৪ সপ্তাহের পার্থক্যে দ্বিতীয় ডোজে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৫৩ শতাংশ, ১২ সপ্তাহে ৮৩ শতাংশ

ছবি: রাশেদ সুমন/ স্টার ফাইল ফটো

ভ্যাকসিন যে দুই ডোজ নিতে হবে, এই তথ্য আমরা জানি। প্রথম ডোজের সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজের সময়ের পার্থক্য কত হবে, এই তথ্যও অজানা নয়। তবে, সুনির্দিষ্ট করে জানার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা আছে বা কয়েক রকমের তথ্য জানি। কারণ, ভ্যাকসিন নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। জানা যাচ্ছে নানা তথ্য। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের সর্বশেষ তথ্য কী?

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের সাম্প্রতিক ডেটা বিশ্লেষণের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ডোজের সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজের সময়ের পার্থক্য ছয় সপ্তাহের কম হলে ভ্যাকসিনের কাঙ্ক্ষিত কার্যকারিতা শতকরা ৩০ শতাংশ কমে যায়। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন নেওয়ার টিকা কার্ড থেকে জানা যাচ্ছে যে, দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে চার সপ্তাহ পর। এই সংবাদটি বেশ বিচলিত হওয়ার মতো।

এটা ঠিক যে যুক্তরাজ্যের রেগুলেটর এমএইচআরএ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রেগুলেটর ইএমএ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সময় ধার্য করেছে ৪-১২ সপ্তাহের মধ্যে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশে কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ চার সপ্তাহে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়তো নির্ধারিত সময়ের ভেতরেই পড়েছে। তবে, অতিসম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (বিএমজে, ৬ জানুয়ারি ২০২১) অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ফেইজ-৩ ট্রায়ালের সাব-গ্রুপ ডেটা অ্যানালাইসিসের ফলাফল প্রকাশ করেছে। যা থেকে দেখা যায়, ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রথম ডোজের ৮-১২ সপ্তাহ পর দিলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বেড়ে যায় অনেক।

গত ডিসেম্বরের ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ফেইজ-৩ ফলাফলে দেখা যায়, ভ্যাকসিনের দুটি পূর্ণ ডোজ প্রতিরক্ষা দেয় ৬২ শতাংশ। তবে, এই কার্যকারিতা হলো বিভিন্ন সময়ে দেওয়া দুটি পূর্ণ ডোজের গড় কার্যকারিতা। ব্রিটিশ রেগুলেটরের অনুমোদন প্রক্রিয়াকালে এই ফলাফলের বিস্তারিত সাব-গ্রুপ অ্যানালাইসিস করা হয়। এতে দেখা যায় যে, প্রথম ডোজের ছয় সপ্তাহের চেয়ে কম সময় অন্তর দ্বিতীয় ডোজ দিলে কার্যকারিতা হয় মাত্র ৫৩ শতাংশ। আর দ্বিতীয় ডোজটি ছয় সপ্তাহ পরে দিলে কার্যকারিতা হয় ৬৫ শতাংশ। কিন্তু, দ্বিতীয় ডোজটি যদি দেওয়া হয় ১২ সপ্তাহে, তাহলে কার্যকারিতা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩ শতাংশে। অর্থাৎ প্রথম ডোজের চার সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দিলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা মূলত কমে যায় শতকরা ৩০ ভাগ।

অতিসম্প্রতি অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের সম্প্রসারিত রেজাল্ট পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ভ্যাকসিনটির এক ডোজের কার্যকারিতা ৭৬ শতাংশ, যা অন্তত তিন মাস পর্যন্ত বজায় থাকে। অর্থাৎ চার সপ্তাহের ব্যবধানে দুটো ডোজে যে কার্যকারিতা পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যায় ভ্যাকসিনের একটি ডোজ দিলে, যা তিন মাস পর্যন্ত বজায় থাকে।

ব্রিটিশ রেগুলেটরের প্রকাশিত ‘অনুমোদন রিপোর্ট’ থেকে দেখা যায়, প্রথম ডোজের ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দিলে শরীরে ভাইরাস-বিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয় ছয় সপ্তাহের কম সময়ে দেওয়া দ্বিতীয় ডোজের চেয়ে তিন গুণ বেশি। অর্থাৎ দুটি ডোজের মাঝে সময়ের পার্থক্য বেশি হলে ইমিউনোজেনিক রেসপন্স বেশি, যা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাকে ত্বরান্বিত করে।

এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ব্রিটিশ সরকার অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে প্রথম ডোজের ১২ সপ্তাহ বা তিন মাস পর। টিকাটির প্রথম ডোজ ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত সুরক্ষা দেবে ৭৬ শতাংশ। এরপর ১২ সপ্তাহে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হলে ভ্যাকসিনটি কোভিড থেকে প্রতিরক্ষা দেবে শতকরা ৮৩ ভাগ। আর আমাদের দেশে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনটির দ্বিতীয় ডোজ যদি দেওয়া হয় চার সপ্তাহে, এতে মূলত ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতাকেই খর্ব করা হবে, যা কাম্য নয়। ভারতেও কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই ডোজের অন্তর্বর্তী সময়ের পার্থক্য ৮-১২ সপ্তাহ রাখা হচ্ছে।

তাই টিকার মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজটি অবশ্যই প্রথম ডোজের আট সপ্তাহের আগে দেওয়া উচিত হবে না। এই ব্যাপারে আমি জাতীয় কারিগরি কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তারা যেন অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের সাম্প্রতিক ফলাফলগুলো পর্যালোচনা করে দ্বিতীয় ডোজের সময়টা পুনঃনির্ধারণ করে।

ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের সাফল্যের প্রশংসা করতেই হবে। সব জল্পনা-কল্পনা, সন্দেহ-সংশয় অতিক্রম করে বাংলাদেশ সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। অত্যন্ত উৎসাহজনক পরিবেশে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করেছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, স্বাস্থকর্মী ও বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন প্রথম দিনেই। সংশয় বা ভয় ইতোমধ্যেই অনেকটা কেটে গেছে। ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশের হাতে আছে। আরও ভ্যাকসিন ভারত থেকে আসবে।

এখন প্রথম ডোজের সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজের সময়ের পার্থক্যের জায়গাটিতে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিতে হবে, সেই তুলনায় রেজিস্ট্রেশন কম, বিষয়টি যদি এমন হয় তবে পরিবর্তন আনতে হবে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায়। সহজ করতে হবে রেজিস্ট্রেশন। তার উপায় আছে। কিন্তু, তা না করে প্রথম ডোজের সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজের সময় কমিয়ে আনা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করি।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম, যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট

[তথ্যসূত্র:

(১) BMJ 2021; 372 doi: https://doi.org/10.1136/bmj.n18

(২) https://www.ox.ac.uk/news/2021-02-02-oxford-coronavirus-vaccine-shows-sustained-protection-76-during-3-month-interval# ]

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago