নায়ক পরিচয়ের আড়ালের সোহেল রানা মহানায়ক

সোহেল রানা। ছবি: স্টার

সোহেল রানা। রূপালী পর্দার একসময়ের সাড়া জাগানো নায়ক। এর বাইরে তার আরও পরিচয় রয়েছে। তিনি ছাত্ররাজনীতি করেছেন দাপটের সঙ্গে। তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে সুনাম ছিলো তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ভিপি ছিলেন সোহেল রানা। ছয় দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানে পালন করেছেন সক্রিয় ভূমিকা। অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধেও। এক সময়ের ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানার আজ জন্মদিন। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার জীবনের না বলা নানা কথা।

 

ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ছাত্রনেতা থেকে অভিনেতা। ছাত্র রাজনীতির সেই দিনগুলো মনে পড়ে?

ছাত্র রাজনীতি আমার জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে ছিলো, যা কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব না। সেসব কথা তো মনে পড়ারই কথা। কখনোই ভুলতে পারব না, মনে পড়ে। ১৯৬১ সালে আমি ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম। ওই কলেজে পড়ার সময় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। ১৯৬৫ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের এজিএস, ১৯৬৮ সালে পুরো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলাম। আমার জীবন জুড়ে ছিলো ছাত্রলীগের রাজনীতি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ইকবাল হলের ভিপি নির্বাচিত হই।

ইকবাল হলের ভিপি নির্বাচিত হওয়া নিয়ে একটি দারুণ গল্প মনে পড়ছে। ইকবাল হলে থাকার সময় মাঠের মধ্যে বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মিটিং করতাম। বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা আমাদের কাছে আসত। ওরা আমাদের কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে ওদের কলেজে গিয়ে ছাত্রলীগের বার্তা ছড়িয়ে দিত। এভাবে ঢেউয়ের আকারে ছাত্রলীগের চেতনা ও আদর্শ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। মোট কথা ইকবাল হলের ছাত্রলীগের নেতৃত্বের একটা বিরাট অবদান ছিলো সব আন্দোলনে।

স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নির্বাচন হলো। একমাত্র ইকবাল হলে আমিসহ পুরো প্যানেল পাশ করেছিলাম। ছাত্রলীগ তখন বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। যে কারণে এমন অবস্থা হয়েছিলো। আমি মুজিববাদ ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচন করে জয় লাভ করেছিলাম।

সেজন্য বলব- ছাত্র রাজনীতি আমার জীবন জুড়ে ছিলো। এই স্মৃতি মনের ভেতরে সারাজীবন গেঁথে থাকবে।

আপনার রাজনৈতিক দর্শন কি ছিলো?

বঙ্গবন্ধু যা বলতেন সেটাই ছিলো আমার রাজনৈতিক দর্শন। বঙ্গবন্ধুর কথার বাইরে আমার কোনো কথা ছিলো না। তিনিই আমার নেতা ছিলেন। এখনো তিনিই আমার নেতা। তার কথার কারণেই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলাম। তিনি যা বলতেন সেটাই আমার সব। বঙ্গবন্ধু যা চেয়েছেন আমিও তাই চেয়েছি। কারণ তিনিই আমার নেতা।

বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন, আমি শোষিতের পক্ষে। আমার কথাও তাই ছিলো। আমিও ছিলাম শোষিতের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু যে আদেশ দিতেন সেটাই আমরা পালন করতাম। কাজেই বঙ্গবন্ধুর যে রাজনীতি সেটাই ছিলো আমার দর্শন।

কোনো দুঃখবোধ কাজ করে?

এখন দুঃখ লাগে মুজিববাদ কথাটি আর শুনি না। ছাত্রলীগের মুখেও মুজিববাদ কথাটি শুনি না, এজন্য দুঃখ লাগে। আমাদের সময়ে মুজিববাদ কথাটি খুব চালু ছিলো। একটা সময় আমরা শ্লোগান দিতাম- তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। আবার বঙ্গবন্ধুকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে নেওয়া হলো, তখন আমরা শ্লোগান দিতাম- জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব। তখন আমাদের একটাই দাবি উঠেছিলো- বঙ্গবন্ধুকে আনতে  হবে জেল থেকে।

এখন কী রাজনীতি থেকে একেবারেই দূরে সরে এসেছেন?

এখন আমি ফ্রন্টে নেই। চাইলেই তো রাজনীতি থেকে সরে আসা যায় না। কিন্তু ফ্রন্টে নেই আমি, কালচারালি আছি। এখনকার রাজনীতি খুব স্বার্থের, হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়ার। বঙ্গবন্ধু তো আমাদের তা শেখাননি। বঙ্গবন্ধু মানুষ হতে শিখিয়েছিলেন। শোষিতের পক্ষে থাকতে বলেছিলেন। মানুষের মঙ্গলের কথা বলতেন বঙ্গবন্ধু।

রাজনীতি থেকে খুব বেশি দূরে নেই। ৫৮ বছর হয়ে গেল রাজনীতির বয়স। এখন অ্যাকটিভলি করার বয়স নেই। আওয়ামী লীগে এত মেধার ভিড়। এছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো পার্টির ব্যাপারে প্রশ্নই আসে না। আদর্শের জায়গা থেকে যেতে অন্য কোথাও যেতে পারব না।

আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের কোনো স্মৃতি শুনতে চাই।

মুক্তিযুদ্ধের কত স্মৃতিই তো রয়ে গেছে। সেসব কথা মনে থেকে যাবে যতদিন বেঁচে থাকব। আমাদের কমান্ডার ছিলেন মোস্তফা মহসিন মন্টু। তার নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করেছি। একটি ঘটনা বলছি। একবার কেরানীগঞ্জের ওদিকে আমরা যুদ্ধ করতে যাই। সেখানে পাকিস্তানি মিলিটারি ছিলো প্রায় একশ জনের মতো। আমরাও ছিলাম একশ পাঁচ জনের মতো। গোলাগুলি শুরু হয়, ওদের ছিলো আধুনিক সব অস্ত্র। আমাদের ছিলো মনোবল আর পুরনো অস্ত্র। একসময় ওরা পিছু হটে যায়, কয়েকজন মারা যায়। আমাদের কয়েকজন আহত হলেও কেউ নিহত হয়নি। কিন্তু ওরা পিছু হটে যাওয়ার সময় সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলো। অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলো। আমরা যখন হিট করেছিলাম ওরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে পিছু হটে যায়।

একটি কথা জোর দিয়ে বলব- আমাদের বিজয় নয় মাসের ফসল হলেও বঙ্গবন্ধু এর বীজ বপন করেছিলেন অনেক আগেই। ছয় দফা দাবি তিনি যখন থেকে জানানো শুরু করেছিলেন তখন থেকেই মূলত স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু। আবার ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সব বলে দিয়েছিলেন। সেজন্য বলব, যুদ্ধের ফসল নয় মাসের হলেও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিলো বহু আগে। যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই। আপনি পরিবারের সবার বড়, সবার শ্রদ্ধার, সম্মানের। পরিবারের সবাই আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসেন।

আমি পরিবারের প্রতি আমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। আমার ভাইয়েরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, তাদের সবাই প্রতিষ্ঠিত। বোনরাও সফল। আমি আমার বাবার বড় ছেলে। বাবা মারা যাবার পর সবার জন্য যতটা প্রয়োজন করেছি। একটা শৃঙ্খলা আছে আমাদের পরিবারে, অনেক আগে থেকে। বাবাকে আমরা সবাই সম্মান করতাম। আমার ভাই-বোনরা আমাকে অসম্ভব সম্মান করে। তাদের সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছি, এটাই বড় ব্যাপার। সবাই সততা আর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছে বলেই সাফল্য এসেছে। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ছিলো সেটুকু করেছি। দায়িত্বটা পালন করেছি মাত্র।

এদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’ এর প্রযোজক আপনি। এই সিনেমাটি তৈরি করার চিন্তা কীভাবে এসেছিলো?

‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার বেশিরভাগ ঘটনাই সত্য। একসময় আমি দৈনিক ইত্তেফাকে সিনেমা বিষয়ক পাতায় লিখতাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছোট ছোট কিছু ঘটনা লিখে রাখি। এর সবই যুদ্ধের এবং সত্য। মুক্তিযোদ্ধা খসরু ও মন্টু আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। চাষী নজরুল ইসলামও আমার বন্ধু ছিলেন, তিনি একটি সিনেমা বানাবেন। আমি মাসুম ইয়াহুদী নামে একজনকে বললাম, আমি ছোট ছোট কিছু ঘটনা দেব, আপনি সাজিয়ে লিখুন। গল্প দাঁড়িয়ে গেল। সেই গল্পে চাষী নজরুল সিনেমা বানাবেন এবং অর্থ লগ্নি করি আমি।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, ইকবাল হলে থাকতাম। দেশ স্বাধীনের পর জানতে পারি অনেক বন্ধুই বেঁচে নেই। তারা যুদ্ধে মারা গেছেন। জাফর, চিশতী ওরাও ইকবাল হলে থাকত। খুব মনে পড়ে ওদের কথা। ওই ভাবনাটাও কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা প্রযোজনা করার ক্ষেত্রে।

Comments