বাংলাদেশের ৫০ বছর: শূন্য কোষাগার থেকে আশা আর এগিয়ে যাওয়ার গল্প

BD.jpg
গতকাল গণহত্যা দিবস স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে এক মা ও তার সন্তানের আলোক প্রজ্জ্বালন। ছবি: আনিসুর রহমান

নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যখন নতুন যাত্রা শুরু হয় তখন রাষ্ট্রীয় কোষাগার একেবারেই শূন্য ছিল। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ, ভঙ্গুর অবকাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সেনা অভ্যুত্থানের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশকের চিত্রটি একেবারেই ছিল হতাশাজনক।

আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ শুধু নিজের পায়েই দাঁড়ায়নি, বরং উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত হতে পেরেছে।

কিন্তু শুরুতে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। নৈরাশ্যবাদীরা বিশ্বাস করতেন যে, এই দেশ বেঁচে থাকবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দয়ার ওপর। নিশ্চিত ব্যর্থতার ফর্মুলা হিসেবে তারা খনিজ পদার্থের অভাব, উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, খাদ্য সংকট ও সামান্য পরিমাণ রপ্তানির মত বিষয়গুলোর দিকেই শুধু নজর দিয়েছিলেন।

পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি জাস্ট ফালান্ড (১৯৭২-১৯৭৪) ও বিশ্ব ব্যাংক মিশনের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জ্যাক আর পার্কিনসন বাংলাদেশেকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘যদি বাংলাদেশ উন্নয়নে সফল হতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে বিশ্বের যেকোনো দেশেরই উন্নয়ন হওয়া সম্ভব।’

বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা তিন শতাংশ থেকে কমে গিয়ে এক শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্যের হার সত্তরের দশকে যা প্রায় ৮২ শতাংশ  ছিল,২০২০ সালে মহামারির আগে এটি নেমে দাড়ায় ২০ শতাংশের নিচে।

পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশ তার সাড়ে সাত কোটি জনগণের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেয়েছে। আজ জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের বেশী হলেও দেশ খাদ্য উৎপাদনে ও আভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।

খাদ্যসামগ্রীর দামও আওতার মধ্যেই রয়েছে।

বৈদেশিক অনুদানের ওপর নির্ভরশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সত্তরের দশকে জিডিপির ১৪ শতাংশ থেকে নেমে আজ তা দেড় শতাংশেরও কম।

মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর, যা পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানের থেকে অনেক বেশি। মানুষ এখন তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছে ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সক্ষমতাও আছে।

সরকারের নীতিগত সহায়তায় বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে তৈরি পোশাকের মূল সরবরাহকারী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের প্রধান ব্র্যান্ডগুলো এখানেই তাদের পণ্য তৈরি করে। এককভাবে এ শিল্প থেকে বছরে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার আসে এবং কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, যাদের সিংহভাগই নারী।

অর্থনীতির আরেকটি মূল চাবিকাঠি হলো মানবসম্পদ রপ্তানি। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি নাগরিক নিজেদের ভাগ্য অন্বেষণে দেশের বাইরে বাস করছেন।

যেসব দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে, সে দেশগুলোতে কাজ করে তারা প্রতি বছর প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছেন এবং এর পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। তাদের কঠোর পরিশ্রমের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক বেড়ে গেছে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য এক কোটিরও বেশি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার কারণে মিয়ানমার থেকে অত্যাচারের ভয়ে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে পারছে। 

এ পর্যন্ত দুবার স্বল্পোন্নত দেশ থেকে পরের ধাপে উন্নীত হবার তিনটি শর্তই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির সুপারিশ অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে।

২০২০ সালে, মহামারির মধ্যে যে অল্প কয়েকটি দেশে ইতিবাচকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

মার্কিন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিকোলাস ক্রিস্টোফারের মতে, বাংলাদেশের এই সাফল্যের মূলে রয়েছে শিক্ষা ও নারীর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া। 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ তার স্বল্প পরিমাণ সম্পদ বিনিয়োগ করেছে তাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর এবং বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক ও কম উপার্জনক্ষমদের ওপর, কেননা সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যায়।’

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে টাকা ছাপানোর মেশিনটিও ছিল না। বামপন্থী ব্লকের সঙ্গে মিত্রতার কারণে নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খুব একটা সুবিধার ছিল না।

সারা বিশ্বজুড়ে চলমান সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পরে আর বড় আকারের কোনো খাদ্য সংকট দেখা দেয়নি। ‘এটি একটি বড় অর্জন’, বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেনের মতে, দেশের অর্থনীতি সংক্রান্ত চিন্তাধারার একটি বড় পরিবর্তন আসে ৮০ ও ৯০ এর দশকে। সেসময় ৭০ দশকের জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক নীতিমালার অবস্থান থেকে সরে এসে বেসরকারি খাতের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়। নতুন এ চিন্তাধারায় উদারীকরণ নীতি, বিরাষ্ট্রীকরণ ও অতি নিয়ন্ত্রণমুলক নিয়মনীতি শিথিল করার মতো বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সাবেক আমলা এবং সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের একজন এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ সব পূর্বাভাষকে ভুল প্রমাণ করেছে এবং দ্রুত উন্নতি করেছে।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জানান, সব সরকারই কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে, যাতে কমতে থাকা ফসলী জমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাড়তে থাকা জনসংখ্যার জন্য খাবারের যোগান দেওয়া যায়। এই খাতটি দেশের অর্থনীতিকে প্রয়োজনীয় স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের আওতাধীন জেনারেল ইকোনোমিক ডিভিশনের সদস্য অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে দৃঢ় ও সক্রিয়। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত নীতি তাদেরকে সাহায্য করেছে।’

বিআইডিএস’র সাবেক গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত এই বিস্ময়কর ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে কারণ হিসেবে সরকারি ব্যয় ও বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ‘সব দেশই এটি করে। তবে আমরা সবসময় লক্ষ্যের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও মনোযোগ দিয়েছি। সরকার পল্লী অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছে। এটি অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলেছে।’

তিনি আরও জানান, দেশের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য এসেছে। ফসল চাষে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হয়েছে। কৃষি ছাড়া অন্যান্য খাতেও কার্যক্রম বেড়েছে।

তিনি জানান, ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ও এনজিওগুলো নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করেছে। সরকার রাস্তাঘাট ও সেতু স্থাপন করেছে, শ্রমবাজারকে প্রসারিত করেছে, নারীদের সুযোগ বাড়ানো হয়েছে, শিক্ষার সুযোগ দিয়েছে এবং স্বাস্থ্য খাতেও উন্নতি করতে পেরেছে।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছে।’

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসাইন দেশের নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে কারণ হিসেবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত সামাজিক নীতিমালা, পল্লী সড়ক, শিক্ষা ও বিদ্যুতায়ন, প্রাথমিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, স্থানীয়ভাবে স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি ও সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকাদান কর্মসূচি, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান, এনজিওগুলোর দেশব্যাপী পরিষেবার কথা উল্লেখ করেছেন।

বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দেওয়া নিকোলাস ক্রিস্টোফের উপদেশটিতে। ক্রিস্টোফ প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বলেন, শিশু দারিদ্র্য সমস্যা উত্তরণের জন্য তার উচিত বাংলাদেশের দিকে তাকানো।

সবশেষে এটা বলাই যায়, আজকের বাংলাদেশ থেকে সেই নৈরাশ্যবাদীরা উপযুক্ত জবাবই পেয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago