শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ ও বিদ্বেষ তাড়া করছে এশীয়-আমেরিকানদের
করোনা মহামারির সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে এশীয়দের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষমূলক অপরাধ প্রায় দেড় শ শতাংশ বেড়েছে বলে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ আটলান্টার তিনটি স্পা সেন্টারে হামলা, যেখানে নিহত হয়েছেন আট নারী, যাদের ছয় জনই এশিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রে এশীয়-আমেরিকানদের প্রতি বিদ্বেষের বিশ্লেষণ উঠে এসেছে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে।
ওই বিশ্লেষণে স্টিফেন কলিনসন দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এশীয় মার্কিনিদের তাড়া করে ফিরছে বর্ণবিদ্বেষের মতো ভীতিকর এক অবস্থা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আটলান্টার স্পা সেন্টার হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই ঘটনার পেছনে বর্ণবাদী অনুপ্রেরণার কথা স্বীকার করুক বা না করুক, তাতে কিছুই যায় আসে না। জাতিগত বিদ্বেষ, সহিংসতা ও ঘৃণামূলক কথাবার্তার মধ্যে মাসের পর মাস আতঙ্ক নিয়ে পার করছেন এশীয়-আমেরিকানরা।
আগে থেকেই অন্যায়ভাবে ঘৃণা বা বিদ্বেষের মুখোমুখি থাকা এশীয়-আমেরিকানদের ওপর হামলার এই ঘটনা আরও দিশেহারা ও আতঙ্কিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ ও অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার এই সময়ে যখন এশীয়দের ওপর আক্রমণ ও নিগ্রহের ঘটনাও বাড়ছে, তখন এমন হত্যাকাণ্ড আমেরিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণাকেই দেশের বাকিদের সামনে তুলে নিয়ে এসেছে।
জাতীয় ব্যক্তিত্বদের বিপজ্জনক ও জাতিগত বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য অনেক এশীয়-আমেরিকানকে কষ্ট দিয়েছে। যাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি চার বছর ধরে ক্রমবর্ধমান বর্ণবাদী অসহিষ্ণুতার মাঝে দেশ চালিয়েছেন এবং প্রায়ই বিভাজনকে ব্যবহার করেছেন নিজের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে।
বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেন, এশীয়-আমেরিকান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের মানুষদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মনে যে সুপ্ত ঘৃণা ছিল, তা জাগিয়ে তোলে কোভিড-১৯ সংক্রমণ এবং তা আরও বাড়িয়ে তোলে ট্রাম্পের ‘চায়না ভাইরাস’র মতো বিভিন্ন অযৌক্তিক উক্তি।
জর্জিয়া রাজ্যের ডেমোক্রেট প্রতিনিধি বি নগুয়েন সিএনএনকে বলছিলেন, ‘এসব গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচণ্ড রকম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর পেছনে গতবছরের বিদ্বেষমূলক আক্রমণগুলোই শুধু দায়ী এমন নয়, বরং মহামারি বিষয়ে সাবেক প্রেসিডেন্টের বিদ্বেষমূলক বক্তব্যগুলোও বড় একটি কারণ। যুক্তরাষ্ট্রে এশীয়-আমেরিকানদের ওপর সহিংসতার অনেক ইতিহাস রয়েছে। অনেকেরই বাবা-মা, তাদের বাবা-মা ও পূর্বপুরুষের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে।’
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব হেট অ্যান্ড এক্সট্রিমিজের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা মহামারির সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে এশীয়দের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষমূলক অপরাধ প্রায় দেড় শ শতাংশ বেড়েছে।
খ্যাতনামা বাস্কেটবল খেলোয়াড় জেরেমি লিন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনে খেলা খুব অল্প কয়েকজন এশীয়-আমেরিকানের অন্যতম, সিএনএনকে জানিয়েছেন, তরুণ বয়সে তিনি এমন নিগ্রহের ঘটনার শিকার হয়েছেন। এটি এখন আরও বেশি বেশি হচ্ছে।
‘এখন ব্যাপারটিকে পুরোই অন্যরকম মনে হয়। আমরা বড় হতে হতে দেখলাম, বিষয়টি প্রতিনিয়তই আগের চেয়ে বেশি প্রকাশ্য হচ্ছে। এখন আরও বেশি সহিংসতা দেখা যাচ্ছে। শারীরিক নির্যাতনও বেড়েছে, ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনাও। বাইরে কিংবা বাজারে গেলে এখন অনেকে এশীয়-আমেরিকান আতঙ্ক নিয়ে বারবার পেছনে ফিরে তাকান’, বলেন লিন।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী হুমকি
মঙ্গলবার স্পা সেন্টারে হামলার ঘটনা এশিয়ান-আমেরিকানদেরকে ভয় আর অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এশিয়ান প্যাসিফিক উইমেনস ফোরামের ন্যাশনাল ফিল্ড ডিরেক্টর ভিভিয়েন সোউ।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেজান্দ্রো মেয়োর্কাস আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদ দেশবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। তবে, সোউ মনে করেন, এটি এশীয়-আমেরিকানদের জন্য নতুন কোনো বিপদ নয়। বরং এরা সেই একই গোষ্ঠী, ব্ল্যাক আমেরিকানরা যাদের নিগ্রহের শিকার, এরাই গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে হামলা চালিয়েছে।
‘যদিও আমরা এখন এশীয় বিদ্বেষ নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছি, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ থেকেই আসলে যার উৎপত্তি, আর যে কেউ এর শিকার হতে পারে’, বলেন সোউ। বিষয়টিকে সবাই মিলে মোকাবিলার কথাও বলেন তিনি।
বড় পরিসরে দেখতে গেলে, এশীয়-আমেরিকানদের এই অগ্নিপরীক্ষা শুধু বর্ণগত হয়েই থাকেনি। এই সংকটের আরও নতুন দিকও আছে, যেমন দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত সংকট, রিপাবলিকান ভোটারদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা, কোভিড-১৯ টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য, এসব ঘটনা কোনো না কোনোভাবে জাতিগত হয়ে উঠেছে এবং এগুলো আমেরিকার সংখ্যালঘুদের মনোকষ্টকেই ফুটিয়ে তোলে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা খুব কম সময়ই পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারবেন।
কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিনের বিচারকাজ পরিচালনার জন্য বুধবার একজন সম্ভাব্য জুরিকে প্রশ্ন করা হয়, তার ব্যক্তিগত কোনো চিন্তাধারা আছে কি না, যার কারণে বিচারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় আমি প্রতিদিনই বর্ণবাদের শিকার হই’। এ কথা বলার পর তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যদিও তিনি বারবার বলছিলেন যে, তিনি নিরপেক্ষ রায় দিতে পারবেন।
এ সংলাপ কেবল মামলার মূল জায়গাকেই পরিষ্কার করেনি, সমাজের গভীর সংকটের দিককেও সামনে নিয়ে এসেছে। মার্কিন বিচার ব্যবস্থা কি একজন কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার ন্যায়বিচার দিতে পারবে নাকি একজন শ্বেতাঙ্গ অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার সুষ্ঠু বিচার করবে? এ ঘটনা মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জাতিগত বর্ণবাদ হিসেবে দেখলেও, অন্যান্য মার্কিনিরা মর্মান্তিক কোনো ঘটনা কিংবা জাতীয় বিপর্যয়েই তা টের পান।
আটলান্টার মেয়র, ডেমোক্র্যাট নেতা কেইশা লান্স বটমস সিএনএনকে বলেন, ‘সময় এসেছে আমাদের এশীয় আমেরিকানদের পাশে দাঁড়ানোর। তারা অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছেন এবং আমরা দেখেছি আটলান্টায় ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে গেছে।’
ট্রাম্পের দায় কতটুকু?
ট্রাম্প কখনো কখনো শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সমালোচনা করতে অস্বীকার করেছেন এবং ক্রমশ বাড়তে থাকা বর্ণবাদী সহিংসতার জন্য তার সমর্থকেরাও অনেকাংশে দায়ী বলে অভিযোগ আছে। মঙ্গলবারের ওই হামলার পর আবারও ট্রাম্প সমর্থকদের নিয়ে সমালোচনা উঠে এসেছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেটিক প্রতিনিধি জুডি চু সিএনএনকে জানান, ট্রাম্পের তৈরি করা হিস্টিরিয়া আজ সব সম্প্রদায়ের জন্যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
‘মহামারির শুরু থেকেই তিনি করোনাভাইরাসকে “চায়না ভাইরাস” ডেকে এসেছেন। আজ এশীয় বিদ্বেষের মতো অপরাধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার এটিও একটি কারণ’, বলেন চু।
যুক্তরাষ্ট্রে এশীয়-আমেরিকানদের প্রতি নিগ্রহ ও বিদ্বেষের কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসটিকে নিদিষ্ট কোনো ভৌগলিক অঞ্চল কিংবা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত না করতে আহ্বান জানিয়েছিল।
ট্রাম্প এখন আর প্রেসিডেন্ট নেই, কিন্তু তারপরও রিপাবলিকান পার্টি তার রেখে যাওয়া বর্ণবাদী চিন্তাধারাকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারেনি। তারা এখনো সুযোগ পেলে আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় যে বহিরাগতরা, বিশেষ করে যাদের গায়ের রঙ ভিন্ন, শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের সংস্কৃতির জন্য তারা হুমকি।
স্বীকৃতি চান বর্ণবাদের শিকাররা
এশীয়-আমেরিকান, বিশেষ করে কমিউনিটির বয়স্ক সদস্যদের ওপর গত এক বছর ধরে নেমে আসা নানা ধরনের সহিংসতার ঘটনায় অনেকেই ঘর ছেড়ে বের হতে ভয় পাচ্ছেন এবং তাদের নিজ পরিবারের গণ্ডি ছেড়ে দূরে যেতে চাইছেন না। অনেককেই মৌখিকভাবে অপদস্থ করা হয়েছে এবং কোভিড-১৯’র বাহক হিসেবে দায়ী করা হয়েছে। বাস্কেটবল তারকা লিনকে খেলার মাঠে ‘করোনাভাইরাস’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বয়স্ক এশীয়-আমেরিকানদের প্রতি নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে বলে সিএনএনের বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
জর্জিয়ার স্পা সেন্টারে হামলার ঘটনায়, সেখানকার এশীয়-আমেরিকান কমিউনিটি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বলে জানিয়েছেন এশিয়ান আমেরিকান অ্যাকশন ফান্ড জর্জিয়া চ্যাপ্টারের উপদেষ্টা ক্রিস্টোফার চ্যান।
‘এশীয়-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে এসব সহিংস ও বর্ণবাদী অপরাধের দিকে সবাই দৃষ্টি দিক’, বলেন তিনি।
জর্জিয়ায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় রবার্ট আরন লং (২১) নামে একজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু, পুলিশ জানিয়েছে তারা নিশ্চিত হতে পারছে না যে এ অপরাধের পেছনের উদ্দেশ্য কী হতে পারে।
আটলান্টার মেয়র বটমস সিএনএনকে বলেছিলেন, যা পরিস্থিতি তাতে অভিযুক্ত হত্যাকারীর দেওয়া বিবৃতি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
সোউ এর মতে, কেবল বর্ণবাদ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জেন্ডারও। এশীয় নারীরা এই মহামারির মাঝেও নিজেদের চেষ্টায় স্বাধীনভাবে উপার্জন করছে, এই ব্যাপারটিকেও সবাই ভালো চোখে দেখেননি। এটিও তাদেরকে হত্যা করার পেছনের কারণ হতে পারে।
Comments