বাংলাদেশের দশ আউটের পাঁচালী

mushi
ছবি: ফিরোজ আহমেদ

বোলারদের কৃতিত্ব তো বটেই, এক অর্থে ক্রিকেটের বেশিরভাগ আউটেই থাকে ব্যাটসম্যানের ভুল। কিন্তু সেই ভুলের মাত্রা কতটা তা ঠিক করে ম্যাচের পরিস্থিতি, উইকেটের অবস্থা ও কন্ডিশন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আউটগুলোকে তাই ‘শুধু ভুল’ বললে ফুটে ওঠে না পুরো ছবি। কারণ, প্রায় নির্বিষ উইকেটে আত্মাহুতি দিয়ে সুযোগ হাতছাড়া করেছেন মুশফিকুর রহিমরা।

শনিবার মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে উইন্ডিজের ৪০৯ রানের জবাবে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে ২৯৬ রানে। যাতে বড় অবদান মুশফিক, লিটন দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজের। ফের ব্যাটিংয়ে নেমে ক্যারিবিয়ানরা ৩ উইকেটে তুলেছে ৪১ রান। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে তারা এগিয়ে আছে ১৫৪ রানে।

সৌম্য সরকার 

বেচারা সৌম্য! এই টেস্ট শুরুর দিন চারেক আগেও ব্যস্ত ছিলেন সাদা বলের অনুশীলনে। টেস্ট খেলার কোনো সম্ভাবনা না থাকায় তার জন্য সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আচমকা প্রাথমিক স্কোয়াডের বাইরে থেকে তাকে ডেকে নিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় মিরপুর টেস্টে। তা-ও একদম ওপেনিংয়ে! পেসার শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের বলে তিনি যেভাবে আউট হয়েছেন, তাতে প্রকাশ পেয়েছে ওয়ানডে মেজাজের ছবি। ফ্লিকের মতো কিছু একটা করতে গেলে শর্ট মিড-উইকেটে যায় ক্যাচ।

নাজমুল হোসেন শান্ত

সামর্থ্যের কী নিদারুন অপচয়! খেলেছেন দুই বল। তাতেই দেখিয়েছেন সামর্থ্য এবং হেলায় জলাঞ্জলি দেওয়ার চিত্র। মুখোমুখি প্রথম বলেই গ্যাব্রিয়েলকে অন-ড্রাইভে চার মেরেছিলেন শান্ত। দারুণ রিফ্লেক্স। শরীরের পজিশন একদম বলের উপর রেখে নিখুঁত এবং নিরাপদ শট। ঠিক পরের বলেই প্রলুব্ধ হয়ে অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে ড্রাইভের ফাঁদে পড়েন। এবার গালিতে ক্যাচ। 

মুমিনুল হক

পাল্টা আক্রমণের মেজাজ ছিল। সঙ্গে দ্রুত রান তোলার নেশাও ছিল তার। উইন্ডিজের তাতে খুশি হওয়ার কথা। যেকোনো সময় উইকেট আসছে, পাওয়া যাচ্ছিল আঁচ। স্পিনার রাহকিম কর্নওয়ালের বলটা ছেড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু ওই ওভারে যে রান না পেয়ে ছটফট করছিলেন মুমিনুল। তার যে অনেক তাড়া! গতি আর বাড়তি লাফানো বলটা মুমিনুলের পক্ষে চালিয়ে খেলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। উইকেটের পেছনে দারুণ মুন্সিয়ানায় তা লুফেছেন জশুয়া ডা সিলভা।

তামিম ইকবাল

তামিমের বিরুদ্ধে বদনাম টি-টোয়েন্টিতে খেলেন টেস্ট আর টেস্টে নামেন টি-টোয়েন্টির মেজাজে। তাতে সফল হলে বলার কিছু থাকত না। তামিমের ৫২ বলে ৬ চার, ১ ছক্কায় ৪৪ রানের ইনিংস কার কাজে লেগেছে তিনিই বলতে পারবেন! বাংলাদেশের কোনো কাজে লাগেনি বলে দেওয়াই যায়। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে বলেছিলেন, আউটের আগে ভুল করেননি। কিন্তু তাকে বাতাসে ভাসিয়ে একাধিকবার ঝুঁকি নিতে দেখা গেছে। আলজারি জোসেফ নিশ্চয়ই জানতেন, দুই-চারটা বাউন্ডারি হলেও উইকেটটা পেতে দেরি হবে না। শর্ট মিড-উইকেট রেখে লেগ স্টাম্পের উপর বল করে গেলেন। সেখানেই ক্যাচ। ওয়ানডে অধিনায়কের এই শট ওয়ানডে ম্যাচে চলে, টেস্টে যে তা বড় বেমানান। যখন কিনা দল ৪০৯ রানের চাপ মাথায় নিয়ে খেলছে!

মোহাম্মদ মিঠুন

৭১ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর নেমেছিলেন মিঠুন। আগের চার জনের ধর-ধর, মার-মার অ্যাপ্রোচের একদম বিপরীতে গিয়ে আগের দিনের শেষ সেশনের বাকিটা উইকেটে পড়েছিলেন তিনি। দিনের খেলা শেষ হতে বাহবাও জুটেছে তার। তৃতীয় দিনে নেমে সেই বাহবার জায়গাটা আর রাখলেন কোথায়? 

শুরুটা মন্দ হয়নি। কিন্তু সময় গড়াতে তাকেও পেয়ে বসে রান বাড়ানোর তাড়না। উইকেটে জমে গিয়ে লম্বা সময় বোলারদের বিরক্তির কারণ হবেন, এমন মনস্তাত্ত্বিক দৃঢ়তা যে রপ্ত হয়নি! কর্নওয়ালের বল এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে ফেলেছিলেন। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে চার পেয়ে যান। বোঝা যাচ্ছিল, তার ভেতরের অস্থিরতা। বোলারের তা না বোঝার কথা না। আরও আগ্রাসী ফিল্ডিং সাজালেন। সিলি পয়েন্ট, ফরওয়ার্ড শর্ট লেগের সঙ্গে শর্ট মিড-উইকেটও হাজির। হাঁসফাঁস করতে থাকা মিঠুনের ক্যাচ সেই মিড-উইকেটেই। কর্নওয়ালের বল যে একটু বেশি লাফায় মনে থাকলে হয়তো ভিন্ন কিছুর চেষ্টা থাকত।

মুশফিকুর রহিম

ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মুশফিকই খেলছিলেন সবচেয়ে ভালো। কিন্তু তার ফেরাটাই সবচেয়ে কুৎসিত। মিঠুনকে নিয়ে আগের দিন ঠিকঠাক পার করে দেওয়ায় দলের মূল ভরসাও ছিলেন মুশফিক। বেশ সাবলীল ছিলেন তৃতীয় দিনের সকালের শুরুতে। নিয়ন্ত্রিত ড্রাইভ, পুলে বাউন্ডারি বের করতে অসুবিধা হচ্ছিল না। ফিফটি পেরুনোর পরই যেন কী এক তাড়া পেয়ে বসল তাকে। কর্নওয়াল বল ফেলছিলেন ভালো জায়গায়। চাপ বাড়াচ্ছিলেন। সে তো টেস্ট ম্যাচে বোলার করবেনই।

সেই চাপ তাড়াতে মুশফিকের চেষ্টার বাস্তবায়ন দৃষ্টিকটু। একবার সুইপ করতে গিয়ে পরাস্ত হলেন। জোরালো এলবিডব্লিউর আবেদন আম্পায়ার সাড়া না দিলে রিভিউর শরণাপন্ন হয় উইন্ডিজ। ইম্প্যাক্ট সামান্য বাইরে থাকায় আম্পায়ার্স কলে সে যাত্রা রক্ষা। খানিক পরই কর্নওয়ালের লাফানো বল পুলের মতো করতে গিয়ে চরম দ্বিধায় দেখা গেল তাকে। উইকেটের পেছন দিয়ে চার পেয়ে গেলেন। কিন্তু তখন মিলছিল বিপদের গন্ধ। ঠিক পরের বলটায় এক পা বাড়িয়ে ডিফেন্স করা যেত আরামসে। মুশফিক খেলতে গেলেন রিভার্স সুইপ! শর্ট কভারে লোপ্পা ক্যাচ। কিছুক্ষণ ক্রিজে দাঁড়িয়ে ব্যাট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মাথা নিচু হয়ে করে মাঠ ছাড়তে ছাড়তে কার প্রতি রাগ ঝাড়ার অবস্থা থাকল মুশফিকের?

লিটন দাস 

দারুণ খেলছিলেন লিটনও। সপ্তম উইকেটে মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে জমে যায় তার জুটি। দ্বিতীয় সেশনে কোনো উইকেটই পড়তে দেননি তারা। এই দুজনের ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ানোর আশাও বেড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের। 

তৃতীয় সেশনে হুট করে ফুটো সব আশা। ১২৬ রানের জুটির পর বিদায় লিটনের। ক্যারিয়ারে আরও একবার তিন অঙ্কের আগেই থামেন তিনি। কর্নওয়ালের বল স্কুপের মতো খেলতে গিয়েছিলেন। বল ব্যাটে হালকা স্পর্শ করে যায় লেগ স্লিপের দিকে। প্রথম স্লিপ থেকে ছুটে সহজ সেই ক্যাচ নিতে পারেন জার্মেইন ব্ল্যাকউড। ব্যাটে লাগলেও লিটন রিভিউ নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয়নি। ৭১ রানে ফেরেন ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোরার।

টপাটপ বাকি তিন 

এক আউটেই খুলে যায় দুয়ার। নাঈম হাসান এসেই কর্নওয়ালের পঞ্চম শিকার হয়ে স্লিপে দেন ক্যাচ। আরেক পাশে থিতু থাকা মিরাজ কী করবেন যেন ভেবে পান না! গ্যাব্রিয়েলকে লফটেড খেলতে গিয়ে সহজ ক্যাচে শেষ তিনিও। লম্বা সময় দৃঢ়তা দেখানো ইনিংস থামে ৫৪ রানে। শেষ উইকেট পড়া ছিল সময়ের ব্যাপার। একাধিক সুযোগ তৈরির পর আবু জায়েদ রাহিকে ছেঁটে আনুষ্ঠানিকতা সারেন আলজারি। 

Comments

The Daily Star  | English

Beyond development paradox & unnayan without democracy

As Bangladesh seeks to recalibrate its path in the aftermath of recent upheavals, the time is ripe to revisit an oft-invoked but under-examined agenda: institutional reform. Institutions are crucial to understand, as they are foundational for governance, transformation, and economic development.

15h ago