শ্রদ্ধাঞ্জলি

শেষ বক্তব্যে যা বলেছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ

বাংলাদেশের খ্যাতিমান কলাম লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক সৈয়দ আবুল মকসুদ মারা গেছেন গতকাল মঙ্গলবার। মঙ্গলবার দিনটি যেন তার ভীষণ প্রিয়। প্রতি মঙ্গলবার নিয়ম করে বাংলা দৈনিক প্রথম আলোতে তার লেখা প্রকাশিত হতো। কোনো মঙ্গলবারে ‘সহজিয়া কড়চা’, পরের সপ্তাহে হয়তো ‘বাঘা তেঁতুল’।
Syed Abul Maksud
সৈয়দ আবুল মকসুদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের খ্যাতিমান কলাম লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক সৈয়দ আবুল মকসুদ মারা গেছেন গতকাল মঙ্গলবার। মঙ্গলবার দিনটি যেন তার ভীষণ প্রিয়। প্রতি মঙ্গলবার নিয়ম করে বাংলা দৈনিক প্রথম আলোতে তার লেখা প্রকাশিত হতো। কোনো মঙ্গলবারে ‘সহজিয়া কড়চা’, পরের সপ্তাহে হয়তো ‘বাঘা তেঁতুল’।

জীবনের শেষ মঙ্গলবারে তিনি লিখেননি; তবে বলেছেন। গতকাল (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সড়ক ভবনে আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রবীণ এই ‘শুভ্রব্রত পালনকারী’। সেলাইবিহীন চিরচেনা সাদা পোশাকেই এদিন তাকে পর্দায় দেখা গেছে।

সৈয়দ আবুল মকসুদের বিদায়ের রজনীতে ওই অনুষ্ঠানের ভিডিওচিত্রটি ভক্ত-অনুসারীদের ফেসবুকের পাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিডিওতে তিনি বারবার বলছিলেন, তার কষ্ট হচ্ছে; কদিন ধরেই তিনি অসুস্থ। জ্বর, কাশি। একাধিকবার তাকে কাশির দমকে কথা থামাতে হয়। কথা বলার ফাঁকে সহকারীর কাছে পানি চেয়ে নেন একবার।

মুজিব শতবর্ষের এই অনুষ্ঠানে তিনি যে মিনিট দশেক কথা বলেছেন, তাতে আলোটা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর। সৈয়দ আবুল মকসুদ ইতিহাস নিয়ে কাজ করতেন। সাহিত্য-ইতিহাসের চরিত্রগুলো তার লেখনিতে ওঠে এসেছে বারংবার। জীবনসায়াহ্নে বঙ্গবন্ধুর জীবনের কয়েকটি দিক নিয়েও লেখার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন ওই বক্তব্যে। কিন্তু, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে তার লেখাটি হয়নি বলেও জানান।

অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম— এটা দুই-একঘণ্টা, দুই-একদিন বা দুই-এক বছরের আলোচ্য বিষয় নয়। যতদিন এই জাতি আছে ততদিন তার কর্ম ও তার নীতি-আদর্শ নিয়ে আলোচনা হবে।

তার মতে, বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে একটি জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দেন। এসব আলোচনার বিষয়ে শত শত ঘণ্টার দরকার। সেটা তার নিজের বক্তৃতা-বিবৃতি-ভাষণের ভেতরে পাওয়া যায়। নুতন প্রজন্ম তার লেখালেখি, তার জীবন ও কর্ম দেখে জীবন-আদর্শ গ্রহণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর জীবনের কয়েকটি দিক..., এখন অনেকে বই পড়ে তার জীবন সম্পর্কে জানবে... কিন্তু আমাদের বিরল সৌভাগ্য যে তার সঙ্গে চলাফেরা করার সুযোগ হয়েছে। তাকে পাশে থেকে দেখেছি। তার মহত্ত্ব দেখেছি, মানুষের প্রতি তার যে ভালোবাসা— সেটা দেখেছি। কাজেই সেই সব কথা যদি আজকের প্রজন্মের মানুষের কাছে সরাসরি বলতে পারতাম...। সেই জিনিসটি এই করোনার কারণে হয়ে ওঠেনি।’

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার মূল্যায়ন— ‘অনেকেই বলেন তিনি (বঙ্গবন্ধু) মহান নেতা কিন্তু প্রশাসক হিসেবে তিনি ততটা সাফল্যের পরিচয় দেননি। আমি মনে করি, এটা একটা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি। স্বাধীনতার পরে যে তিন-চার বছর তিনি দেশ শাসন করেছেন, আমরা খুব কাছে থেকে দেখেছি যে তিনি ফাইলওয়ার্কও অত্যন্ত নিপুণভাবেই করতেন। শুধু যে স্থানীয় প্রশাসনিক কাজ তা না, এতগুলো দেশের স্বীকৃতি তিনি আদায় করেন। সেটা তার কূটনৈতিক দক্ষতা ছাড়া সম্ভব হতো না। তার যে কূটনৈতিক সাফল্য, সেটা তুলনাহীন।’

তিনি বলেন, ‘নানা রকম প্রতিবন্ধকতা, পাকিস্তানের নানা রকমের শত্রুতা, এসবকে মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায় করেছেন। কাজেই তার যে জীবন ও কর্ম সেগুলো আলোচনা পর্যালোচনা হওয়া দরকার। সেগুলো থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জাতির নেতার কাছ থেকে আদর্শ যদি গ্রহণ করতে না পারে তাহলে অগ্রসর হওয়া কঠিন।’

‘কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, আমাকে ক্ষমা করবেন; তবে এখানেই শেষ না, আমরা তো লেখালেখি করেছিও, আরও করবো...’— এমনটাই ছিল সৈয়দ আবুল মকসুদের শেষ কথা।

সৈয়দ আবুল মকসুদের সেই লেখা অসমাপ্তই রয়ে গেলো।

এর আগে তিনি লিখেছেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবন, কর্মকাণ্ড, রাজনীতি ও দর্শন (১৯৮৬) ও ভাসানী কাহিনী (২০১৩); সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য (২০১১), স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ (২০১৪); স্যার ফিলিপ হার্টগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য (২০১৬)।

সংযুক্তি: একটি স্মৃতিচারণ

শাহবাগে কোনো এক বইমেলার উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। সেদিন তিনি উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা বই কিনুন। বই কিনলে পড়তে হবে, এমন কোনো কথা নেই।’

ভুল পড়ছেন মনে হচ্ছে?— না। পরের লাইনে তিনি বললেন, ‘স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে ১ লাখ ৩৭ হাজার বই ছিল। তিনি কি সব পড়তে পেরেছেন? আমি গত ৫০ বছরে যে বই কিনেছি, সবগুলো পড়িনি। কখনো অংশবিশেষ পড়েছি। এমনও বই আছে যেগুলো কয়েক পৃষ্ঠা পড়েছি মাত্র। কিন্তু, ঘরে বই রাখতে হয়। দরকারি দুই-এক পাতা পড়ার জন্যও হাতের কাছে বই রাখতে হয়।’

তার রচিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। পত্রিকার পাতায় বইপ্রেমী এই মানুষটার লেখা আর ছাপা হবে না; তিনি বেঁচে থাকবেন প্রকাশিত-অসমাপ্ত বইগুলোর ভাঁজে ভাঁজে।

আরও পড়ুন:

লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের জানাজা ও দাফন আজ

লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ আর নেই

Comments

The Daily Star  | English

Mangoes and litchis taking a hit from the heat

It’s painful for Tajul Islam to see what has happened to his beloved mango orchard in Rajshahi city’s Borobongram Namopara.

13h ago