সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার

Chapainawabganj.jpg
নার্সারিতে কাজ করছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের তিন নারী। ছবি: স্টার

দশকের পর দশক ধরে মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নারী শ্রমিকরা। কৃষি জমিতে সমান কাজ করলেও নারীদের মজুরি পেতে হয় পুরুষের চেয়ে কম। অভাবের কারণে বাধ্য হয়ে প্রতিদিন কম মূল্যে শ্রম বিক্রি করছেন তারা।

সদর উপজেলার বৈলঠা গ্রামের কোল সম্প্রদায়ের ৪৪ বছর বয়সী নিরাসি টুডু ১৩ বছর বয়স থেকেই কাজ করেন কৃষি জমিতে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি মজুরি বৈষম্যের শিকার। এখন ধান রোপণ বা কাটার কাজ না থাকায় তিনি একটি নার্সারিতে দিনমজুরের কাজ করেন। যেখানে পুরুষ শ্রমিকরা পান দৈনিক ৩০০ টাকা, সেখানে নিরাসি টুডু পান ২৫০ টাকা। পেটের দায়ে এই বৈষম্য মেনে নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে তাকে।

একই এলাকার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সরস্বতী মুর্মু পড়েন মহাডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনিও একই নার্সারিতে কাজ করেন।

তিনি বলেন, ‘যখন কাজ পাওয়া যায় তখন কাজ করি। নারী শ্রমিকদের ২৫০ টাকা আর পুরুষ শ্রমিকদের ৩০০ টাকা করে দৈনিক মজুরি দেওয়া হয়। কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচের পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগিতা করি। সমান কাজ করলেও নারীদের মজুরী কম দেওয়া হয়।’

বিলবৈলঠা গ্রামের মালতি মুর্মু (৬০) জমিতে কাজ করেন প্রায় পাঁচ দশক ধরে। তিনি শুরু থেকেই এই বৈষম্য দেখে আসছেন।

তিনি বলেন, ‘কোনো উপায় না থাকায় বাধ্য হয়েই জীবিকার প্রয়োজনে আমাদের অন্যের জমিতে কাজ করতে হয়। এখন কাজ কম। বিভিন্ন বাগান ও নার্সারিতে কর্মরত নারীদের দেওয়া হচ্ছে ২৫০ টাকা করে, যেখানে পুরুষ শ্রমিকরা পাচ্ছেন ৩০০ টাকা। ধান রোপণ ও কাটার সময় নারী শ্রমিকরা পায় ৩০০ টাকা আর পুরুষ শ্রমিকরা পায় ৪০০ টাকা। সমান কাজ করলেও আমরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত।’

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার শান্তিপাড়ার আলামনি টুডু (৪৫) কাজ করেন মসুর ডালের ক্ষেতে। তিনি জানান, মসুর কাটার কাজ করে দৈনিক ২৫০ টাকা পান। পুরুষের চেয়ে ৫০ টাকা কম পেলেও কিছু করার নেই। অভাবের কারণে বাধ্য হয়েই তাকে কাজ করতে হয়।

বিলবৈলঠা গ্রামে নার্সারির মালিক আবুল কাসেম বলেন, ‘নারীরা কৃষিকাজে বেশ পারদর্শী। তারা চারা লাগানোর পর তা ভালো করে পরিচর্যা করতে পারেন। এখানে এটাই প্রচলিত, তাই পুরুষরা পায় ৩০০ টাকা এবং নারীরা পায় ২৫০ টাকা।’

Chapainawabganj-2.jpg
কৃষি জমিতে সমান কাজ করলেও নারীদের মজুরি পেতে হয় পুরুষের চেয়ে কম। ছবি: স্টার

শুধু কোল সম্প্রদায়ের নারীরা নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আশপাশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাঁওতাল, ওঁরাওসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের নারীরা দশকের পর দশক ধরে এই মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন। সমান শ্রম দিলেও পুরুষের চেয়ে দৈনিক ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত কম পারিশ্রমিক পান। এই নারীরা বৈষম্যের কথা জেনেও অভাবের কারণে বাধ্য হয়েই কাজ করেন।

বিলবৈলঠা আদিবাসী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সারদা রানী হাসদা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বিলবৈলঠা, চটিগ্রাম, চাত্রা, ফিল্ডিপাড়া ও বৈলঠা গ্রামে প্রায় ৩০০ এবং রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাবুডাইং ও শান্তিপাড়া গ্রামে প্রায় ২০০ কোল পরিবার বসবাস করে। প্রায় সব নারী শ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করেন। দীর্ঘদিন থেকেই তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার। সংশ্লিষ্টদের এই বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি হিংগু মুর্মু বলেন, ‘জেলায় সাঁওতাল, ওরাঁও ও কোলসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রায় এক লাখ মানুষ চাঁপাইনবাবগঞ্জে বসবাস করেন। এই সব সম্প্রদায়ের নারীরা জমিতে কাজ করেন, তারা কাজে ফাঁকি দেন না এবং দক্ষ। তারপরও নারী শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। এটা অবিলম্বে দূর হওয়া উচিত এবং লিঙ্গ বৈষম্যও দুর করা উচিত।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাহিদা আখতার বলেন, ‘লিঙ্গ বৈষম্য না কমলে মজুরি বৈষম্যও কমবে না। নারীরা অনেক এগিয়েছে। তবে, মজুরি বৈষম্য এখন আগের চেয়ে অনেক কমেছে। সরকারও নারী অধিকারের বিষয়ে সচেতন। আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে মজুরি বৈষম্য কমবে।’

জাতিসংঘ ও ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ হিসাবে ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ প্রথম জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। এর দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে অফিসিয়ালি জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে দিবসটির স্বীকৃতি দেয়।

Comments