‘মহামারি কবে শেষ, আরও ২ বছর অপেক্ষা করতে হবে’

ডা. ফরহাদ আলী খান।

মহামারি করোনাভাইরাস কবে পৃথিবী থেকে চিরতরে নির্মূল হবে, তা জানতে আরও অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল চিকিৎসক ও সুইডেনের অ্যাস্ট্রাজেনেকার মহামারি বিষয়ক পরিচালক ডা. ফরহাদ আলী খান।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের মহামারি শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে দুইটি দিক আছে। সামাজিক ও জৈবিক। মহামারির এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, মানুষ এটিকে নতুন স্বাভাবিক জীবন হিসেবে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে এটি প্রতিরোধে গবেষক-বিজ্ঞানীরা ওষুধ, চিকিৎসা, ভ্যাকসিনসহ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডা. ফরহাদ। তিনি বলেন, ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা এক সময় মহামারি ছিল। কিন্তু, এখন এটা স্থানীয় রোগে পরিণত হয়েছে।’

‘জৈবিকভাবে, মহামারি তখনই শেষ হয় যখন একদল মানুষ এতে সংক্রমিত হলে তাদের শরীরে ইমিউনিটি তৈরি হয় এবং বাকিদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এই দুই দল মিলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে সহায়তা করে। যেহেতু ইতোমধ্যে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ভ্যাকসনি দেওয়ার কমূর্সচি চলমান, তাই আমরা আশা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।’

জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিশ্বব্যাপী ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা কোভিড-১৯’র ভ্যাকসিন অনুমোদন দিয়েছে বলে জানান তিনি।

‘ভ্যাকসিন কতদিন সুরক্ষা দেবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। কারণ, যেহেতু এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যউপাত্তগুলো চূড়ান্ত নয় এবং ট্রায়ালও চলমান। সাধারণত ভ্যাকসিন সর্বনিম্ন ১২ মাসের সুরক্ষা দিয়ে থাকে বলে আশা করা হয়।’

বাংলাদেশে মহামারি করোনা মোকাবিলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদিও করোনা মোকাবিলায় সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে, তবে, প্রাথমিকভাবে পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা ও সম্মুখসারির যোদ্ধাদের সুরক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ও ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু ঝামেলা পরিলক্ষিত হয়েছিল। তবে, ধীরে ধীরে সব সরকাররের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় মহামারিটি বাংলাদেশে কম বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমৃদ্ধ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ সুন্দরভাবে মহামারি মোকাবিলা করছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেশি হবে বলে আশঙ্কা ছিল। কিন্তু, ভাগ্যক্রমে সরকারের সময়োপযোগী বিভিন্ন উদ্যোগে তা কম ছিল।’

‘ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও উৎপাদন বিজ্ঞানের একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশ সবসময় এর সঙ্গে আপডেট ছিল। অল্প সময়েই ভ্যাকসিন এনে কার্যক্রম পরিচালনা করা দেশের জন্যে অনেক বড় একটি অর্জন। তিনটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো করেছে। সেগুলো হলো— প্রতিরোধ, রোগী ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা এবং টিকাদান।’

এই ফার্মাসিউটিক্যাল চিকিৎসক বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের জন্যেই মহামারি কিছু শিক্ষা এনেছে। এটি স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা উন্মোচন করেছে এবং স্বাস্থ্য খাত যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝিয়েছে।’

‘এই মহামারি সব খাতকেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের সুবিধাগুলো পুনর্গঠন, রোগ নজরদারি ও পর্যবেক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশন এবং ভ্যাকসিন উত্পাদন সুবিধাগুলোর উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। ভবিষ্যতে মহামারি প্রতিরোধে বাংলাদেশের কিছু স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।’

ডা. ফরহাদ আলী বলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু বিশ্বমানের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রয়েছে, তাই এখন উচিত হবে নতুন ওষুধ নিয়ে গবেষণা ও তা আবিষ্কার করা।’

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের উচিত প্রাথমিক পর্যায়ে লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা এবং সরকারের উচিত ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পকে সহায়তা করা।’

‘স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমরা বেশিরভাগ জনগণের জন্যে ভ্যাকসিন সংগ্রহের দক্ষতা অর্জন করেছি। কিন্তু, এখন আমাদের উচিত নিজ দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করা। এটি কোনো কঠিন কাজ নয়। মহামারি আমাদের জন্যে একটি সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে। আমাদের উচিত ভ্যাকসিন উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করা।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্থানীয় অনেক ওষুধ কোম্পানি এখন মূলত জেনেরিক পণ্য উত্পাদন করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের উত্পাদন ব্যাপকভাবে বাড়তে দেখা গেছে এবং বাজারে সামগ্রিকভাবে পাওয়া ওষুধের ৯০ শতাংশেরও বেশি তাদের উৎপাদিত। আমাদের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি বিশ্বমানের। বেশ কয়েকটি গবেষণা সংস্থা ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকোয়েন্সিং করলেও আমরা তাদেরকে গবেষণার পরবর্তী স্তরে যেতে সহায়তা করতে পারিনি। এখন আমাদের উচিত এক্ষেত্রে মনোনিবেশ করা, যাতে গবেষণার পরবর্তী স্তরে যাওয়া যায়।’

ডা. ফরহাদ বলেন, ‘যদি ভারত ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশেরও পারা উচিত। কারণ, বাংলাদেশে বৃহৎ দক্ষ জনবল ও অবকাঠামো আছে।’

‘ওষুধ আবিষ্কার বিষয়ক গবেষণাকে আমাদের পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে হবে। ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের সেই সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, সেই সম্ভাবনাকে আমাদের বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হবে। তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের ট্রায়ালে বাংলাদেশের অংশ নেওয়া উচিত। এখনই নতুন কিছু উদ্ভাবনের উত্তম সময়।’

এই মহামারি বিশেষজ্ঞের মতে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে গবেষণা করার পরিকল্পনা তৈরির যথার্থ সময় এখনই।

তিনি জানান, ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়ার অংশ হতে পেরে একজন বাংলাদেশি হিসেবে তিনি গর্বিত।

‘এটা আমার ক্যারিয়ারের জন্যে একটি বড় মাইলফলক। বিশ্বের এই সংকট কাটাতে অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছি; জনজীবন, মহামারি ও ফার্মাসিউটিক্যাল বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার ২৫ বছরেরর বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে ও সর্বোপরি একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি সন্তুষ্টি’, যোগ করেন ডা. ফরহাদ আলী খান।

আরও পড়ুন:

দেশে করোনার সংক্রমণ আবার বাড়ছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের

যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইন দেশে শনাক্ত: ‘দেরিতে জানিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি’

শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী: সতর্কতার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের

করোনার নতুন স্ট্রেইন: করছি কী, করণীয় কী

Comments

The Daily Star  | English

HC clears way for Ishraque’s oath as DSCC mayor

“If they don’t administer the oath, a contempt of court proceedings will be initiated against them"

42m ago