অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটাই কি অন্যায়!

চাকরিজীবনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাদের বেশিরভাগই চাকরিজীবনে পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটাই অন্যায়!
Gov Official.jpg
(বাম থেকে) সারোয়ার আলম, মুনীর চৌধুরী, মাহবুব কবির মিলন ও মোহাম্মদ ইউসুফ। ছবি: সংগৃহীত

চাকরিজীবনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাদের বেশিরভাগই চাকরিজীবনে পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটাই অন্যায়!

নিজের ফেসবুকে এই কথাগুলো লিখেছিলেন বিসিএসের ২৭তম ব্যাচের প্রশাসনের কর্মকর্তা সারোয়ার আলম। প্রচণ্ড হতাশা বা মন খারাপ থেকেই হয়তো তিনি কথাগুলো লিখেছিলেন। মন খারাপের কারণ- প্রশাসনের উপ-সচিব পদে বিশাল বড় পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। ব্যাচের প্রায় সবার পদোন্নতি হলেও তার হয়নি।

অথচ ২৭তম ব্যাচের প্রশাসনের যে কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের সততা ও কাজ দিয়ে দেশবাসীর ভালোবাসা পেয়েছিলেন, সারোয়ার আলম নিশ্চয়ই তাদের শীর্ষে থাকবেন। র‌্যাবের সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রায় তিনশ অভিযানে ছিলেন তিনি। সবসময় মানুষের জন্য কথা বলেছেন। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেছেন এমন কোনো অভিযোগ কখনো ওঠেনি। অথচ ব্যাচের ২৪০ জন পদোন্নতি পেলেও দেশবাসীর কাছে দারুণ সৎ বলে পরিচিত সারোয়ার আলমের পদোন্নতি হয়নি।

একজন সৎ মানবিক কর্মকর্তা, যিনি সারাক্ষণ দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করছেন, তাকে যদি পদোন্নতি না দেওয়া হয়, তার মনোবলের কী অবস্থা হয়? বিষয়টা তো শুধু তার একার নয়। যারা আসলেই সৎভাবে কাজ করতে চায়, কী বার্তা পায় তারা? 

কেন সারোয়ার আলমের পদোন্নতি হলো না? ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে কর্মরত আছেন, তার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় অভিযোগ নেই, বরং নানা সাহসী অভিযানের কারণে বিভিন্ন সময় প্রশংসা কুড়িয়েছেন যারা, যারা প্রশাসন ক্যাডারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন, তিনি তেমনি একজন কর্মকর্তা। এমন নয় যে পদ কম ছিল, বরং ওই ব্যাচের প্রায় সবার পদোন্নতি হয়েছে, এমনকি অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও উপ-সচিব হয়েছেন। অথচ মেধা কোটায় চাকরি পেয়ে সামনের দিকে সিরিয়াল থাকলেও সারোয়ার আলমকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। অথচ তারপরের ১৫০ জনেরও বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। 

এই পদোন্নতি বঞ্চিত করা তো এক অর্থে পরিষ্কার বার্তা যে,  সততার দাম নেই। অন্যদের মতো স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও। শুধু কি সারোয়ার আলম? প্রশাসনের অধিকাংশ সৎ কর্মকর্তাকে বোধহয় একই ধরনের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই যেমন অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী।

এই দেশের প্রশাসনের অসাধারণ কিছু সৎ কর্মকর্তার নাম জানতে চাইলে বলতে হবে মুনীর চৌধুরীর নাম। যখন যেখানে গিয়েছেন, দারুণ সাহসের সঙ্গে দেশসেবা করেছেন। চট্টগ্রাম বন্দর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, মিল্ক ভিটা ও ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষে দায়িত্ব পালনের সময় তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ভূমি সম্পদ উদ্ধার ও রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়। ডিপিডিসির স্পেশাল টাস্কফোর্স প্রধান হিসেবে রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জে দুই কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ চুরি ধরেন তিনি। আদায় করেন প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে কোকোর মালিকানাধীন লঞ্চকে তিনি বিএনপি আমলেই জরিমানা করেন। বাদ পড়েনি যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর জাহাজও। বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের প্রতিষ্ঠান ও জাহাজকেও তিনি জরিমানা করেছেন। তার একক ভূমিকায় চট্টগ্রাম বন্দরে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও জাহাজ চলাচলে বেপরোয়া দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা কমে আসে। তার নেতৃত্বে পরিবেশ দূষণ-বিরোধী অভিযানে ৭০ শতাংশ দূষণকারী শিল্প-কারখানায় ইটিপি স্থাপিত হয়, উদ্ধার হয় ৭০০ একর কৃষিজমি ও উপকূলীয় বনভূমি। পরিবেশ অপরাধীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় ১২৩ কোটি টাকা জরিমানা।

২০১৬ সালে তাকে যখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক ও সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের প্রধান করা হয়, অনেকেই দারুণ আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে পরে তাকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এই বদলির পরে দুদক বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স অ্যাগেইনস্ট করাপশন (র‌্যাক) এক বিবৃতিতে বলেছিল, দুদকে যোগ দিয়ে ঘুষ নেওয়ার সময় হাতেনাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার, সরকারের ভূমি উদ্ধার, প্রভাবশালীদের কাছ থেকে সরকারি গাড়ি উদ্ধারসহ বেশ কিছু কাজ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন তিনি। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে নিভৃতেই তিনি দুর্নীতিবিরোধী কাজ করছিলেন। এই বদলির ফলে দুদকের সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে।

মুনীর চৌধুরীর আরেক ব্যাচমেট মাহবুব কবির মিলনের অবস্থাটা দেখুন? কর্মজীবনে অত্যন্ত সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত মিলন। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ভেজাল ও নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছিলেন তিনি।  রেলওয়েতে যোগ দিয়ে দুর্নীতি বন্ধ এবং ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে বেশকিছু উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। বিশেষ করে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া ট্রেনের টিকিট কাটা যাবে না’ এবং ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’-এ নিয়ম প্রবর্তন করেন তিনি। রেলওয়ের নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধেও নিজে ভূমিকা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন আলোচিত এই অতিরিক্ত সচিব।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন মাহবুব কবির। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালে একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথায় কথায় বলেছিলেন, ১০ জন সৎ কর্মকর্তা নিয়ে একটি উইং গঠন করে তিন মাসের মধ্যে দেশের সব খাতের দুর্নীতি দূর করতে চান।

মাহবুব কবির বলেছিলেন, ‘আমি যদি প্রধানমন্ত্রীকে পেতাম তবে বলতাম, স্যার আমাকে ১০ জন অফিসার দিন। মানুষের চোখের পানি দূর করার জন্য সব মন্ত্রণালয়, সব দপ্তর, সব অধিদপ্তরের বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করব আমরা এই ১০ জন। কেউ যদি বলে আমরা দুর্নীতি দূর করতে পারব না, কেউ যদি বলে সিন্ডিকেট ভাঙা যায় না, আমি ওটারই চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি- আমার তিন মাস সময়ই যথেষ্ট, যেকোনো ডিপার্টমেন্টের সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য।’

রাষ্ট্রের উচিত ছিল তাকে এই চ্যালেঞ্জ নিতে সহায়তা করা। ব্যর্থ হলে হয়তো ব্যবস্থা নেওয়া যেত! তিনটা মাসই তো! কিন্তু তার ইচ্ছা তো পূরণ হয়নি, এই কথা বলার পর এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। সেই মামলায় দণ্ড হিসাবে তাকে ‘তিরস্কার’ করে ১ মার্চ প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

কী বার্তা আসলে গেল? আপনি ঘুষ খান-দুর্নীতি করেন, তাতে পার পেয়ে যেতে পারেন কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে বললেই জুটবে তিরস্কার। সিন্ডিকেট ভাঙতে চান, পদে পদে বিপদে পড়বেন। এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফের কথা মনে আছে? একা একটা মানুষ বিমানবন্দরের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। বিমানবন্দরের সব অসৎ লোকজনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। প্রবাসীদের নানা সংকটের সমাধান করেছেন। মানুষের হয়রানি ও দুর্ভোগ দূর করতে নিরন্তর কাজ করেছিলেন। পরিণতি? তাকে বদলি করতে নানা তদবির হয় এবং একসময় সত্যি সত্যি বদলি করা হয়। 

সারোয়ার আলম, মুনীর চৌধুরী, মাহবুব কবির মিলন কিংবা মোহাম্মদ ইউসুফের মতো ঘটনা নিশ্চয়ই আরও আছে, যারা সততার সঙ্গে কাজ করেও যথাযথ পুরস্কার পাননি। তাদের ভেতরে যে কষ্ট, তার চেয়েও বেশি সংকট যারা আসলেই এভাবে সৎ থাকতে চান তারা কী বার্তা পান?

ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। পাঁচ-ছয় বছর আগে সরকারের এক মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ এক দায়িত্বে ছিলেন। সেসময়ের ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় একটি চক্র দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেছিল। যে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই দুর্নীতির নেতৃত্ব দানের অভিযোগ ছিল, পরে দেখি যথাসময়ে তিনি পদোন্নতি পান। অথচ যখন যেখানে তিনি কাজ করতে গিয়েছেন, সেখানেই বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। দুদকে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ছিল। অথচ তিনি বার বার পুরস্কার পেয়েছেন। আর আর ওই দুর্নীতি বন্ধের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার ছিলেন, তাদের কেউ এখন জাদুঘরে, আবার কারো কারো বিরুদ্ধে নানা ট্যাগ লেগেছে। বেশ কয়েকজনের পদোন্নতিও হয়নি। উল্টোদিকে অনিয়মের অভিযোগে শুধু পুরস্কার জুটেছে তাই নয়, ক্ষমতাশালী এমন একজন কর্মকর্তাকে শুদ্ধাচার পুরস্কারও পেতে দেখেছি।

প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটা ঘটনা বলি। ২৪ বিসিএসের এক কর্মকর্তাকে সরকারের এমন একটা দপ্তরে বদলি করা হয়েছিল, যেখানে আর্থিক অনিয়ম চলছিল এবং প্রায় সবাই সেটা মেনে নিয়েছিলেন। তিনি সেখানে যোগ দেওয়ার পর ওই দপ্তর শৃঙ্খলায় ফেরে এবং ওই বছর সরকারি সেই দপ্তর লোকসানের বদলে লাভ করে। ওই কর্মকর্তাকে তখন তিরস্কার করা হয়েছিল- কেন এই লাভ হলো? কারণ সরকারি দপ্তরের এই লাভের কারণে নাকি অনেকের ব্যক্তিগত লাভ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

মাঝে মাঝে অবাক লাগে, কষ্টও। যে দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার হয়, যেখানে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, সবাই যেখানে স্রোতে গা ভাসান, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে নানাভাবে নিজের ঘনিষ্ঠতা প্রমাণের চেষ্টা করেন, সেখানে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন প্রশাসনে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন সাহসের সঙ্গে, বিনিময়ে কখনো জোটে তিরস্কার আবার কখনো পদোন্নতি বঞ্চিত হতে হয়।

এসবের মধ্য দিয়ে আসলে কী বার্তা যায়? একজন কর্মকর্তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইলে কেন তাকে তিরস্কৃত হতে হবে? কেন সততার সঙ্গে কাজ করার পরেও পদোন্নতি হবে না? এভাবে চললে ভবিষ্যতে কোন পথে যাবে বাংলাদেশ? রাষ্ট্র ও নীতি নির্ধারকদের কাছে অনুরোধ, সৎ ও যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কৃত করুন। মূল্যায়ন করুন। তাদের কাজের সুযোগ দিন। ভালো কাজের মূল্যায়ন না হলে ভবিষ্যতে ভালো কাজ করার আগ্রহ হারাতে পারেন অনেকে। আর এমন প্রশ্নও তখন উঠবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটাই কি অন্যায়!

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Abantika: A victim of institutional neglect

The universities also didn't organise any awareness activities regarding where and how to file complaints.

4h ago