৪ সপ্তাহ নয়, ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া দরকার ৮-১২ সপ্তাহ পর
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/146085463_171716997756123_7788688617544864499_n.jpg?itok=CsIchiLm×tamp=1613295590)
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়ার ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দিলে ৩০ শতাংশ বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যায় বলে সর্বশেষ ট্রায়ালে দেখা গেছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার প্রথম এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ডব্লিউএইচওর সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ীও, প্রথম ডোজের ৮-১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশে প্রথমে আট থেকে ১২ সপ্তাহ পর ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও টিকাদান কর্মসূচি শুরুতে মানুষের তেমন আগ্রহ দেখা না যাওয়ায় ও নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে ভ্যাকসিন শেষ করার লক্ষ্যে চার সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু, এখন যেহেতু ভ্যাকসিন নিতে মানুষের আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেহেতু বেশি কার্যকারিতা পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশেও চার সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করে আট থেকে ১২ সপ্তাহ করা যায় কি না?
দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, কমিটির আরেক সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান এবং বায়ো মেডিকেল সাইন্স গবেষক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. খোন্দকার মেহেদী আকরামের সঙ্গে।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/news/images/3_37.jpg?itok=_WhhLd0v×tamp=1613295288)
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো, ভ্যাকসিন থেকে যত ভালো কার্যকারিতা আমরা পেতে পারি। চার সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার চেয়ে যদি সময় আরও কিছু বেশি করা যায়, তাহলে কার্যকারিতা বেশি হয়। তাই সেটা আমাদের পুনর্বিবেচনা করে দেখা উচিত। বিষয়টি আসলে আমাদের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। শুরুর দিকে দেখা গিয়েছিল যে, বেশি মানুষজন ভ্যাকসিন নিতে আসছে না। তখন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, মানুষ ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এখন বিষয়টি চিন্তা করতে হবে।’
পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে আপনারা সেই পরামর্শই দেবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা একই পরামর্শ দেবো। যেটা বিজ্ঞানভিত্তিক, অবশ্যই আমরা সেটার পরামর্শই দেবো।’
তবে, কিছু মানুষ আছে শহরের বস্তি এলাকা বা গ্রামাঞ্চলে যারা ভ্যাকসিন নিতে কেন্দ্রে আসবেন না বা তারা ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী নন। তাদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সেটা করতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু, সেটা নির্ভর করবে আমাদের সক্ষমতার ওপর। তবে, আগে যারা নিতে আগ্রহী তাদের দিতে হবে। তাদের দেওয়ার পর যদি দেখা যায় কেউ বাকি আছে, তখন আমরা অ্যাক্টিভ ভ্যাকসিনেশনের ব্যবস্থা নিতে পারি। তবে, আগে প্যাসিভটা শেষ করতে হবে। অর্থাৎ আগ্রহীদের আগে দিতে হবে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি বিবেচনায় বাকিদের ক্ষেত্রে গিয়ে গিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার দিকে যাওয়া যেতে পারে।’
‘কিন্তু, একটা বিষয় আছে। একবার বলা হলো, অন-স্পট রেজিস্ট্রেশন করা যাবে। পরে বলা হলো, সেটা বন্ধ থাকবে। আবার আজ বলা হলো প্রবীণদের জন্য অন-স্পট রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এই যে দিনে দিনে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা ভালো ব্যবস্থাপনার লক্ষণ নয়। এমন হলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক হতে হবে’, বলেন তিনি।
অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘প্রথমে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল ১২ সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার। পরে তা পরিবর্তন করে আট সপ্তাহ করা হলো। পরে ৭ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী টিকাদান কার্যক্রম শুরুর পর আমরা জানলাম চার সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। কিন্তু, বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এসেছে যে, আট থেকে ১২ সপ্তাহ ব্যবধানে ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নিলে কার্যকারিতা বেশি পাওয়া যায়। তাই সরকারের যে উচ্চকমিটি আছে, তারা প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার মধ্যে সময়ের ব্যবধানের বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পারে। বৈজ্ঞানিক সত্যতা যা বলছে, সে অনুযায়ী তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যদি ১২ সপ্তাহ পর দিলে কার্যকারিতা বেশি হয়, তাহলে সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটি বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে।’
‘পরামর্শ কমিটির সাব-কমিটিতে যারা আছেন, তাদের নিয়েই সরকারের ভ্যাকসিনের উচ্চ কমিটিটা করা হয়েছে। তাই ওই কমিটিটা বসেই বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখে সিদ্ধান্তটা নিতে পারে’, যোগ করেন তিনি।
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, ‘গত ৮ ফেব্রুয়ারি আমি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের বরাত দিয়ে বলেছিলাম যে, প্রথম ডোজ নেওয়ার আট থেকে ১২ সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ নিলে তা বেশি কার্যকর হয়। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) আট থেকে ১২ সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ভ্যাকসিনটির তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেই তারা এ পরামর্শ দিয়েছেন। তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে দেখা গেছে, প্রথম ডোজের ছয় সপ্তাহের চেয়ে কম সময় অন্তর দ্বিতীয় ডোজ দিলে কার্যকারিতা হয় মাত্র ৫৩ শতাংশ। আর দ্বিতীয় ডোজটি ছয় সপ্তাহ পরে দিলে কার্যকারিতা হয় ৬৫ শতাংশ। কিন্তু, দ্বিতীয় ডোজটি যদি দেওয়া হয় ১২ সপ্তাহে, তাহলে কার্যকারিতা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩ শতাংশে। অর্থাৎ প্রথম ডোজের চার সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দিলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা মূলত কমে যায় শতকরা ৩০ ভাগ। তাই বাংলাদেশেও চার সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। যুক্তরাজ্যেও ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এ তথ্যটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের জন্য প্রযোজ্য। অন্য কোনো ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে নয়।’
ভ্যাকসিন নেওয়ার পর শরীরে কতদিন পর্যন্ত অ্যান্টিবডি কার্যকর থাকে? এ বিষয়ে সর্বশেষ গবেষণার আপডেট কী?, জানতে চাইলে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. আকরাম বলেন, ‘সর্বশেষ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যদি প্রথম ডোজ দেওয়ার ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়, দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত অ্যান্টিবডি কার্যকর থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, ছয় থেকে ১২ মাস পর্যন্ত অ্যান্টিবডি কার্যকর থাকে। তবে, ছয় মাস পর্যন্ত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত। বাকিটা এখনো গবেষণাধীন। অর্থাৎ এই ভ্যাকসিনটির দুইটি ডোজ নেওয়ার পর নিশ্চিতভাবে ছয় মাস পর্যন্ত শরীরে অ্যান্টিবডি কার্যকর থাকে।’
উল্লেখ্য, দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত সাত লাখ ৩৬ হাজার ৬৮০ জনকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:
‘ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে’
Comments