ফেসবুক আইডি নেই কৃষক জামানের, তবুও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার আসামি
কৃষক আবু জামান লেখাপড়ায় পঞ্চম শ্রেণি পার করতে পারেননি। নিজের কোনো ফেসবুক আইডি নেই। জানেন না স্মার্টফোনের ব্যবহারও। অথচ অন্যের ফেসবুক আইডিতে করা পোস্ট বলে দেওয়ার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার পর থেকে দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে স্ত্রী-সন্তান রেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের কৃষক আবু জামান (৪৫)।
পরিবারের দাবি, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র ও ভুক্তভোগীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আবু জামান। তার কোনো ফেসবুক আইডি নেই। নিজের কোনো স্মার্টফোন নেই। এমনকি স্মার্টফোনের ব্যবহারও তিনি জানেন না। লেখাপড়ায় পঞ্চম শ্রেণিও পার করতে পারেননি। অথচ জমি-সংক্রান্ত বিরোধে ‘অন্যের ফেসবুক স্ট্যাটাস বলে দেওয়া’র অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি পরিবারের।
একই এলাকার মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মো. মিজানুর রহমান শিকদার (৪৩) বাদী হয়ে গত বছরের ১৯ অক্টোবর আবু জামানের বিরুদ্ধে কটিয়াদী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি দায়ের করেন। আবু জামান এ মামলার দুই নম্বর আসামি। মামলায় এক নাম্বার আসামি করা হয়েছে একই এলাকার আলা উদ্দিনের ছেলে আল আমিনকে (২৫)।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ২০০২ সালে জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কৃষক আবু জামানের বিরুদ্ধে বর্তমান ডিজিটাল আইনে দায়ের করা মামলার বাদী মিজানুর রহমান শিকদারের বাবা গিয়াস উদ্দিন মামলা করেন। সেই থেকে আবু জামানের সঙ্গে বিরোধ চলে আসছে মিজান পরিবারের। আবু জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের আগেও তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, চুরি-ডাকাতিসহ চারটি মামলা করেছিল মিজানের পরিবার। একটি পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে অভিযোগ গেলে সালিশ করা হয়। তখন বসতভিটা ফিরে পান জামান। সর্বশেষ জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দায়ের করলেন মিজান। মিজানের বর্তমান বাড়ি কটিয়াদী হওয়ায় গত বছরের ১৯ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কটিয়াদী থানায় মামলাটি করেন তিনি। তবে, বাদী মিজানের মূল বাড়ি কৃষক আবু জামানের বাড়ির পাশে। মামলা দায়েরের পাঁচ মাস হলেও আদালতে অভিযোগপত্র দেয়নি পুলিশ। থেমে আছে মামলার তদন্তকাজ। বর্তমানে আতঙ্কে দিন পার করছেন কৃষক আবু জামান ও তার পরিবারের সদস্যরা।
আসামি আবু জামান টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত ২০ বছর ধরে জমি সংক্রান্ত বিরোধে মিজানের পরিবার মামলা করে আমাকে হয়রানি করে আসছে। সর্বশেষ “মিজানের মৃত বাবার বিরুদ্ধে ফেসবুকে কুৎসা রটানো”র অভিযোগে এনে আমার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলাটি কী, কোর্ট কোথায়, সে বিষয়েই আমি কিছুই জানি না। আমার কোনো ফেসবুক আইডি বা স্মার্টফোন নেই। এমনকি আমি স্মার্টফোনের ব্যবহারও জানি না। বাদীর বাবার বিরুদ্ধে ফেসবুকে কুৎসা রটিয়ে স্ট্যাটাস লিখতে যাকে সহায়তার কথা বলা হয়েছে, সেই আল আমিনের সঙ্গেও আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘মামলার ভয়ে আমি এখন পরিবার-পরিজন রেখে এদিক-সেদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এ মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি’, বলেন তিনি।
মামলার বাদী মিজানুর রহমান শিকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার বাবা মারা যাওয়ার পর চায়ের স্টলসহ বিভিন্ন জায়গায় বসে তার বিরুদ্ধে নানা খারাপ ও মানহানিকর মন্তব্যসহ কুৎসা রটান কৃষক আবু জামান। আর মামলার এক নম্বর আসামি আল-আমিন বসে বসে সেগুলো ফেসবুকে পোস্ট করেন। এজন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আবু জামানকেও দুই নম্বর আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর ইকবাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার আসামি আবু জামান বিদেশফেরত ব্যক্তি। তিনি দেশে এসে কৃষি কাজের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। আমি এ বিষয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি, তা হলো, আবু জামান সরাসরি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার সঙ্গে জড়িত না থাকলে জন সাধারণের কাছে মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন। তাই হয়তো তাকে মামলার আসামি করা হয়েছে। তবে, মামলার বাদীপক্ষের সঙ্গে আসামি আবু জামানের পূর্ব বিরোধ ছিল বলে আমি লোকমুখে শুনেছি।’
এ বিষয়ে কটিয়াদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম শাহাদত হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আবু জামান কৃষক মানুষ। তিনি ফেসবুক চালাতে পারেন না, এটা আমরা শুনেছি। তাই মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। কৃষক এ মামলায় জড়িত না থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে মামলার অভিযোগপত্র থেকে তাকে বাদ দিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মাশরুকুর রহমান খালেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মামলার আলামত সংগ্রহ করে সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে এবং এ মামলায় আবু জামান জড়িত কি না, তদন্ত করা হবে। যদি জড়িত না থাকে, তাহলে তিনি মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন। পাশাপাশি মিথ্যা মামলা দিয়ে যদি হয়রানি করা হয়, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে মামলার বাদীর বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
Comments