এক আলোর দিশারী বই পথিকের গল্প
কেউ বই ধার নিতে চাইলে বইয়ের মালিকের কপালে খানিকটা চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ভাঁজটা আসলে ‘বই আদৌ ফেরত আসবে কিনা’ এই ভাবনার।
সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত বই কেনা প্রবন্ধে মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরির কথা বলি তাহলে- ‘মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরীখানা নাকি দেখবার মতো ছিল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বই, বই আর শুধু বই। এমন কী কার্পেটের উপরও গাদা গাদা বই স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে থাকত- পা ফেলা ভাঁড়। এক বন্ধু তাই মার্ক টোয়েনকে বললেন, ‘বইগুলো নষ্ট হচ্ছে; গোটা কয়েক শেলফ যোগাড় করছ না কেন?’ মার্ক টোয়েন খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে বললেন, ‘ভাই বলেছ ঠিক। কিন্তু লাইব্রেরীটা যে কায়দায় গড়ে তুলেছি শেলফ তো আর সে কায়দায় যোগাড় করতে পারীণে। শেলফ তো আর বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধার চাওয়া যায় না।’
বই ধার নিয়ে শেষ পরিণতি এমনই মনে করে মানুষ।
এবার আসি এর ঠিক উল্টো গল্পে- অকাতরে বই ধার দেওয়া একজনের জীবনের গল্পে।
রাজশাহীর নাটোর মহকুমার বাগাতিপাড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তার। পারিবারিক সূত্রে নাম হারেজ উদ্দিন সরকার। মা ডাক নামটা রেখেছিলেন ‘পলান’। জন্মের পাঁচ মাস পরেই পলান তার বাবাকে হারান। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আর্থিক অনটনে বন্ধ হয়ে যায় তার পড়ালেখা।
কিন্তু, পলানের নানা বিষয়টি মেনে নিলেন না। বললেন, নাতিকে নিজের কাছে রেখেই পড়াবেন। তাকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি রাজশাহীর বাঘায়, বাউশা গ্রামে। স্থানীয় স্কুলে পলানকে ভর্তি করালেন, কিন্তু সেখানেও ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি পড়ার সুযোগ ছিল না। ফলে, সে পর্যন্তই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি পলান সরকারের।
তার নানা ময়েজ উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় জমিদার। পড়াশোনা ছাড়লেও নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন পলান সরকার। নানার মৃত্যুর পর ৪০ বিঘা জমিও জুটেছিল তার ভাগে। পরবর্তীতে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে বাউশা ইউনিয়ন পরিষদে কর আদায়কারীর চাকরি পান। তখন থেকেই নেশা পেয়ে বসে যাত্রাদলের। ভাঁড়ের চরিত্রে তার অভিনয় হতো নিখুঁত। যাত্রাদলের সঙ্গে তিনি ঘুরতেন গ্রাম থেকে গ্রামে, চর থেকে চরে, গঞ্জ থেকে গঞ্জে। কখনো মঞ্চের পেছনে যাত্রার পাণ্ডুলিপি থেকে অভিনয়শিল্পীদের সংলাপ পড়ে শোনাতেন, যাকে প্রম্পট বলে। এই প্রম্পট বলতে গিয়েই আরেক নেশায় জড়িয়ে যান তিনি। বই পড়ার নেশায়।
বাউশা ইউনিয়নে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। ১৯৬৫ সালের দিকে বাউশা গ্রামে একটি হাইস্কুল নির্মাণের প্রয়োজন বোধ করেন গ্রামবাসী। কারণ, গ্রামের কাউকে পড়তে হলে যেতে হতো বাঘা পর্যন্ত। পড়ার সুযোগ না পাওয়া পলান সরকারসহ বেশ কয়েকজন উদ্যোগ নিলেন হাইস্কুল করার। পরে হারুন অর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পলান সরকার একাই দিলেন ৫২ শতাংশ জমি। তাকে দেওয়া হলো সেই বিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্বও। দায়িত্ব পালনের এক পর্যায়ে তার মাথায় আসে অন্য চিন্তা- কীভাবে স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আরও আগ্রহী করা যায়? বইপাগল এই মানুষটি ভাবলেন- এই তো সুযোগ এক ঢিলে দুই পাখি মারার। স্কুলে যারা প্রতি বছর মেধা তালিকায় স্থান করে নিতো তাদের মধ্যে প্রথম ১০ জনকে বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এতে শুরু হলো এক মধুর সমস্যা। বাকি শিক্ষার্থীরাও তার কাছে বই পড়ার আবদার করতে থাকে। তিনি দেখলেন এরা পড়তে চায়, কিন্তু পড়ার সুযোগ নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন সবাইকে বই দেবেন। তবে শর্ত আছে।
শর্ত হলো- বই পড়ে ফেরত দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের দেখাদেখি বই ধার চাইতে শুরু করেন গ্রামের মানুষও। তার কাছে বিনা পয়সায় বই পড়া যায়। শিক্ষার্থী ছাড়াও গ্রামের মানুষদেরও সানন্দে বই ধার দিতে শুরু করলেন পলান সরকার। চারা গজালো এক মহতী আন্দোলনের। নাম যার- বই পড়া আন্দোলন।
কর আদায়কারী হিসেবে কাজ করে যা উপার্জন করতেন তার বেশিরভাগই তিনি ব্যয় করতেন বই পড়া আর বই বিলির পেছনে। তখন স্থানীয়রা তার বাড়িতে আসত বই ধার নিতে, আবার বই পড়া শেষে ফেরত দিয়ে যেত।
১৯৯২ সালে হঠাৎ তিনি জানতে পারেন তার শরীরে বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিস। ডাক্তারের কড়া হুকুম, এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে প্রতিদিন অন্তত তিন কিলোমিটার হাঁটতে হবে।
এই ডায়াবেটিস তার জীবনে যেন শাপে-বর হয়ে এলো। তার মাথায় এলো আরেক অভিনব চিন্তা। যারা বাড়ি আসতেন বই নিতে তাদের বললেন, তারা যেন আর বাড়িতে না আসে। তিনি নিজেই যাবেন তাদের বাড়িতে বই ধার দিতে এবং পড়া শেষে ফেরত নিতে। প্রথমে ঘুরে ঘুরে নিজ গ্রামে বই বিলি করতেন।
তারপর তার মনে হলো- বাকি গ্রামগুলো কেন বাদ পড়বে, বঞ্চিত থাকবে? একে একে বাউশা গ্রাম ছাড়াও দিঘা, চকরপাড়া, টলটলিপাড়া, হাটপাড়া, মাঠপাড়া, ফতেপুর, অমরপুর, সরকার পাড়া, বেনুপুরসহ বাউশা ইউনিয়নের ১২টি গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে বই বিলি করতেন তিনি। এই গ্রামগুলোতে তার বিলি করা বইয়ের পাঠক সংখ্যাই ছিল হাজারের বেশি। ভোরবেলা তিনি বাড়ি থেকে বের হতেন ঝোলা কাঁধে। যেন ঝোলা কাঁধে আসছেন এক আশ্চর্য জাদুকর। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝোলা থেকে বের করতেন বই নামক আলোক রেখা। গ্রামের মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতেন বইয়ের ঝোলা কাঁধে উঠানে হাজির আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার।
কেবল কী বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই বিলি? না, কেবল এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না পলান সরকার। কেউ তাকে কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলে তিনি বই উপহার দিতেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের জন্য তার পক্ষ থেকে উপহার দেওয়া হতো বই। এ ছাড়াও, তার চালকলে হালখাতার সময় যারা বাকি পরিশোধ করতেন তাদেরও একটি করে বই উপহার দিতেন তিনি।
বেশি বইপড়া মানুষ নাকি খানিকটা কাঠখোট্টা হয়, এমনটা কথা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু, এর পুরো বিপরীত ছিলেন পলান সরকার। হয়তো যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। হাসিঠাট্টায়ও জুড়ি ছিল না তার। বাড়িতে পলান সরকার উপস্থিত হলেই অনেকেই বলতেন, ‘ওরে, তোদের দুলাভাই এসেছে, বসতে দে।’ বই বিলি করা প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে ছিল তার আত্মিক সম্পর্ক। কখনো বই বিলির ফাঁকে তাকে জোর করে নাশতা করাতেন মানুষ।
১৯৯২ সালে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গড়ে তোলা বই পড়া আন্দোলন চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু। নিজে পড়াশোনা করার তেমন বেশি সুযোগ না পেলেও সন্তানদের সবাইকে শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন পলান সরকার। তার চার ছেলে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন, এক ছেলে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করেন, আর ছোট সন্তান প্রকৌশলী।
পলান সরকার দেশব্যাপী প্রচারমাধ্যমে আলোচনায় এসেছিলেন বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ইত্যাদি প্রচারিত হওয়ার পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। দেশের নানা প্রান্তে তার দেখাদেখি বহু যুবক বই পড়া ও বই বিলি আন্দোলন গড়ে তোলেন। ২০০৭ সালে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো তাদের শনিবারের সাময়িকী ‘ছুটির দিনে’ তাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে উপলক্ষে সারাবিশ্বের বিভিন্ন ভাষার প্রভাবশালী দৈনিকে তাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাকে নিয়ে নির্মিত হয় ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’ নামের একটি নাটকও।
২০১৯ সালের পহেলা মার্চ চিরবিদায় নেন বাংলার অনন্য আলোক দিশারী পলান সরকার। আজ আলোর এই ফেরিওয়ালার প্রয়াণ দিবস। তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
আহমেদ ইশতিয়াক, ফ্রিল্যান্স লেখক, সাংবাদিক
Comments