বিপন্ন বুনো খরগোশ
বুনো খরগোশ, লম্ফঝম্ফ করে বলে একে কেউ কেউ লাফারুও বলে। খুব সাবধানী প্রাণী। দ্রুতগতিতে লাফিয়ে চলতে পারে। লাজুক এই প্রাণীটি মানুষ এমনকি অন্য প্রাণীর কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে। বসবাস করে গর্তে। দিন দিন ঝোপ-জঙ্গল কমে যাওয়ায় বিরল ও বিপন্ন প্রাণীটি হারাচ্ছে আবাসস্থল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মত সারাদেশে ঝোপ-জঙ্গল কমে যাওয়ায় এদের আবাসস্থলও সংকুচিত হয়ে আসছে। দ্রুত সংখ্যায় কমছে। এ ছাড়া, একশ্রেণীর মানুষ শিকার করার কারণেও এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অথচ এই প্রাণীটি পরিবেশে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাবুডাইং অসমতল, ছোট ছোট টিলায় আছে বিভিন্ন গাছ, ঝোপ-জঙ্গল ও গর্ত। সেখানে এখনো কিছু খরগোশ প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে।
Indian hare, Black-naped hare বা Rufous-tailed hare এর ইংরেজি নাম। Leporidae পরিবারের এই সদস্যের বৈজ্ঞানিক নাম Lepus nigricollis (F.Cuvier.1823)। বুনো খরগোশ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়।
এর রং ধূসর বাদামী, এ কারণেই এরা খুব সহজেই নিজেকে অন্য প্রাণীদের মধ্য থেকে আড়াল করতে পারে। দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার ও লেজ ১০ সেন্টিমিটার। ওজন দেড় থেকে ৭ কেজি। কান লম্বায় প্রায় ১৩ সেন্টিমিটার ও চোখ বড়। স্ত্রীর থেকে পুরুষ লম্বা হয়। ঘণ্টায় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে এরা দৌড়াতে সক্ষম। এরা ঘাস, পাতা, কন্দ, ফল খায়। বর্ষাকালে ঝোপ-জঙ্গল বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের খুব সহজেই আড়াল করে রাখে। খাদ্যেরও তেমন অভাব হয় না। তবে শুষ্ক মৌসুমে এদের একটু সমস্যা হয়।
এরা একা, জোড়ায় বা দল বেধেও থাকে। দিন দিন ঝোপ-জঙ্গল কমে যাওয়ায় বিরল ও বিপন্ন প্রাণীটি হারাচ্ছে আবাসস্থল।
এই প্রতিবেদকের সৌভাগ্য হয়েছে কয়েকবার বুনো খরগোশ দেখার। তিনি সর্বশেষ একটি বুনো খরগোশ দেখতে পান এ বছর ৫ ফেব্রুয়ারি। ওই খরগোশটি দেখে একদল শিশু-কিশোর প্রাণীটিকে তাড়া করলে সে প্রাণ ভয়ে ছুটে পালায়, এই প্রতিবেদকের পাশ দিয়ে চলে যায়। এত দ্রুত যায় যে ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। তাড়া খেয়ে খুব দ্রুত পালিয়ে আশ্রয় নেয় কোন গর্তে বা ঝোপে। আর দেখা মেলেনি। কয়েকবার দেখা মিললেও মাত্র একবার ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল বুনো খরগোশের ছবি তুলতে সক্ষম হন তিনি।
শিশু-কিশোররা দেখলেই এদের তাড়া করে। এ ছাড়া, শিকার করার কারণে খুব দ্রুত কমছে এদের সংখ্যা। তাছাড়া বাবুডাইং বনভূমির ঝোপ-জঙ্গল কেটে ফেলায় এদের আবাসস্থলও পড়েছে মারাত্মক সংকটের মধ্যে। এই অবস্থা চলতে থাকলে একসময় বাবুডাইং এলাকা থেকে বুনো খরগোশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বাবুডাইং জেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে এবং রাজধানী ঢাকা থেকে জেলা শহরের দূরত্ব ৩১৩ কিলোমিটার, সেই হিসেবে রাজধানী থেকে এর দূরত্ব ৩২৩ কিলোমিটার।
বাবুডাইং প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কিছু টিলাভূমির সংমিশ্রণ। এই টিলাভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় ছড়িয়ে আছে। মূলত গোদাগাড়ী উপজেলার বাবুডাইং মৌজার নামে এলাকাটি বাবুডাইং নামে পরিচিত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার অংশে বাবুডাইং এলাকাটি ঝিলিম ইউনিয়নের বিলবৈলঠা ও চটিগ্রাম মৌজায় অবস্থিত এবং গোদাগাড়ী উপজেলার অংশে মোহনপুর ইউনিয়নের বাবুডাইং, ঝিকড়া, বাংধারা মৌজায় অবস্থিত। ছোট ছোট টিলাভূমি ও প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা বিভিন্ন ধরণের গাছপালার সমন্বয়ে এ এলাকাটি নৈসর্গিক সৌন্দর্য ধারণ করেছে। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও টিলা দেখার জন্য অনেক দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। নানা প্রজাতির পাখি, প্রাণী ও উদ্ভিদ আছে বাবুডাইংয়ে।
এ ছাড়াও, বাবুডাইংয়ের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অংশের বিভিন্ন দিকে সবকয়টি গ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোল সম্প্রদায়ের বসবাস।
বাবুডাইংয়ের পার্শ্ববর্তী বিলবৈলঠা গ্রামের বিলবৈলঠা আদিবাসী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সারদা রানী হাসদা বলেন, ‘আগে প্রায় বুনো খরগোশ দেখা যেত। ঝোপ-জঙ্গল কমে যাওয়ায় আবাসন সংকটের কারণে এরা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।’
স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য নেচার’র অন্যতম সমন্বয়ক ফয়সাল মাহমুদ বলেন, ‘আবাসন সংকট, শিকার এবং ক্রমশ একশ্রেণীর ভূমিদস্যূর কারণে বাবুডাইং বনভূমি ছোট হয়ে আসায় বন্যপ্রাণী, পাখি ও উদ্ভিদ কমে যাচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। সংশ্লিষ্ট বিভাগ এটিকে রক্ষায় এগিয়ে না আসলে এর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। তাই আমরা বাবুডাইংকে বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম করার দাবি জানিয়ে আসছি।’
Comments