রাসিক এলাকার ৩ কেন্দ্রের ২টিতেই নেই প্রবেশাধিকার

রামেক হাসপাতাল টিকাকেন্দ্রে ভিড় সামলাতে অব্যবস্থাপনা

রামেব হাসপাতাল কেন্দ্রে করোনার টিকা নিতে আসা মানুষের ভিড়। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১। ছবি: স্টার

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্রে আনন্দচিত্তে টিকা গ্রহণ ছাড়াও যে বিষয়টি ছিল চোখে পড়ার মতো সেটা হল অব্যবস্থাপনার ভোগান্তি।

স্বাস্থ্যকর্মী ও রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের দক্ষতা ও প্রাণান্ত চেষ্টার পরও টিকা নিতে আসা মানুষের বাড়তে থাকা ভিড় সামলাতে কার্যত কোনো ব্যবস্থাপনাই ছিলো না। নিরাপদ দূরত্ব তো দূরে থাক টিকা নিতে আসা মানুষকে দেখা গেছে গায়ে গা লাগিয়ে জটলা করতে।

দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো বৃদ্ধ বয়সী একজন বলেই বসলেন, ‘করোনাভাইরাসের টিকা নিতে এসে আবার করোনায় না আক্রান্ত হয়ে যাই!’

সরেজমিনে রামেক হাসপাতাল টিকাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের পরিচালনা অফিসের সামনে একটি ছোট ওয়ার্ড ও ওয়ার্ডের করিডোরে নয়টি টিকাদান বুথ স্থাপন করা হয়েছে। নয়টি বুথের দুইটি নারীদের জন্য।

প্রতিটি বুথের সামনেই শতাধিক মানুষের ভিড়। ফলে সেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাটা ছিলো অসম্ভব ব্যাপার। একজন আরেকজনের গায়ে গা লাগিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ওয়েবসাইট থেকে নামানো টিকাদান কার্ড স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে জমা করছিলেন। পরে সেই কার্ড দেখে স্বাস্থ্যকর্মীরা একে একে নাম ধরে টিকা দিচ্ছিলেন। কিন্তু এসময়ে টিকা নিতে আসা মানুষ কোথায় অবস্থান করবে তার কোনো নির্দেশনা দেওয়া ছিল না।

সরকারি ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে নির্দেশনা অনুযায়ী রামেক হাসপাতাল টিকাকেন্দ্রে গিয়ে এই প্রতিবেদক তার টিকা কার্ড যাচাই করাতে একটি লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। লাইনটি এমন অবস্থায় পৌঁছে যে একসময় সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতের পথও বন্ধ হয়ে যায়। তাদের যাতায়াতের পথ করে দিতে লাইনের একজনকে অপরজনের ওপর হেলে পড়তে হচ্ছিল। টিকা নিতে আসা বাকিরা যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন জটলা করে।

সার্বিক পরিস্থিতি কোনো টিকাকেন্দ্র নয়, বরং স্থানীয় বাজারের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে বারংবার।

টিকা কার্ড যাচাই শেষে সেটি জমা দিতে হয় টিকাদান বুথে। সেখানে কোনো লাইন ছিলো না। স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকাকার্ড অনুযায়ী নাম ডেকে টিকা দিচ্ছিলেন।

টিকা নিতে আসা সবাই বুথ ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা বারবার চিৎকার করে তাদের দূরে সরে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেও তা কোনো কাজে আসেনি। কারণ, একে অপরের থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়াবার মতো পর্যাপ্ত জায়গা সেখানে ছিলো না।

স্বাস্থ্যকর্মীরা ভিড় সামলাতে বারবার আনসার সদস্যদের সাহায্য চাইলে তারা এসে লাউডস্পিকারে সকলকে দূরে সরতে অনুরোধ করছিলেন। পরস্পর অন্তত একহাত দূরত্ব বজায় রাখতে বারবার বলা হলেও সবাই বুথের চারপাশেই জটলা করে থাকেন। কারণ, স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন নাম ধরে ডাকছিলেন, দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে তা শোনা যাচ্ছিল না।

ভিড়ের মধ্যে বয়স্ক যারা ছিলেন তাদের ভোগান্তি ছিলেন সবচেয়ে বেশি। কারণ, তারা অন্যদের চাপ সহ্য করতে পারছিলেন না। বয়স্কদের একজন বলন, ভিড়ের মধ্যে একজন তার পা মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেছে।

নারীদের জন্য নির্ধারিত বুথে ভিড় কম থাকায় অনেক পুরুষকেও সেখানে গিয়ে টিকা নিতে দেখা গেছে।

কোনো বিষয়ে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থাও সেখানে ছিলো না।

সব ধকল পেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত টিকা নিয়ে অধিকাংশ মানুষই বাড়ি ফিরেছেন হাসিমুখে। অনেকেই এই সময়টি বন্দি করে রেখেছেন তার মুঠোফোনে, শেয়ার করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

স্থানীয় দৈনিক সোনালী সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক এম. জে. কাদেরী তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘টিকাদান কেন্দ্রে কর্মীরা ভালোই পরিশ্রম করছেন। অব্যবস্থাপনার দায় কর্তৃপক্ষের। এখানেও বাজারের মতো ভিড়ে বহুল উচ্চারিত সামাজিক দূরত্ব পালনের বালাই নেই। মানুষের অসচেতনতা আর কর্তৃপক্ষের অবহেলা কোনোটাই কম নয়। শত শত মানুষের টিকা নেওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না করা গেলে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ১০ কোটি মানুষের টিকা দেওয়া নিশ্চিত হবে? স্বাস্থ্যবিধি পালনের কথা যেভাবে বলা হয় বাস্তবে তা প্রতিপালনের গুরুত্ব না থাকাটা কী বলে বোঝানো যায়! সাধারণের অসচেতনতার কথা বলার আগে এই অবহেলা দূর করা জরুরি।’

যোগাযোগ করা হলে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানি বলেন, তাদের ধারণার থেকে বেশি মানুষ টিকা নিতে আসায় যে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তারা করেছিলেন তা কাজে আসছে না।

তিনি বলেন, ‘সরকারি ওয়েবসাইটে রাজশাহীতে রামেক হাসপাতাল ছাড়াও সামরিক ও পুলিশ হাসপাতালেও টিকাদান কেন্দ্র পছন্দ করার সুযোগ ছিলো। অনেকে ওই দুটি কেন্দ্রে নিবন্ধন করলেও সেসব সংরক্ষিত হাসপাতালে প্রবেশাধিকার না পেয়ে রামেক হাসপাতালে ছুটে এসেছেন। সেজন্য বাড়তি চাপ এসে পরেছে আমাদের ওপর।’

সুরক্ষা ওয়েবসাইটে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে গেলে মোট তিনটি কেন্দ্র নির্বাচন করার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রামেক হাসপাতাল ছাড়াও রয়েছে সামরিক ও পুলিশ হাসপাতাল। অনেকেই উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং ভিড় কম হওয়ার আশায় টিকা নিতে সামরিক হাসপাতাল ও পুলিশ হাসপাতাল কেন্দ্র নির্বাচন করেন।

তবে, এসব কেন্দ্রে টিকা নিতে প্রবেশাধিকার পাননি সাধারণ মানুষ। ফলে, তাদের চাপও গিয়ে পড়েছে রামেক হাসপাতাল কেন্দ্রে।

চাপ সামলাতে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানি বলেন, চারটি বুথ স্থাপন করে টিকাদান কেন্দ্র চালু করা হলেও বুথ বৃদ্ধি করে নয়টি করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে আরও বুথ বাড়ানো হবে।

রাজশাহীর সিভিল সার্জন মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, টিকা নেওয়ার আগ্রহ বাড়ছে। ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর তিন দিনে রাজশাহীতে টিকা নিয়েছেন তিন হাজার ১৫৩ জন। কিন্তু গতকাল একদিনেই রাজশাহী জেলায় টিকা নিয়েছেন তিন হাজার ৫২ জন। তাদের মধ্যে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকারই দুই হাজার ১১৭ জন।

টিকাদান কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচন করা হলেও সামরিক ও পুলিশ হাসপাতালে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে এই দুটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টিকা নিতে আসা মানুষদের ফিরিয়ে দেওয়ার পর আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। মিলিটারি হাসপাতাল আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যে তারা বেসামরিক কেউকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেবে না। তবে, পুলিশ হাসপাতাল রাজি হয়েছে। পুলিশ হাসপাতালের আশেপাশের অধি তাদের এই কেন্দ্রে টিকা নিতে দেবে বলে জানিয়েছে হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ।’

টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে অব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি হাস্যরস করে বলেন, ‘বাজারে, বাস টার্মিনালে যারা সামাজিক দূরত্বের তোয়াক্কা করছেন না তারাই হাসপাতালে এসে সামাজিক দূরত্ব মানতেই হবে এমন কেন দাবী করছেন। সামাজিক দূরত্ব কারও একার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব না, সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।’

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এফ এ এম আঞ্জুমান আরা বেগম জানান, গত চার দিনে সামরিক হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন ১১৯ জন, পুলিশ হাসপাতালে নিয়েছেন ৪৪৮ জন এবং রামেক হাসপাতালে নিয়েছেন তিন হাজার ৪৩৮ জন।

সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য মোট ৩১ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন বরাদ্দ করা হয়েছে এবং এই পরিমাণ ভ্যাকসিন ১৫ হাজার ৫০০ জনকে দেওয়া যাবে বলেও যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Garment exporters prefer cheaper Maldives, bypassing Dhaka, Indian airports

Exporters say the traditional air shipment routes through Dhaka, Kolkata, Colombo or Singapore had either become too expensive or too slow

15m ago