বেণী কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধের এক বিস্মৃত বীর

বরিশালের বানারীপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকাররা চালিয়েছে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, চালিয়েছে গণহত্যা। আবার এখানকার মানুষের রয়েছে প্রতিরোধের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসও। হানাদারদের বিরুদ্ধে হাইস্কুলের এক প্রধান শিক্ষক অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিলেন প্রায় দেড় শ মুক্তিযোদ্ধা।
বেণী লাল দাশগুপ্ত। ছবি: টিটু দাশ

বরিশালের বানারীপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকাররা চালিয়েছে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, চালিয়েছে গণহত্যা। আবার এখানকার মানুষের রয়েছে প্রতিরোধের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসও। হানাদারদের বিরুদ্ধে হাইস্কুলের এক প্রধান শিক্ষক অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিলেন প্রায় দেড় শ মুক্তিযোদ্ধা।

বেণী লাল দাশগুপ্ত— বানারীপাড়ায় ‘বেণী কমান্ডার’ নামে যিনি সুপরিচিত। ১৯৬৮ সালে দেড়শ বছরের পুরনো গাভা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এর আগে উজিরপুর ও গৌরনদীতেও স্কুলে ছাত্র পড়িয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে মাস্টার্স করা এই শিক্ষককে মুক্তিযুদ্ধ একবারেই পাল্টে দেয়। ১৯৭১ সালে তিনি তার শিক্ষার্থী, তরুণদের নিয়ে গঠন করেন এক বিশাল বাহিনী। তার বাহিনী হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের ত্রাস। তার তৎপরতার কারণে বরিশাল মুক্ত হবার ১১ দিন আগেই বানারীপাড়া মুক্ত হয়। প্রাণে রক্ষা পান বহু মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে ‘বেণী কমান্ডার’ এর এমন বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব থাকলেও এখন তার অবদান আর সেভাবে মূল্যায়ন হয় না। বানারীপাড়া পৌর শহরের এক ভাড়া বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় ক্ষোভ ঝরে পরে এই বীর যোদ্ধার।

‘১৯৬৮ সালে আমি গাভা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। সে সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল ছিল। আমি সে সময়ে বানারীপাড়া থানার ভাসানী ন্যাপের সভাপতি ছিলাম। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই কিছু একটা করার চিন্তা হতো। ছেলেরা আমার কাছে আসতো— কী করা যায় তাই নিয়ে ভাবনা। তখন দেয়ালে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে লেখা হলো’ স্বাধীনতার অপর নাম সংগ্রাম, সংগ্রাম’। আমি ছেলেদের বললাল সংগ্রাম এর আগে সশস্ত্র শব্দটি যোগ করে দিতে।  এর পরে ঢাকায় যখন পকিস্তানি আর্মি ম্যাসাকার শুরু করে। আমি তখন গা ঢাকা দিয়ে গাভা ও ঝালকাঠীর বর্ডারের রাজ্জাকপুরের মোসলেম মল্লিকের বাড়িতে থাকা শুরু করলাম। ছেলেরা সেখানে আসতে লাগলো, তারা তখন অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু আমি তখন অস্ত্র চালানো তো দূরে থাক অস্ত্রও দেখিনি। একদিন  গাভা গ্রামের বিল্ববাড়ি ক্যাম্পে সন্ধ্যার সময় আমার ছাত্র গৌতম চক্রবর্তীকে বললাম— এই অঞ্চলে কার কাছে অস্ত্র আছে? সে  প্রথমে সমস্যার কারণে বলতে চাইলো না। পরে সে জানায় ‘মনা ডাকাত’ এর কাছে একটি থ্রি নাট থ্রি রাইফেল আছে। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে- আমি আর গৌতম বসে আছি খাল পাড়ে। হঠাৎ দেখলাম  একটু দূরে- মনা ডাকাত  যাচ্ছে। আমার মধ্যে যেন বিদুৎ চমক হলো। আমি তাকে ডেকে আনলাম। সে স্বাভাবিক ভাবেই আসল। আমার কাছে একটি বেয়নেট থাকতো- সেটা ধরে আমি তাকে রাইফেলটি দিয়ে দেয়ার কথা বললাম। সে প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, পরে যখন বুঝল রক্ষা নাই- বলল  খালের পাশে রাইফেলটি লুকিয়ে রাখা আছে। কাদার মধ্যে থেকে রাইফেলটি তুলে আনা হলো। ৫টা গুলির একটি নষ্ট পাওয়া গেল। আমি তখনও অস্ত্র চালনা করতে পারি না। খড়ের গাদায় রাইফেলটি লুকিয়ে রাখলাম। ছেলেরা দলে দলে আসতে লাগল। আমি মনে করলাম এভাবে তো হবে না, নেতৃত্ব লাগবে। আমি তাদের বললাম আগে তোমাদের মধ্যে নেতা ঠিক করো। আমার ১২ জন শিক্ষার্থী, বন্ধু আমাকে গাভার জঙ্গলে গিয়ে নেতা নির্বাচিত করলো।’

বেণী লাল দাশগুপ্ত। ছবি: টিটু দাশ

বেণী কমান্ডার জানান, ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা বরিশালে ঢোকে, এর  কয়েকদিন পরেই সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালায় এই অঞ্চলে।

‘পাকিস্তানি আর্মিরা প্রতিদিন গানবোট নিয়ে পিরোজপুর দিয়ে বানারীপাড়া-গাভা-স্বরুপকাঠী অঞ্চলে আসে। ২ মে তারা গাভা এসে স্থানীয় আক্কাস আলী খান ও শরৎ সমদ্দারকে দিয়ে গ্রামের মানুষকে নরেরকাঠী খালপাড়ে নিয়ে আসে। পাকিস্তানী আর্মিরা এ সময় প্রচার করছিল ছবি তোলা হবে। ফলে উৎসাহের সাথেই শত শত মানুষ খালপাড়ে এসে জড়ো হয়। আমি তখন খালের ওপারে ধানখেতের মধ্যে থেকে সেনাদের তৎপরতা দেখছিলাম।  খাল পাড়ে তরুণ, যুবকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে শুরু হলো ব্রাশ ফায়ার। অধিকাংশ মানুষ খালে পড়ে গেল, দূর থেকে দেখি খালের পানি রক্তে ভেসে যাচ্ছে, মানুষের বেঁচে থাকার আর্তনাদ। মৃত মানুষ ভেসে যেতে লাগল।’

‘যুদ্ধের পরে আমরা ৭৩ জনের নাম লিপিবদ্ধ করতে পেরেছিলাম, তবে আমার ধারণা সেদিন অন্তত দেড় শ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন ধানখেতের মধ্যে আমার করার কিছু ছিল না, শুধু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এর প্রতিশোধ আমাকে নিতে হবে,’ বলেন বেণী কমান্ডার।

‘মে মাসের কোনো এক সময়ে গাভা এলাকার বুড়ির বাড়ির ক্যাম্পে হঠাৎ দুর্ঘটনায় একটি বোমা বিস্ফোরিত হলে লেদা কুন্ডু নামে একজন গুরুতর আহত হয়। তার চোখ নষ্ট হলেও প্রাণে বেঁচে যায়। খবর পেয়ে সেনারা ক্যাম্প আক্রমণ করল, আমরা অস্ত্র ও বোমা নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে যাই। রায়ের হাট এসে দেখি হামলাকারী ৫০ জনের দলটিকে। আমরা উঁচু স্থানে ছিলাম। আচমকা গুলি ও বোমা ছুড়লে ওরা ভয়ে দৌড়ে একটা আম গাছের নিচে অস্ত্র রেখে ডোবার কচুরিপানার মধ্যে পালিয়ে থাকে। আমি ও আমার সাথে মন্টু নামে একজন দেখলাম গাছের নিচে ২৮টি রাইফেল। ওদের দিয়ে রাইফেল মাথায় করে নিয়ে আসি ক্যাম্পে।’

পাকিস্তান আর্মির গানবোটে গুলি করা ছাড়াও বানারীপাড়া থানা তিন বার আক্রমণ করে অবশেষে মুক্ত করি। সর্বশেষ ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করি ২৭ নভেম্বর সেদিনই বানারীপাড়া থানা মুক্ত হয়,’ যুদ্ধকালীন এই বেস কমান্ডার জানান।

মুক্তিযুদ্ধের সময়, গাভার স্কুলের পাশে বিল্ববাড়ি ক্যাম্প, বৃড়ির বাড়ি ক্যাম্প, নরেরকাঠী বেপারী বাড়ি ক্যাম্প, বানারীপাড়া আলতা গ্রামের রানী কমলার বাড়িতে তার ক্যাম্প ছিল বলে জানান তিনি।

‘এসব ক্যাম্পে প্রায় দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও শোভা, দুলালী, মনিকা ও কনিকাসহ বেশ কয়েকজন নারী যোদ্ধা ছিলেন। সম্মুখসারির যোদ্ধাদের মধ্যে মঞ্জু মোল্লা, এনায়েত, মজিবুল হক, বিমল কৃষ্ণ, হায়দার খান, মহিউদ্দিন আহম্মেদ (বীর প্রতীক), স্বর্ণ দাস, লোকমান, কাদের খান, কেশব দাস, খলিলুর রহমান ছিলেন। বিমল যুদ্ধে শহীদ হন,’ বলেন বেণী দাশগুপ্ত।

বেণী বাহিনীর অন্যতম মহিউদ্দিন আহম্মেদ (বীর প্রতীক) জানান, বাহিনীর তৎপরতার কারণে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকাররা খুব ভেতরে ঢুকতে পারেনি। সেটি যদি পারতো তাহলে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ মারা যেত।

বাহিনীর অন্যতম সদস্য মুজিবুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বেণী বাবুর এই বাহিনীই গাভা, স্বরূপকাঠী ও  ঝালকাঠীর একটি বড়ো অংশে লুটেরা, রাজাকার, মিলিশিয়া ও পাকিস্তানী আর্মিদের ওপর ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে আক্রমণ করে সরে যেত।’

বেণী লাল দাশগুপ্ত জানান, ৭৬ বছর বয়সে তার খোঁজ আর কেউ নেয় না। স্ত্রী নমিতা দাশগুপ্ত মারা গেছেন। এক ছেলে ঢাকা থাকেন। বানারীপাড়ার মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন স্বদেশ ভূমিতে।

‘আমরা ভাবছিলাম একটা সুন্দর দেশ হবে— কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয় নাই। আমরা কি এই জন্যই যুদ্ধে গেছিলাম?’— ৭৬ বছর বয়সী যুদ্ধবীরের চোখে মুখে ক্ষুব্ধতা স্পষ্ট।

Comments

The Daily Star  | English
Income tax submission

Shahnaz Rahman among top taxpayers of FY 23

The Daily Star Editor Mahfuz Anam, Prothom Alo Editor Matiur Rahman also on the list

44m ago