বিদায় ভবেরহাটের এক রঙিন মানুষ
বাংলা চলচ্চিত্র আর টিভি নাটক আজ এ টি এম শামসুজ্জামানকে হারাল। সিনেমার রূপালি পর্দা এ টি এমহীন হয়ে গেল। এক দুঃসহ সংবাদ। উনি মজা করে বলতেন- মাসুম তোমরা আমারে ভালো মানুষ বানাইছো। সিনেমাতে ভিলেনের অভিনয় করতে করতে সবাই আমারে মন্দ মানুষ বলে জানতো, তোমাদের রঙের মানুষ-এ বস্তানি শা’ চরিত্রের মাধ্যমে আমি এক আজগুবি ভালো মানুষে পরিণত হয়েছি।
সিনেমার একটা সময় গেছে, যখন অশ্লীলতা আর নিম্নমানের ছবি তৈরির অভিযোগে এফডিসি প্রায় ছবি শূন্য হয়ে পড়েছিল। তখন অনেকেই টিভির কাজ করতে এসেছিলেন। এ টি এম ভাই তাদের একজন। রঙের মানুষ ধারাবাহিকে অভিনয় করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন- অভিনয়ে কতটা বহুমুখী দক্ষতা তার আছে।
উনি একবার চোখ দেখাতে ভারতের চেন্নাইয়ে গিয়েছিলেন শঙ্কর নেত্রালয়ে, যেখানে অনেক বাঙালিই যান চোখের চিকিৎসার জন্যে। এ টি এম ভাইকে দেখে তাদের একজন ছুটে এসে বলেছিলেন- আপনি এখানে কী করছেন! আপনার রঙের মানুষ এর কী হবে। এ টি এম ভাই উত্তর দিয়েছিলেন- রঙের মানুষের বস্তানি শা’ ফকিরান্তি করতে এখানে আসছে, এটা নাটকেরই অংশ, সমস্যা হবে না। বলে উনি হো হো করে হেসেছিলেন। ফিরে এসে বলেছিলেন- তোমাদের রঙের মানুষ তো খুবই জনপ্রিয়।
উনি যে কথাটা খুব বেশি করে বলতেন, তা হলো ‘তুমি আর সালাউদ্দিন লাভলু তোমরা আসলে সিনেমার মানুষ, তোমরা কেন টিভি নিয়ে মেতে আছো। একদিন উনি আমাকে নিয়ে সিনেমার প্রযোজক মতিয়ুর রহমান পানুর কাছে নিয়ে গেলেন। সালাউদ্দিন লাভলুও ছিলেন। এ টি এম ভাই পানু ভাইকে বললেন- এরা রঙের মানুষের লোক, ওরা এখন সিনেমা বানাবে। উনি একটা গল্প শোনালেন পানু ভাইকে আর বললেন- এই হইল তোমার ছবির গল্প। পানু ভাই সহাস্যে রাজি হয়ে গেলেন। এরপর এ টি এম ভাই আমাকে বললেন- কাল থেকে তুমি আমার বাড়িতে বসে স্ক্রিপ্ট লেখতে শুরু করবা। পরদিন সকালে এ টি এম ভাইয়ের বাড়িতে গেলাম। উনার বৈঠকখানাতে সোফা-চেয়ার নাই। কেবল নরম তক্তপোশ বিছানো। অনেকটা রাজকীয় ভঙ্গি। একেকটা দৃশ্য ভাবনা শেষে সংলাপ লেখার পালা শুরু হয়। আমি লিলি আর এ টি এম ভাইকে শোনাই। উনি আমার শব্দগুলোকে একটু এদিক-ওদিক করতে বলেন।
লিখতে শুরু করার আগে তিনি বলে নিয়েছিলেন- শোনো মাসুম সিনেমা হইলো এমুন একটা জিনিস, যেইটা তোমার হাত থেকে বের হবে কিন্তু এর সফলতা থাকবে দর্শকের হাতে। তাই দর্শকদের চমকিত করতে একটা না একটা নতুন কিছু তোমার সিনেমাতে থাকতে হবে। আর সেই কারণেই এই সিনেমার নাম দেওয়া হয়েছে মোল্লাবাড়ির বৌ। এই যে মোল্লাবাড়ির বৌ প্রকৃতি ভালোবাসে গান ভালোবাসে, তার পিতা একজন বয়াতি এই বিষয়টাই হলো সম্পূর্ণ নতুন ধারণা।
আসলেও তাই, এই নতুন ধারণাকে ভিত্তি করে যে ছবি নির্মাণ করলেন সালাউদ্দিন লাভলু, তার সাফল্য আকাশচুম্বী হয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্রে যখন খরা চলছিল, তখন মোল্লাবাড়ির বৌ দর্শকদের হলে টেনে এনেছিল জোয়ারের মতো। এ টি এম ভাইয়ের বৈঠকখানায় বসে এই ছবি লিখতে গিয়ে আমি শিখেছিলাম অনেক কিছু। তার বৈঠকখানা যেন আমার শেখার বিশ্ববিদ্যালয়। এ টি এম ভাই ধারাবাহিকভাবে আমার লেখা লাভলুর পরিচালনায় অনেকগুলি খণ্ড নাটক করেছেন। কত কত স্মৃতি তার সঙ্গে। তার প্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। চলচ্চিত্রে দুজনেই একই ধারার চরিত্রে অভিনয় করেও তিনি ঈর্ষা নয়, ভালোবাসতেন ফরীদি ভাইকে, পছন্দ করতেন তার অভিনয় শৈলী।
ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে একটা নাটকে তার অভিনয়ের ইচ্ছা আমাকে জানিয়েছিলেন। সেটা ২০০৪ সালের কথা, আমার দীর্ঘ ধারাবাহিক ভবের হাট লিখলাম। দুই ভাইয়ের ভেতরে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের নাটক ছিল সেটা। মারেম খাঁ আর হারেম খাঁ। পরিচালক সালাউদ্দিন লাভলু মারেম খাঁর চরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামান আর হারেম খাঁ চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদিকে নির্বাচন করলেন। জমে গেলো ভবেরহাট। চ্যানেল আই-এ প্রচারিত হতো নাটকটা। তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলো নাটকটা। এ টি এম ভাই ধূমপান করতেন। তার ধূমপান করার ধরন নিয়ে আমরা বেশ হাসাহাসি করতাম। তিনি প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটাকে টিপে টিপে নরম করতেন আর দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। এরকম বেশ কয়েকবার ফুঁ দিয়ে তারপর তিনি সিগারেটটা ধরাতেন।
এক মজার মানুষ ছিলেন তিনি। প্রকৃতই রঙের মানুষ। তিনি ঢাকার একজন পীরের ভক্ত ছিলেন। একদিন খুব সকালে আমার বাসার কলিংবেল বেজে উঠল, দরজা খুলে দেখি এ টি এম ভাই। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। উনি বললেন- এখুনি চল মাসুম তোমারে একটা গান লিখতে হবে। চলো তোমার অফিসে বইসা গানটা লেইখা দাও। আমি উনাকে সঙ্গে করে ধানমন্ডি বত্রিশের অফিসে গেলাম। বসে বসে একটা গান লিখে দিলাম।
আজ এ টি এম ভাইয়ের মৃত্যুতে ফেসবুক জুড়ে কেবল শোকের বার্তা। প্রত্যেকেই বলছেন- এটিএম ভাইয়ের অভাব অভিনয় জগতে কখনোই পূরণ হবে না। জাতীয় চলচ্চিত্র ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অনবদ্য অভিনয়শিল্পীর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। ভবেরহাটের এক রঙের মানুষ আপনাকে বিদায়। আপনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের অন্তরে।
মাসুম রেজা: নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও নাট্য নির্দেশক
Comments