কোরিয়ায় পাহাড়ের নেশা ও হাইকিং
সাগর-পাহাড় বেষ্টিত দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান অনন্য সুন্দর। এখানে যেমন দর্শনীয় সমুদ্র সৈকত আছে তেমনি আছে পাহাড়ে হাইকিং এর জন্য সুন্দর বন্দোবস্ত। ছুটির দিনে নিজের ক্লান্তি কাটানোর জন্য প্রায়ই হাইকিং এ বের হই। তবে বুসানে হাইকিং এর জন্য আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হলো গিয়ঞ্জাংসান পাহাড় কিংবা বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির বিয়োমেসা মন্দিরের পাহাড়।
বিয়োমেসা মন্দির কোরিয়ার পর্যটক আকর্ষনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। অনন্য সুন্দর শিল্পকর্ম আর এর অকৃত্রিম সৌন্দর্য আপনাকে বারবার টেনে নিয়ে যাবে। ৬৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি গিয়ঞ্জাংসান পাহাড়ের পূর্বদিকে অবস্থিত। ১৬শ শতকের শেষভাগে কোরিয়া উপদ্বীপ ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধে এর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলেও পরবর্তী শতকে এটিকে আবারো সুন্দরভাবে সাজানো হয়। অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে নির্মিত মন্দিরটি তখন থেকে প্রায় এখনো পর্যন্ত অবিকৃত রয়েছে।
এই মন্দিরের প্রবেশের মুখে আপনাকে দুটি প্রবেশদ্বার অতিক্রম করতে হবে যার প্রথমটি হচ্ছে "যোগীয়ম প্রবেশদ্বার" চারটি পাথুরে পিলারে নির্মিত এই প্রবেশদ্বারটি সাইড থেকে দেখলে মনে হবে প্রবেশদ্বারটি একটিমাত্র পিলারে নির্মিত। কোরিয়ান কালচার মতে সামনে থেকে দৃশ্যমান চারটি পিলার আমাদের সমাজের বৈচিত্র্যতাকে নির্দেশ করে আর সাইড থেকে যখন এই চারটি পিলারকে শুধু একটি লাইনে দৃশ্যমান হয় তখন সকল বৈচিত্র্যময়তা যে একই প্রভুর সৃষ্টি তাকে নির্দেশ করে! বৌদ্ধ-দর্শনের এই বিশালতা আজও কোরিয়ানদের ধর্মীয় জীবনে লক্ষ্যনীয়।
মন্দিরে প্রবেশের জন্য আপনাকে এরপর দ্বিতীয় প্রবেশদ্বার অতিক্রম করতে হবে। যার নাম চিয়ংমুন প্রবেশদ্বার। এই প্রবেশদ্বারে চারজন "স্বর্গের রাজা" প্রহরায়! ধর্মীয়মতে এই প্রবেশদ্বারের চারজন রাজা দর্শনার্থীদের মধ্যকার খারাপ গুণগুলোকে পরিশুদ্ধ করে মন্দিরে প্রবেশের জন্য তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। মন্দিরে প্রবেশের পর বিশাল এক পাহাড়ের কোলে এর অকৃত্রিম সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। ৯ম শতকে নির্মিত তিন তলা প্যাগোডাটিতে বৌদ্ধভিক্ষুরা আজও পূজা-অর্চনায়রত। মন্দিরের পুরাতন হলটি ১৬১৪ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। প্যাগোডার অনন্য নির্মাণশৈলী বর্তমানে কোরিয়ান সরকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম পুরাকীর্তি।
এরপরে আকর্ষণ হলো পাহাড়ে হাইকিং। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৫০ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে পায় ঘণ্টা চারেক সময় লেগেই যায়। শরীরের শক্তির সর্বোচ্চ পরীক্ষা দিয়ে আপনি যখন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাবেন তখন চারদিকের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে ফেলেছিল আমাকে। সাগর-পাহাড়বেষ্টিত বুসানকে অন্যরকম লেগেছিল। পাহাড়ের চূড়ায় ছোট্ট একটা সমাধিসৌধ মনকে কিছুটা অন্যমনস্ক করে তোলে।
জানা গেল, এটি প্রায় পাঁচশ বছর আগে এক নারীর সমাধি। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি এবং সন্ন্যাসব্রত নেন। মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীতে উনি মৃত্যুবরণ করলে উনার ইচ্ছামত শিষ্যরা উনাকে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় সমাধিস্ত করেন।
পাহাড়ের চূড়ায় হাইকিংয়ে একজন নেটিভ কোরিয়ানের সাথে পরিচয় হলো। বিদেশি দেখে উনি উনার সাথে আনা মিষ্টি আলু সিদ্ধ অফার করলেন আমাকে। মিষ্টি আলু খেয়ে বাঙালী স্বভাববশত এর বাইরের পাতলা খোসাটি বিশাল পাহাড়ের মধ্যে ফেলতে গেলেই উনি উনার সাথে আনা পলিব্যাগটি এগিয়ে দিলেন আমায়। সুন্দর মুচকি হেসে বললেন, এমন দর্শনীয় জায়গায় একটুখানি ময়লা ফেলা ঠিক নয়। যদিও সেটি ছিল পচনযোগ্য কিন্তু ময়লা তো ময়লাই। মনে মনে ভাবি প্রকৃতির প্রতি তাদের এই ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, বুসান, দক্ষিণ কোরিয়া। সহকারী অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
Comments