যার নাম ভালোবাসা!

গত ১৪ বছর ধরে নুরুন্নবী আহমেদ নিশ্চিত করে আসছেন তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন যেন পায় সর্বোচ্চ সেবা, ভালোবাসা এবং চিকিত্সা। ছবি: মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা

ভালোবাসা। একদিনের নয়, প্রতিদিনের। ভালোবাসার আবার আলাদা দিন কেন! কত তর্ক, কত আলোচনা। এসব আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের ধারে কাছেও নেই তিনি। তিনি সেবা করছেন, ভালোবাসছেন। যার প্রতি তার এই ভালোবাসা, তিনি হয়তো তা অনুধাবন করতে পারেন, প্রকাশ করতে পারেন না। বলছি মুন্সী নুরুন্নবী আহমদের কথা। নিরবে-নিভৃতে বিরল এক ভালোবাসার অনুকরণীয়-অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত নুরুন্নবী আহমেদ। গল্প বা সিনেমা নয়, বাস্তব জীবনের গল্প। ভালোবাসার গল্প। সেই গল্প কেউ পড়লে, শুনলে বা জানলে অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে!

তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে কোমায়। চিকিৎসকদের মতে বিছানায় শুয়ে থাকা এই মানুষটির আর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

তবে চিকিৎসকদের এমন কথায় স্ত্রীকে সুস্থ করে তোলার লড়াই ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পাত্র নন মুন্সী নুরুন্নবী আহমেদ। গত ১৪ বছর ধরে নুরুন্নবী আহমেদ নিশ্চিত করে আসছেন তার স্ত্রী যেন পায় সর্বোচ্চ সেবা, ভালোবাসা এবং চিকিত্সা।

 

নুরুন্নবী আহমেদ পেশায় প্রকৌশলী। স্ত্রীর যত্নে কোনো ত্রুটি রাখেন না তিনি। তাকে খাওয়ানো, পোশাক পরানো, গোসল করানোসহ সবই নির্দিষ্ট সময়ে করেন তিনি। প্রায়ই স্ত্রীর ঘুম নিশ্চিত করতে গিয়ে বিসর্জন দেন নিজের ঘুম।

তার বাড়ির একটি ঘরই এখন আইসিইউ। সব সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সেই আইসিইউতেই থাকেন ফরিদা। স্ত্রীর দেখাশোনায় যাতে কোনো প্রকার ঘাটতি না হয় সে জন্য আরও দুজনসহ তিনি নিয়েছেন বিশেষ প্রশিক্ষণ। নিশ্চিত করছেন স্ত্রীর ২৪ ঘণ্টার সেবা।

স্ত্রী একদিন সুস্থ হয়ে উঠবেন, একদিন তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখবেন তার ভালোবাসার মানুষটি উঠে বসেছেন। হাঁটছেন-চলছেন সেই আগের মতো। এই আশা নিয়েই প্রতিদিন ঘুমাতে যান নুরুন্নবী আহমেদ। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘গত ১৪ বছর ধরে এটাই আমার প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা।’

প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর তাকে খাওয়ানো, নির্ধারিত ওষুধ দেওয়া, প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর ঘুরিয়ে শুইয়ে দেওয়া, এমনই কিছু কাজ প্রতিদিনের। এসব কাজে কখনোই ভুল হয় না, বিরাম পরে না।

ফরিদা ইয়াসমিনের শ্বাস-প্রশ্বাস চলে ট্র্যাকোস্টোমির মাধ্যমে। ফলে, মুখের লালা ট্র্যাকোস্টোমি পয়েন্টে আটকে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটা ভয় সব সময়ই থাকে। এজন্য সার্বক্ষণিক একজন মানুষ তার পাশে থাকতে হয়। পুরোপুরি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় যেন এমন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে যায়।

নুরুন্নবী আহমেদের এই দীর্ঘ সংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি তার অদম্য ভালোবাসা।

তিনি বলেন, ‘সে আমার সঙ্গে কথা বলে চোখের জলে। আমি যখন কিছু বলি, তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে। আমি বুঝি, সে আমাকে কিছু বলতে চাইছে।’

ঢাকায় নিজের বাসায় স্ত্রীর পাশে বসেই নুরুন্নবী আহমেদ বলেন, ‘ভালোবাসা তো আধ্যাত্মিক। মানুষ সেটাই বলে। যদি আমাদের কথা জানতে চান তাহলে বলবো, আমাদের ভালোবাসা এখন কেবলই অশ্রুতে সীমাবদ্ধ।’

‘চিকিত্সা বিজ্ঞান তাকে সুস্থ করে তুলতে পারেনি। আমি এখন সর্বশক্তিমানের কাছে দোয়া করি, সাধ্যের সবটুকু দিকে তার সেবা করার চেষ্টা করি। আশায় আছি, একদিন সে সুস্থ হয়ে উঠবে।’

১৯৮৬ সালের ১৮ এপ্রিল বিয়ে হয় এই দম্পতির। চাকরির সুবাদে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়াসহ বেশ কয়েকটি জেলায় থাকতে হয়েছে তাদের। শেষ পর্যন্ত তারা থিতু হন পাবনায়। সেখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন ফরিদা ইয়াসমিন।

২০০৭ সালে ফরিদা ইয়াসমিনের জরায়ুতে একটি টিউমার ধরা পড়ে। তিনি পাবনা থেকে ঢাকায় আসেন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে। সে সময় তার বড় মেয়ে সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন এবং ছোট মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

নুরুন্নবী আহমেদ বলেন, ‘এরপর আমরা আর পাবনায় থাকতে পারিনি।’

সেই সময়ের কথা মনে করে তিনি বলেন, ফরিদার শ্বাসকষ্ট থাকায় তাৎক্ষণিক অপারেশন করতে চাননি চিকিৎসকরা। অপারেশন যে চিকিৎসকের করার কথা ছিল তিনি ফরিদাকে পাঠিয়ে দেন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের কাছে। কিছু পরীক্ষা করার পরে বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাশি বন্ধ হলে তারপর অপারেশন করা যেতে পারে।

তারা পরামর্শ নিতে অপর একজন নামকরা সার্জনের কাছে যান। তিনি বলেন, এই অপারেশনের জন্য কাশি কোনো বড় সমস্যা না। এটা নিয়ে উদ্বেগ বা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

নুরুন্নবী আহমেদ বলেন, ‘আমরা চিকিত্সকদের সম্মান করি। তাই সেই সার্জনের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার পর ফরিদা অপারেশন করানোর সিদ্ধান্ত নেয়।’

‘অপারেশন চলাকালে আমরা অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে চিৎকার শুনতে পাই। আমি ভেতরে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাকে যেতে দেয়নি। এক পর্যায়ে আমি ভেতরে যাই। চিকিৎসক বলেন, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে আইসিইউতে নিতে হবে।’

সিপিআর দিয়ে চিকিৎসকরা তার স্ত্রীর হার্ট ফাংশন পুনরায় সক্রিয় করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরপর আর তার জ্ঞান ফিরেনি।’

বারবার অনুরোধ করার পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তর করার অনুমতি দেয়। ফরিদাকে যখন বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি করাতে চাননি। তাদের ভাষায়, এই রোগী মৃতপ্রায়।

অনেক অনুরোধের পর চিকিৎসকরা ফরিদা ইয়াসমিনকে ভর্তি করেন এবং সেখানে তাকে সাড়ে তিন মাস আইসিইউতে রাখা হয়।

সেখানেই একজন চিকিৎসক নুরুন্নবী আহমেদকে অনেক সাহায্য করেন।

সেই চিকিৎসক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না পৃথিবীতে এত বড় মনের মানুষ আর কোনোদিন দেখব কি না। তিনি আমার স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। আইসিইউ খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু তিনি সর্বনিম্ন খরচটাই রেখেছেন। ব্যক্তিগতভাবেও তিনি আমাদের সহায়তা করেছিলেন।’

‘তিনিই আমাকে পরামর্শ দেন বাড়িতে আইসিইউ তৈরি করার। বাইরের কারো প্রবেশাধিকার না থাকলেও তিনি আমাকে এমন রোগীকে চিকিত্সা দেওয়ার প্রশিক্ষণ নিতেও সাহায্য করেছিলেন।’

২০০৮ সালের মার্চ থেকে তিনি তার স্ত্রীকে নিজ বাড়িতেই বিশেষভাবে তৈরি একটি ঘরে রেখেছেন। শীতকালেও এই ঘরে ২৪ ঘণ্টা দুটি ফ্যান চলে। ঘরটিতে কয়েকটি বৈদ্যুতিক সংযোগ আছে। যাতে কোনোভাবেই এক মূহুর্তের জন্যও বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়। অক্সিজেন, সাকশন মেশিন এবং পালস মনিটরের মতো সব সরঞ্জামই আছে এই ঘরটিতে।

নুরুন্নবী আহমেদ বলেন, ‘মাত্র দুই থেকে তিন বার তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম জরুরি কিছু পরীক্ষা করানোর জন্য।’

এ জাতীয় রোগীর যেন কোনো সমস্যা না হয় সেটা নিশ্চিত করা খুবই কঠিন কাজ। সে কারণেই স্ত্রীর নিয়মিত যত্ন নিতে তিনি দুজন নার্স নিযুক্ত করেছেন। তিনি জানান, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াও রোগীর বিভিন্ন প্রয়োজন বুঝে তারা কাজ করেন।

একই সঙ্গে দুই মেয়ে নুসরাত নবী বাধন ও নওরিন নবী স্বর্ণা যেন এসব থেকে দূরে থাকতে পারেন সেটাও নিশ্চিত করেছেন তিনি। ‘আমি তাদের বিয়ে দিয়েছি দেশের বাইরে। তাদের পরিবার আছে। কাজেই তাদের মানসিক শান্তি দরকার।’

ফরিদা ইয়াসমিন যে ঘরে থাকেন সেই একই ঘরে আরেকটি বিছানা রয়েছে নুরুন্নবী আহমেদের জন্য। রাতে এখানেই ঘুমান তিনি।

নুরুন্নবী আহমেদ বলেন, ‘আমি সব সময় সর্বশক্তিমানের কাছে দোয়া করতে থাকি, ওর চোখ দিয়ে আমি অশ্রু ঝড়তে দেখি। বুঝি যে সে সবই বুঝতে পারছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। এটাকে কী বলব জানি না। আপনি এটাকে বলতে পারেন নীরব ভালোবাসা।’

গত বছর শেষে আরও একটি বড় বিপদে পড়েন নুরুন্নবী আহমেদ। তিনি করোনায় আক্রান্ত হন এবং তার মাধ্যমে তার স্ত্রীও সংক্রমিত হন। তবে, তারা দুজনই এখন করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

স্ত্রীর সুস্থ হওয়ার বিষয়ে নুরুন্নবী আহমেদ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। তিনি বলেন, চিকিত্সা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। যদিও ফরিদার মতো রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য সেটা এখনও যথেষ্ট না। আমি অপেক্ষায় আছি সেই দিনের, যেদিন সে এই সুন্দর পৃথিবীটা আবারও দেখতে পারবে। চারপাশের সব কিছু ছুঁয়ে দেখতে পারবে। সর্ব শক্তিমানের কাছে সব সময় দোয়া করি সে যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। অন্তত একবারের জন্য হলেও সে যেন দেখতে পায়, আমরা তাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করেছি। আমার মেয়েরা অপেক্ষায় আছে, কবে তাদের মা আবার তাদের নাম ধরে ডাকবে।

আলাপচারিতা শেষে বের হওয়ার সময় নুরুন্নবী আহমেদ বলে ওঠেন, ‘আগের চেয়ে ও (ফরিদা ইয়াসমিন) আমার আরও বেশি কাছের।’

Comments

The Daily Star  | English
BNP rally venue

BNP agrees to 10yr PM cap, objects to NCC

Party leaders said the decision was made to improve the BNP's image ahead of the next general election, as sticking to the previous stance was drawing criticisms.

10h ago