পটুয়াখালীতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ চিংড়ির প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে। সেখানে নেই কোনো কর্ম উপযোগী পরিবেশ। এছাড়া, নামমাত্র মজুরিতে শিশু ও নারীদের কাজ করানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে।
দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ করা হচ্ছে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ। ছবি: স্টার

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ চিংড়ির প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে। সেখানে নেই কোনো কর্ম উপযোগী পরিবেশ। এছাড়া, নামমাত্র মজুরিতে শিশু ও নারীদের কাজ করানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে।

চিংড়ির মাথা আলাদা করছেন শিশু ও নারী শ্রমিকরা। ছবি: স্টার

অভিযোগ আছে, পুরুষ শ্রমিকরা দৈনিক ছয়শ থেকে আটশ টাকা মজুরি পেলেও শিশু ও নারী শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে কেজি প্রতি দশ টাকা। এতে তারা দৈনিক ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা মজুরি পাচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এই চার মাসে বঙ্গোপসাগরের অগভীর অংশে প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি মাছ ধরা পড়ে। এ সময়ে জেলেরা চিংড়ি ধরতে বিশেষ জাল নিয়ে সাগরে মাছ শিকারে যায়। মাছ শিকারের পরে ট্রলারগুলো রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের দাড়ছিড়া নদীর তীরে তুলাতলীতে নোঙর করা হয়। সেখানে অপেক্ষারত কয়েকশ শিশু, নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা চিংড়ির মাথা হাত দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে। এরপর মাথাবিহীন চিংড়ি ট্রলারে নিয়ে যাওয়া হয় পটুয়াখালী, বরগুনা ও খুলনার বিভিন্ন আড়তে। সেখানে প্যাকেটজাত হয়ে সেগুলো পাঠানো হয় ভারতসহ কিছু দেশে।

ট্রলার থেকে মাছ নামানো ও ওঠানোর কাজ পুরুষ শ্রমিকরা করলেও মাছের মাথা বিচ্ছিন্নের কাজ করে শিশু ও নারীরা। এতে প্রতি কেজি মাছের বিপরীতে তারা পান মাত্র ১০ টাকা।

এই সস্তা শ্রমের কারণেই ট্রলারগুলো সাগর থেকে সরাসরি এখানে আসে এবং মাছ প্রসেস করে চলে যায় গন্তব্যে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে তিন শতাধিক শ্রমিক কাজ করলেও তাদের জন্য নেই কোনো ছাউনি, শৌচাগার, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য সম্মত পদ্ধতি। শ্রমিকরা খোলা আকাশের নিচে রোদে, বর্ষায় ভিজে, নগ্ন হাতে এ কাজ করেন। ফলে, মাছের কাটার খোঁচা লেগে অনেকের হাতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।

এখানকার একজন নারী শ্রমিক শোভা রানী (৫২)। তার স্বামী শেখর দাস বছরখানেক আগে মারা গেছেন। ছেলে দিনমজুরের কাজ করে। টানাপোড়নের সংসার তার। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া নাতনি তিথিকে নিয়ে মাছ প্রসেসের কাজ করছেন। তুলাতলী গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে প্রতিদিন তিনি নাতনিকে নিয়ে কাজে আসেন এবং সংসারে বাড়তি আয়ের যোগান দেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমরা চিংড়ি মাছের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার কাজ করি। এসময় হাতে মাছের কাঁটার খোঁচা লাগে এবং ‘ক্ষত’ হয়। অনেক কষ্ট হয় কাজটি করতে। এক কেজি মাছ প্রসেস করতে পারলে ১০ টাকা মজুরি মেলে। এভাবে প্রতিদিন দেড়শ থেকে আড়াইশ টাকা মজুরি পাই।’

সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে কয়েকশ নারী এবং তাদের অনেকের সঙ্গে আসা শিশুরা খোলা আকাশের নিচে বসে চিংড়ি মাছ বাছাই করছেন। দুপুর ১২টার মধ্যে ১৫ থেকে ১৬টি ট্রলার সাগর থেকে মাছ ধরে দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে নোঙর করেছে। এর আগেই নারী শ্রমিকরা সারিবদ্ধভাবে খোলা মাঠে বসে পড়েন। পুরুষ শ্রমিকরা ট্রলার থেকে মাছ তীরে ফেলে দিচ্ছে, আর নারীরা তা বাছাই করছেন।

এসময় নারী শ্রমিকরা দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতাকে মজুরি বৈষম্যের অভিযোগ করেন।

অপর নারী শ্রমিক জামাল মাঝি গ্রামের ফাতেমা আক্তার (৪০) বলেন, ‘পুরুষদের দৈনিক মজুরি ছয়শ থেকে আটশ টাকা। অথচ নারীদের এক কেজিতে ১০ টাকা। এতে দিনে ১৫ থকে ২৫ কেজি মাছ প্রসেস করা যায়। এতে ১৫০ টাকা থেকে বেশি হলে ২৫০ টাকা পাওয়া যায়।’

তেলীপাড়া গ্রামের সাফিয়া বেগম (৫৫) বলেন, ‘দুই বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছেন। দুই সন্তান নিয়ে সংসার চলে না। তাই এখানে শ্রমিকের কাজ করি। এখানকার নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি সময় কাজ করে। কাজের মধ্যে পুরুষেরা বিশ্রামের সুযোগ পেলেও নারীরা সুযোগ পান না। কিন্তু, পুরুষ শ্রমিকরা যে মজুরি পায়, আমরা পাই তার অর্ধেক টাকা।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পটুয়াখালী জেলা শাখার সভাপতি শোভা রানী রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘একজন নারী শ্রমিক শ্রম দিতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেন। তারপরও নারী শ্রমিকেরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়াও, নারীদের জন্য শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।’

মাছ ধরার ট্রলারের মাঝি খালেক ঘরামি জানান, প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি ট্রলার মাছ নিয়ে এখানে আসে। এসব মাছের বেশিরভাগ খুলনাতে বিক্রি হয়। কিছু মাছ ঢাকায় পাঠানো হয়। রপ্তানির জন্যই মাছের মাথা ফেলে দিতে হয়। মাছ বাছাইয়ের কাজটি নারীরা ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারে। এখানে নারীদের মজুরি কম তাই সাগর থেকে মাছ ধরে সরাসরি এখানে নিয়ে আসা হয়। প্রতিটি ট্রলার ৩০ মণ থেকে ৫০ মণ পর্যন্ত চিংড়ি থাকে।

রাঙ্গাবালীর খালগোড়া এলাকার মদীনা মৎস্য আড়তের মালিক রেজাউল করিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এখানে নারীদের মজুরি কম তাই জেলেরা মাছের ট্রলার দাড়ছিড়া নদীর তীরে নিয়ে আসে। প্রসেসিং শেষে এখানকার মাছ বরফ দিয়ে খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রসেস করা প্রতিমণ মাছ সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা দরে কিনে খুলনার ব্যবসায়ীরা নয় হাজার থেকে দশ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেন।’

এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্ল্যাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এগুলো সামুদ্রিক

মাছ। দেশ থেকে বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৯০ ভাগই বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি মাছ। আর এই মাছ অগভীর সাগরসহ উপকূলীয় এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন স্থানে চিংড়ির মাথা কেটে বাছাইয়ের কাজ চলছে। নারী শ্রমিকদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজটি করতে হচ্ছে। যেসব স্থানে মাছ বাছাইয়ের কাজ চলছে তা চিহ্নিত করে সেখানে পাকা শেড নির্মাণ, পৃথক শৌচাগার, সুপেয় পানির ব্যবস্থার পাশাপাশি নারীদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শিশু-নারীসহ সবার জন্য শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠবে।’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago