সরেজমিন শাল্লা: প্রধান আসামি স্বাধীন যুবলীগ না হেফাজত

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় গ্রামবাসীর পক্ষে দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি পাশের দিরাই উপজেলার নাচনি গ্রামের বাসিন্দা ও সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শহিদুল ইসলাম স্বাধীন।
ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম স্বাধীন।

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় গ্রামবাসীর পক্ষে দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি পাশের দিরাই উপজেলার নাচনি গ্রামের বাসিন্দা ও সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শহিদুল ইসলাম স্বাধীন।

গত শুক্রবার গ্রেপ্তারের হওয়া স্বাধীন যুবলীগের নেতা এবং যুবলীগের ওয়ার্ড সভাপতি হিসেবে জানা গেলেও সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে তা অস্বীকার করেছে।

একইভাবে স্বাধীন হেফাজতে ইসলামের কেউ নন বলেও দাবি করেছে দিরাই উপজেলা হেফাজতের নেতৃবৃন্দ।

তবে স্বাধীনের চাচা ও নাচনি গ্রামের বাসিন্দা জানফর আলী বলেন, ‘সে [স্বাধীন] আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে, ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি।’

গ্রামের আরেক প্রবীণ বাসিন্দা আবুল হাশেমও বলেন, ‘যতদুর জানি সে আওয়ামী লীগের লোক।’

স্বাধীনের ভাতিজি লিমা আক্তার বলেন, ‘তিনি [স্বাধীন] যতদিন রাজনীতি করেছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন, ৮-১০ বছর ধরে যুবলীগ করেন, ইউনিয়ন সভাপতি। মোশাররফ [দিরাই পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান], রঞ্জন [দিরাই যুবলীগ সভাপতি] সবাই তাকে চিনেন।’

সরমঙ্গল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্বাধীন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা, সরমঙ্গল ৯নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ছিলেন বলে জানি।’ তিনি স্বাধীনকে কখনো হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ বা কোনো অনুষ্ঠানে দেখেননি বলেও জানান তিনি।

হামলাকারীদের আঘাতে আহত ঝুমন দাশের স্ত্রী সুইটি চন্দ্র দাশের বাম হাত গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছেন চিকিৎসক। পেছনে বিছানায় তার ছয় মাসের শিশু। ছবি: দ্বোহা চৌধুরী

স্বাধীনের পরিবারের সদস্যদেরও দাবি স্বাধীন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত না এমনকি নোয়াগাঁওয়ে হামলার দুদিন আগে দিরাইতে আয়োজিত হেফাজতের সমাবেশেও যাননি স্বাধীন।

যা বলছে যুবলীগ-আওয়ামী লীগ

সুনামগঞ্জ যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা চপল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দিরাইতে যুবলীগের কোনো কমিটি নেই এবং স্বাধীন যুবলীগের কেউ না। কেউ নিজে থেকে দাবি করলেই যুবলীগ নেতা হতে পারে না।’

স্বাধীন গ্রেপ্তার হওয়ার দিনই সুনামগঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করে যুবলীগ। সংগঠনটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় স্বাধীন যুবলীগের কেউ না।

তাদের ভাষ্য— ২০০৭ সালে দিরাইয়ে রঞ্জন রায়কে আহ্বায়ক করে উপজেলা কমিটি করা হয়েছিল এবং ২০১৫ সালে কেবলমাত্র রঞ্জন রায়কে সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়নি।

যেখানে উপজেলাতে ২০০৭ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই, সেখানে ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড কমিটি থাকার প্রশ্নই নেই বলে সম্মেলনে জানান যুবলীগ আহ্বায়ক চপল।

পরিবারের সদস্যরা দিরাই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র মোশাররফ মিয়া ও দিরাই উপজেলা যুবলীগ সভাপতি রঞ্জন রায়ের সঙ্গে স্বাধীনের ঘনিষ্টতার দাবি করলেও তারা তা অস্বীকার করেন।

রঞ্জন রায় বলেন ‘যুবলীগে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক আছে। অনেকেই তো আসে। নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না স্বাধীন কখনো এসেছেন কি না।’

মোশাররফ মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সরমঙ্গল পৌরসভার পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন এবং স্বাধীনকে আমি এই ইউনিয়নের মেম্বার হিসেবেই চিনি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে স্বাধীন সম্পৃক্ত না, কোনো কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাও না। সে সমর্থক হলে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়, আমার জানা নেই।’

ছবি: দ্বোহা চৌধুরী

স্বাধীন হেফাজতেরও কেউ না

নোয়াগাঁওয়ে হামলর দুদিন আগে ১৫ মার্চ দিরাই উপজেলায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক সমাবেশে অংশ নেন।

মামুনুল হককে নিয়ে পরদিন নোয়াগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাশ আপনের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে নোয়াগাঁওয়ে সেই রাতে এবং তার পরদিন [১৭ মার্চ] সকালে হেফাজত সমর্থকরা নোয়াগাঁওয়ের পাশের ধারাইন বাজারে সমাবেশ করেন।

হামলার দিন সকালে সমাবেশ চলাকালীন সমাবেশের একাংশ গ্রামের অপর প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৯০টি বাড়িঘর ও সাতটি মন্দির ভাংচুর করে এবং ব্যাপক লুটপাট চালায়।

হেফাজতে ইসলামের দিরাই উপজেলার সহ-সভাপতি মাওলানা নুর উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্বাধীন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কোনভাবেই সংযুক্ত না এবং এই হামলা বা তার আগের সমাবেশ হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে না জানিয়ে স্থানীয়রা আয়োজন করে।’

তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামকে ব্যবহার করে কেউ ব্যক্তিগত সুযোগ নিয়ে লুটপাট চালাতে হামলা করেছে।’

দিরাইয়ে আওয়ামী লীগ-হেফাজতে মিলেমিশেই আছে

নোয়াগাঁওয়ে হামলার দুইদিন আগে দিরাইয়ে আয়োজিত হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে হওয়া সমাবেশে সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন দিরাই উপজেলা ও পৌরসভার আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতৃবৃন্দ।

সেই মঞ্চ থেকে বক্তব্য দেন দিরাই পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ রায়। সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দলের নেতৃত্ব দেন পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল মিয়া।

এমনকি সমাবেশের আগে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আজিজুল ইসলাম বুলবুলকে নিয়ে প্রস্তুতি সভাও করে হেফাজতে ইসলাম। তিনি এ সমাবেশের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাও করেন বলে জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ।

হেফাজতের দিরাই উপজেলা সহ-সভাপতি নুর উদ্দিন বলেন, ‘হেফাজত রাজনৈতিক সংগঠন না। সব রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গেই আমাদের সদ্ভাব রয়েছে এবং আমরা মিলেমিশেই আছি। আমাদের সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন।’

এ ব্যাপারে জানতে দিরাই পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি বিশ্বজিৎ রায় এবং পৌর যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক জুয়েল মিয়ার মোবাইলে আজ সন্ধ্যার পর একাধিকবার যোগাযোগ করলে তারা কেউ কল রিসিভ করেননি। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আজিজুল ইসলাম বুলবুল হেফাজতের সমাবেশের আগেই বিদেশে যাওয়ায় তার সাথেও যোগাযোগ করা যায়নি।

আরও পড়ুন: 

সরেজমিন: শাল্লায় যা ঘটেছিল

শাল্লায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হামলার প্রধান আসামি ইউপি সদস্য শহীদুল গ্রেপ্তার

শাল্লায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হামলা: গ্রেপ্তার ২২

হেফাজত নেতা মামুনুলকে গ্রেপ্তারের দাবি

সুনামগঞ্জে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হেফাজত সমর্থকদের হামলা

শাল্লায় হিন্দুদের বাড়িতে হামলার ঘটনায় মামলা

‘আওয়ামী লীগে কি সাম্প্রদায়িক লোকজন ঢুকে গেছে?’, প্রশ্ন ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতির

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago