মানিকছড়িতে তামাক চাষ মুক্ত হলো ৩ গ্রাম

ঘোরকোনা, ছদুরখিল ও হালদারচর— খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার তিন দুর্গম গ্রাম। সেখানকার কৃষকরা কষ্ট করে ফসল ফলালেও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ফড়িয়াদের কাছে অল্প দামে পরিশ্রমের ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতেন।
ঘোরখোনা গ্রামের কৃষক ফজলুল হক গত বছরও খেতে তামাক চাষ করেছিলেন। এ বছর তিনি আলু চাষ করেছেন। ছবি: মোস্তফা ইউসুফ

ঘোরকোনা, ছদুরখিল ও হালদারচর— খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার তিন দুর্গম গ্রাম। সেখানকার কৃষকরা কষ্ট করে ফসল ফলালেও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ফড়িয়াদের কাছে অল্প দামে পরিশ্রমের ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতেন।

হঠাৎ ২০০৭ সালের একদিন এক তামাক কোম্পানির লোকেরা এই গ্রামগুলোতে হাজির হন কৃষকদের দীর্ঘদিনের এ সমস্যার সমাধান নিয়ে। তারা কৃষকদের তামাক চাষ করার প্রস্তাব দেন।

তারা কৃষকদের তামাক চাষের জন্যে সার-বীজ-কীটনাশক— সবকিছু বিনামূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুত ও উৎপাদিত তামাকপাতা খেত থেকে দ্বিগুণ দামে কিনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। প্রলোভন দেখিয়ে তারা কৃষকদের ধান-সবজিচাষি থেকে রাতারাতি তামাকচাষি বানিয়ে ফেলেন।

আপাতদৃষ্টিতে এ রূপান্তর কৃষকদের আর্থিক সংকট সমাধান করলেও তা ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্যপ্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর জন্য।

তামাক চাষে ব্যবহৃত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কীটনাশক-সার-বিষ বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদীতে গিয়ে পড়ত। ফলে টানা সাত বছর হালদা নদী থেকে ডিম আহরণ আশংকাজনকভাবে কমে গিয়েছিল। এমনকি, ২০১৬ সাল হালদা নদী ছিল ডিমশূন্য।

হালদা বিশেষজ্ঞরা এর কারণ খুঁজতে গিয়ে হালদার উজানে ব্যাপক আকারে তামাক চাষ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পান।

২০১৬ সালের মার্চে দ্য ডেইলি স্টারে হালদার উজানে মানিকছড়িতে তামাক চাষের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপরই পিকেএসএফ’র অর্থায়নে ইন্টেগ্রেটেড ডেভেলপম্যান্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) হালদার উজানের গ্রাম তিনটিকে তামাক চাষ মুক্ত করার প্রকল্প হাতে নেয় ২০১৭ সালে।

তিন বছরের মাথায় সে প্রকল্পে সফলতা পায় আইডিএফ।

যেভাবে সম্ভব হলো তামাক চাষ মুক্তকরণ

বিশিষ্ট হালদা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ তামাক চাষের কারণে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হচ্ছিল হালদা নদী। প্রথম যখন আমরা তিন গ্রামের মানুষকে বুঝাতে এসেছিলাম তখন তারা আমাদেরকে ভালোভাবে নেননি। তাদের আর্থিক লাভ তারা হারাতে চাচ্ছিলেন না।’

‘তাদেরকে যখন ধীরে ধীরে বুঝালাম তামাক চাষের ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়, জমির উর্বরতা নষ্ট হয়, এমনকি তামাকচাষিদেরও এর ফলে নানা রোগে ভুগতে হয়, তখন তারা নমনীয় হতে শুরু করেন,’ বলেন অধ্যাপক কিবরিয়া।

আইডিএফ’র এ প্রকল্প সম্পর্কে তামাক কোম্পানিগুলোর বিরূপ প্রচারণার মধ্যেও তাদেরকে তামাক চাষ থেকে ফিরিয়ে আনতে আইডিএফ সফল হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

ঘোরখোনা গ্রামের সায়রা বানু (৪৫) নিজের দুই সন্তান নিয়ে একসময় তামাক চাষে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। এ প্রকল্পের অধীনে এখন তিনি সবজি ও ধান চাষে ফিরে এসেছেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘যখন তামাক কোম্পানিগুলো আমাদের এ ধরনের প্রস্তাব দিলো,তখন আমরা সবাই দলে দলে তামাক চাষে ঢুকে গেলাম। যখন তামাক উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে বেড়ে গেল তখন কোম্পানির লোকজন ধীরে ধীরে তামাকের দাম কমাতে লাগল। আর এর মধ্যে আইডিএফ বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসে।’

‘সবদিক ভেবে আমরা তামাক চাষ থেকে বের হয়ে এখন পরিবেশসম্মতভাবে ধান ও সবজিসহ নানা ফলের চাষ করছি,’ যোগ করেন তিনি।

একই গ্রামের গিয়াস উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তামাক কোম্পানির প্রস্তাব এক সময় আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। পরে আমরা বুঝতে পারি, এর বিষের কারণে হালদার  ক্ষতি হচ্ছে, জমির ক্ষতি হচ্ছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইডিএফ যখন বিকল্প নিয়ে আসে তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আর তামাক চাষ করব না।’

আইডিএফ শতাধিক কৃষককে বিনামূল্যে বীজ, সার, ফলের চারা আর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এই তিন গ্রামের মানুষদের।

তারা এখন প্রায় ৪০০ একরের মতো জমিতে তামাকের বদলে নানান জাতের সবজি ও ফলের চাষ করছেন।

আইডিএফের নির্বাহী পরিচালক জহুরুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শুরুটা অনেক কঠিন ছিল। গ্রামবাসীর সঙ্গে আমরা দফায় দফায় আলোচনা করেছি। তাদের সমস্যাগুলো জানার চেষ্টা করে তাদেরকে বিকল্প পথ দেখিয়েছি।’

‘মাত্র তিন বছরে আমরা তাদেরকে তামাক থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি,’ বলে যোগ করেন তিনি।

সেই তিন গ্রামে তামাকচাষ বন্ধ হওয়ায় হালদাও ফিরে পেয়েছে তার স্বরূপ। ২০২০ সালে হালদা নদীতে ডিম উৎপাদিত হয়েছিল ২৫ হাজার ৭৩৬ কেজি। এটি গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

Comments

The Daily Star  | English
Rice price in Bangladesh is rising and the rate of coarse grain has crossed Tk 50 a kilogramme nearly after a year

How much do the poor pay for rice? At least Tk 50 a kg

Rice price in Bangladesh is rising and the rate of coarse grain has crossed Tk 50 a kilogramme nearly after a year

6h ago