শেষ দিনে উইন্ডিজের হাতে ছিল ৭ উইকেট। জিততে হলে করতে হতো আরও ২৮৫। ড্র করতে হলে টিকতে হতো তিন সেশন। নামকরা ব্যাটসম্যান বলতে ছিলেন জার্মেইন ব্ল্যাকউড। কিন্তু দুই সেশন পর ব্যাটিং পেয়ে তিনি করতে পারেন কেবল ৯ রান।
যাদের গায়ে আলো পড়েনি, সেই মায়ার্স আর বোনারই তোলেন আলোড়ন। চতুর্থ উইকেটে অবিশ্বাস্য জুটি উপহার দেন তারা। দুজনেই অভিষিক্ত। ইতিহাস দেখল দুই অভিষিক্তের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড।
উইকেট অতি টার্নিং ছিল না। সেটা প্রথম দিনের পরই বোঝা গেছে। এমন উইকেট থেকে ফল বের করতে হলে জায়গায় বল করে যেতে হবে টানা। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের বোলাররা সেটা করতে বেগ পেয়েছেন। এক পর্যায়ে উইন্ডিজ ৬ রানে শেষ ৫ উইকেট না হারালে বিপদ আসত আরও আগে।
বড় লিড পেয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেরা জুতসই একটা রান করে প্রতিপক্ষকে দেওয়া গিয়েছিল বিশাল লক্ষ্য। কিন্তু বোলিং থাকল প্রশ্নবিদ্ধ। মেহেদী হাসান মিরাজ চতুর্থ দিন বিকেলে একটানা বল করেছেন, ভালো জায়গায় বল ফেলার সুফল হিসেবেই তার পকেটেই গেছে ৩ উইকেট।
দ্বিতীয় দিনে তিনিও ধার রাখতে পারেননি। তাইজুল ইসলাম আর নাঈম হাসানকে দেখালো একদম সাদামাটা। কিছু বল টার্ন করিয়েছেন, সুযোগ এসেছে। কিন্তু আবার আলগা বল দিয়ে সেই চাপ তারা সরিয়েছেনও দ্রুত।
ফিল্ডারদের কাছ থেকেও যোগ্য সহায়তা মেলেনি। টেস্টের নায়ক মায়ার্স আউট হতে পারতেন ফিফটির আগেই। ৪৯ রানে মিরাজের বলে স্লিপে তার সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। তার দুই রান আগে তাইজুল ইসলামের বলে রিভিউ নিলেও তাকে ফেরানো যেত। সোজা বল পায়ে লাগলেও রিভিউ নিতে ভুল করে ফেলেন মুমিনুল হক। পরে নাঈম ইসলামের বলে অনেক টার্ন করে পায়ে লেগেছিল বোনারের। রিপ্লেতে দেখা গেছে, রিভিউ নিলে আউট হতেন তিনিও।
এরপর আর কোনো সুযোগ দেননি এই দুজন। মায়ার্স যেমন ছিলেন নান্দনিকতার ছোঁয়ায় দৃষ্টিনন্দন আর ক্যারিবিয়ান ছন্দে মোহনীয়, বোনারকে তেমন দেখা গেছে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় ভরপুর। একজনকে টলানো যাচ্ছিল না, আরেকজনকে থামানো যাচ্ছিল না!
তাদের থামাতে গৎবাঁধা উপায়ের বাইরে গিয়ে আলাদা কিছু করেননি মুমিনুলও। সাকিব দ্বিতীয় দিনে ছিটকে যাওয়ার পর তৃতীয় দিনে প্রথম দুই সেশনে মাঠে ছিলেন না তামিম ইকবালও। আরেক সিনিয়র মুশফিকুর রহিমকে শেষ সেশনের আগে ফিল্ডিংয়ে নিজের মতো থাকতে দেখা গেছে।
শেষ সেশনে তামিম মাঠে ফেরেন, মুশফিকও মুমিনুলকে পরামর্শ দিতে এগিয়ে যান বার কয়েক। সেটা আরও আগে তারা কেন করলেন না, সেই প্রশ্নও বড় হতে পারে।
তৃতীয় সেশনের শুরুতেই অবশ্য ম্যাচে ফেরার আভাস তৈরি করেছিল বাংলাদেশ। রান তাড়ার রোমাঞ্চ নিয়ে নামা বোনার প্রথম ওভারেই ছক্কায় তাইজুলকে উড়িয়েছিলেন। পরের বলেই হয়ে যান পরিষ্কার এলবিডব্লিউ।
যিনি উইন্ডিজের জন্য কাজটা করে দিতে পারতেন অনেক সহজ, সেই ব্ল্যাকউড টিকতে পারেননি। ছক্কা মেরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অ্যাপ্রোচ। কিন্তু অতি আগ্রাসী হওয়াই কাল হয়েছে তার। নাঈমের বলে তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে মারতে গিয়ে লাইন মিস করে হন বোল্ড।
![mayers mayers](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/mayers.jpg?itok=Y3YqNAYu×tamp=1612696543)
দ্রুত ২ উইকেট নিয়ে খেলায় ফিরেছিল বাংলাদেশ। উইন্ডিজের টেল এন্ডার লম্বা না থাকায় বাড়ছিল আশা। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেটে জশুয়াও মায়ার্সের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যান। এই দুজন যোগ করেন আরও ১০০ রান। তাতে উইকেটরক্ষক জশুয়ার অবদান মাত্র ২০। বাকি রান একাই বাড়ান মায়ার্স।
রানের চাপ বাড়তে দেখলেই বিশাল সব ছক্কায় তা অনায়াসে উড়িয়ে দেন মায়ার্স। শেষ ঘণ্টা থেকে ম্যাচ ক্রমশ হেলে পড়ে উইন্ডিজের দিকে। পরিষ্কার হয়ে যায় ফল। জশুয়ার আউটে যখন এই জুটি ভাঙে, তখন জয় থেকে কেবল ৩ রান দূরে দল। এরপর কেমার রোচও ফেরেন দ্রুত। কিন্তু ততক্ষণে খেলা হয়ে গেছে টাই।
উইন্ডিজের বাকিদের চেষ্টায় ছিল যেন জয়সূচক রান মায়ার্সই নিতে পারেন। হয়েছেও তাই। নাঈমের বল মিড অনে ঠেলে দিয়েই দুহাত উঁচিয়ে ধরেন মায়ার্স। ছুটে যান ড্রেসিংরুমের দিকে। লেখা হয়ে যায় তার অবিস্মরণীয় এক উত্থানের গল্প।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ৪৩০
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস: ২৫৯
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস: ২২৩/৮ (ইনিংস ঘোষণা)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংস: (লক্ষ্য ৩৯৫) ১২৭.৩ ওভারে ৩৯৫/৭ (আগের দিন ১১০/৩) (বোনার ৮৬, মায়ার্স ২১০*, ব্ল্যাকউড ৯, জশুয়া ২০, রোচ ০, কর্নওয়াল ০*; মোস্তাফিজ ০/৭১, তাইজুল ২/৯১, মিরাজ ৩/১১৩, নাঈম ১/১০৫)।
ফল: উইন্ডিজ ৩ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: কাইল মায়ার্স।
Comments