স্বাধীনতাই একমাত্র গন্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের: মওলানা ভাসানী

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণের পরই যেন স্বাধীনতার দাবিতে তীব্র হাওয়া লাগল দেশজুড়ে। এর প্রমাণ অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে ৯ মার্চ পল্টনে জনসমুদ্রে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দেওয়া ভাষণ।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণের পরই যেন স্বাধীনতার দাবিতে তীব্র হাওয়া লাগল দেশজুড়ে। এর প্রমাণ অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে ৯ মার্চ পল্টনে জনসমুদ্রে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দেওয়া ভাষণ।

৯ মার্চ পল্টনে ভাষণ দিতে সরাসরি টাঙ্গাইলের সন্তোষ থেকে ঢাকা আসেন মওলানা ভাসানী। বঙ্গবন্ধুই তাকে ফোন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফোনে আলোচনার পরে দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন। বিকেলে পল্টন ময়দানের ভাষণে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী স্পষ্টতই জানিয়ে দেন ‘স্বাধীনতাই একমাত্র গন্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের।’

যেমন তিনি বক্তব্যের এক পর্যায়ে বললেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে গেলে ১৯৪০ এর লাহোর প্রস্তাবনার পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে এদেশে। অচিরেই পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবে। ইংরেজ স্বাধীনতা দিয়েও যেমন কমনওয়েলথ রেখেছে বাংলাদেশের সঙ্গেও পাকিস্তানের সেই সম্পর্ক থাকবে।’

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে তুমুল করতালির মধ্যে মওলানা ভাসানী বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে। পাকিস্তান অখণ্ড রাখব না। ইয়াহিয়া সাহেব, অনেক হয়েছে আর নয়। তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। লা কুম দ্বীনিকুম অলিয়াদ্বীনের মতো (তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার) পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। ইয়াহিয়া, তোমার বাপের ক্ষমতা নেই ঠেকায়। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের ভালো চাও তাহলে কালই বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও।’

বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থা রাখতে জনগণ ও নিজ দলের নেতা-কর্মীদের অনুরোধ করেন মওলানা ভাসানী। তিনি বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেন, ‘কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে শেখ মুজিবুর রহমান আপস করতে পারে। খামাখা কেউ মুজিবকে অবিশ্বাস করবেন না।’

‘শেখ মুজিব আমার ছেলের মতো, সে আপনাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। বাঙালিরা আপনারা সবাই শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা রাখেন। শেখ মুজিবুরকে আমি ভালোভাবে চিনি। তাকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছি। শেখ মুজিবকে আমি আমার তিন পুত্রের চেয়েও ভালোবাসি। মুজিবুরের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবুরের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলব।’

মওলানা ভাসানী পাকিস্তান সরকারের প্রতি তীব্র হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘জালেমের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা নাই। যে জুলুম করে সে যেমন পাপী যে জুলুম সহ্য করে সেও তেমনি পাপী। কামানের গোলাকে বাঙালি ভয় করে না। বাঙালির হাতে তীর-ধনুক, দা, কুড়াল, বল্লম আছে। আমি সহিংসতায় বিশ্বাসী না।’

পল্টনের একই জনসভায় আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আপনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘোষণা করুন। আপনার হাতে ক্ষমতা। এই ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র চলছে।’

এদিন সকালে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের বাঙালি কর্মকর্তারা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে লেফট্যানেন্ট টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান ঢাকা হাইকোর্টের সব বিচারক।

৯ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। যেসব অফিস বঙ্গবন্ধু খোলা রাখার আদেশ দিয়েছিলেন কেবল সেসব সরকারি অফিস নির্দিষ্ট সময় খোলা রাখা হয়। অন্যান্য অফিস-আদালত, সরকারি ও আধা সরকারি অফিসে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হয়। ব্যাংক, দোকানপাট, হাটবাজার খোলা থাকে। বাড়িতে, অফিসে কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়।

সরকারি বিবৃতিতে এদিন জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসছেন।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় এক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য অনুরোধের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রসভায় স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সেই বৈঠকে পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশনের আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামের পরিবর্তে শুধু ছাত্রলীগ নাম ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে মুক্তি আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে অর্থ দেবেন বলে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়।

এদিকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি তাদের একটি প্রচারপত্রে বলে, ‘কিছু কমিউনিস্ট পার্টি এখনো জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তারা বলছে ধর্মঘট ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। আবার কোনো কোনো নেতা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে বলে ধ্বনি তুলে চলমান গণসংগ্রামের উদ্দীপনা ও সংকল্পে ভাটা এনে দেওয়ার চেষ্টা করছে।’

৯ মার্চ রাজশাহীতে রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারফিউর ঘোষণা করা হয়। রাজশাহীতে কারফিউ ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ এক বিবৃতিতে বলে, ‘সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উসকানি ছাড়া আর কিছুই নয়।’ অবিলম্বে রাজশাহীর কারফিউ প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে।

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি দেশকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য আবেদন জানান।

অন্যদিকে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাহারের জন্য ঢাকায় জাতিসংঘের উপআবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। এছাড়া জাপানের পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশে অবস্থিত তাদের দেশের নাগরিকদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। একই সিদ্ধান্ত নিয়ে পশ্চিম জার্মানি জানায়, তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠাবে। অন্যদিকে করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান জানান, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য শিগগির ঢাকা যাবেন।

তথ্যসূত্র:

দিনপঞ্জি একাত্তর- মাহমুদ হাসান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ২য় খণ্ড।

৭১ এর দশ মাস- রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী

১০ মার্চ ১৯৭১, দৈনিক ইত্তেফাক।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago