স্রোতের বিপরীতে লড়াই করা এক আজন্ম সংগ্রামী পথিক
তার জীবনটা ছিল আজীবন সংগ্রামের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় কুসংস্কারে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল তার। অথচ তখন থেকেই তিনি কবিতা, ছড়া আর গল্প লিখছেন। তার বাবা আবিদুর রহমান ছিলেন শিক্ষক। কিন্তু পরিবারের প্রথামত মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার মতামত অগ্রাহ্য করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো।
এই সিদ্ধান্ত কখনোই মেনে নিতে পারেননি তিনি। এরই মধ্যেই তিনি নতুন করে আবার পড়াশোনা শুরু করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিছু পারিবারিক সমস্যা ও মানসিক চাপের কারণে ফেল করলেন ম্যাট্রিকে। কিন্তু তিনি যে থামার পাত্রী নন। পরের বছরই ম্যাট্রিক পাশ করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করলেন। এরই মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেল স্বামীর সঙ্গে। ১৯৫৮ সালে তিনি চলে এলেন ঢাকায়। যোগ দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে।
১৯৫৮ সালে রোকেয়া হলের পরিচালক হলেন তিনি। কিন্তু হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য হলো তার। স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলেন সেই পদ। তখন ললনা পত্রিকায় কাজ করতেন। বিজ্ঞাপনের পোস্টে৷ কিন্তু এই চাকরি ভালো লাগল না৷ ১৯৬৯ সালে বন্ধু বান্ধব, পুরনো সহকর্মীদের থেকে টাকা ধার নিয়ে ‘শিলালিপি’ নামের একটা পত্রিকা বের করলেন। নিজেই ছিলেন সম্পাদক এবং প্রকাশক।
শিলালিপি পত্রিকা ছিল তার সন্তানের মতো, পুরাদস্তুর নেশার মতো। রাত নেই দিন নেই লেখা জোগাড়। সবকিছুই তার এই পত্রিকা। নিজের সন্তানের মতো গড়ে তুললেন। দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকরা লিখতেন শিলালিপিতে। এরই মধ্যে শুরু হলো ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান৷ তিনি আজন্ম রাজনৈতিক সচেতন। ছিল সাত রাজার ধন একমাত্র ছেলে সুমন আর পত্রিকা শিলালিপি।
গণঅভ্যুত্থানে রাস্তায় নেমে এলেন তিনি। প্রতিটি মিছিলে, রাজপথের সংগ্রামে তিনি। ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরীতে, পল্টনের জনসভায় ছেলেকে নিয়ে হাজির তিনি। রাজনীতিকে মনে করতেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। শহীদুল্লা কায়সার ও প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে ভীষণ ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও শিলালিপিতে লেখা হলো। বুদ্ধিজীবীরা তাদের মত প্রকাশ করলেন।
১৯৭১ এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর রাতে তার বাসায় আসতো স্থানীয় কজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। তারা খেতে আসত রাতে তার বাসায়। সাধ্য মতো সহযোগিতা করতেন তিনি। ফান্ড কালেকশন করতেন, অস্ত্র রাখতেন। পরিচিত, অপরিচিতদের কাছ থেকে ওষুধ, খাবার কাপড় চোপড় তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। নিজের পত্রিকা শিলালিপির খরচ বাদে যা আয় হতো সবই মুক্তিযোদ্ধাদের ফান্ডে। একসময় শিলালিপি প্রায় বন্ধই হয়ে গেল। এরপর আচমকাই বিপদ নেমে এলো শিলালিপির উপরে। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী হাশেম খানের করা এক চিত্রকর্ম প্রচ্ছদ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছিল শিলালিপিতে। এই সংখ্যা নিষিদ্ধই করে পাকিস্তানী হানাদারেরা৷ একসময় পত্রিকাটি বন্ধই হয়ে গেল। তারপর সেলিনা পারভীন পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের জন্য রাও ফরমান আলীর কাছে যাওয়ার পর মিলল নতুন করে ছাপানোর অনুমতি৷ তবে শর্ত হলো নতুন করে সাজাতে হবে৷ ওই প্রচ্ছদ ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু তিনি বিদ্রোহী৷ শিলালিপির আগস্ট সেপ্টেম্বর সংখ্যায় কোনো প্রচ্ছদ না রেখে করলেন ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে৷ এই সংখ্যায় ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের মতামত, লেখা, স্বাধীনতার পক্ষে নানা মত। এটাই কাল হয়ে দাঁড়াল তার জন্য। চোখে পড়ে গেলেন হানাদার আর রাজাকারদের। এর আগেই শিলালিপি ও তিনি কালো তালিকাভুক্ত হয়ে গেলেন।
তার পত্রিকায় একদিকে দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা লিখছেন, নিজেদের মতামত জানাচ্ছেন। চারপাশ থেকে বিজয়ের ঘ্রাণ আসছে। তিনি ভিতরে ভিতরে দারুণ উত্তেজিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পথে।
তখন তিনি থাকেন নিজের সিদ্ধেশ্বরীর ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডের (বর্তমানে শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক) বাড়িতে। তার সঙ্গে তার ছেলে সুমন, মা ও ভাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন দিন বাকি। ঢাকায় কারফিউর মধ্যে ভারতীয় বিমান থেকে আত্মসমর্পণের জন্য চিঠি ফেলা হচ্ছে।
সবাই সেদিন ছাদে বসে আছেন। ঘড়িতে তখন আনুমানিক দেড়টা বাজে। কেবল সেলিনা পারভীন তখন রান্না চুলায় চাপিয়ে ছেলে সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে বললেন, ‘যাও বাবা এবার একটু খেল, আমাকে লিখতে দাও। আমার জলদি লিখতে হবে।’
সেলিনা পারভীনদের বাসার পাশে ছিল প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমানদের বাসা। হঠাৎ তার বাড়ির সামনে ইপিআরটিসির তিনটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। ছাদ থেকে সুমন স্পষ্ট দেখতে পেল; একটি কাদামাখা মাইক্রোবাস, একটি মিলিটারি লরি ও আরেকটি মিলিটারি জিপ। কিছুক্ষণ পর বাসায় কলাপসিবল গেটে কড়া নাড়ার আওয়াজ ভেসে এলো। পাশের ফ্ল্যাটে তখন থাকেন সৈয়দ সালাউদ্দিন নামে একজন। তিনিই কলাপসিবল গেট খুলে দেন। আগতরা তাকে জিজ্ঞেস করল সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের ফ্ল্যাট কোনটা। তিনি দেখিয়ে দিলেন। এরপর সালাউদ্দিনকে ঘরে যেতে বললে তিনি চলে যান। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে সুমন ও সেলিনা পারভিনের ভাই সাহাবউদ্দিন উজির কয়েক সিঁড়ি নেমে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন কারা এসেছে। একজন তাদের দেখে ফেলেন এবং বন্দুক তাক করে বলেন, ‘হ্যান্ডস আপ’। তখন সুমন ও উজির হাত উঁচু করে নেমে আসেন। এরপর সেলিনা পারভীন দরজা খুলে আগতদের পরিচয় জানতে চান। এরপর বলেন ও হলো আমার ছেলে, আর এটা আমার ছোট ভাই। আগতরা সাহাবউদ্দিন উজিরকে দেখিয়ে বললেন, ইয়ে মুক্তি হ্যায়?
সেলিনা পারভীন কোন জবাব দিলেন না। আগতরা বলল, আমাদের সঙ্গে আপনাকে সেক্রেটারিয়েটে যেতে হবে।
সেলিনা পারভীন বলেন, আমার কাছে কোন কারফিউ পাশ নেই। আমি যেতে পারব না এখন। জবাবে আগতরা বলে আমাদের কাছে কারফিউ পাশ আছে। অসুবিধা হবে না। মাকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ছেলে সুমন সেলিনা পারভীনকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা আমিও তোমার সঙ্গে যাব। জবাবে সেলিনা পারভীন তাকে নিতে চাইলে হানাদারদের মধ্য থেকে একজন বলে, ‘বাচ্চা লোক নেহি জায়গা অন্দর মে যাও।’
এরপর সেলিনা পারভীন মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমাকে যেতে হবে না বাবা। আমি এই যাব আর আসব, ততোক্ষণ তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নাও। এরপর দেখবে আমি বাসায়।’ এটাই ছিল সেলিনা পারভীনের সঙ্গে তার ছেলের শেষ কথোপকথন।
আর ফিরে আসেননি সেলিনা পারভীন। সেলিনা পারভীন একসময় দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় লিখতেন। সেখানে কাজ করতেন ফেনীর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা। সেলিনা পারভীনের ভাই সাহাবউদ্দিন উজির ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নে। দুজনের মধ্যে প্রায়ই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হতো। সেলিনা পারভিনের বাড়ি ফেনীতে হওয়ায় চৌধুরী মুঈনুদ্দীনও সেলিনা পারভীনকে বুবু বলে ডাকতেন।
এই মুঈনুদ্দীনই হানাদারদের বাসার ঠিকানা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সাহাবউদ্দিন উজির পত্রিকায় ছবি দেখে একদিন সুমনকে বলেছিলেন, ‘বুবুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় এই লোকটিও ছিল।’
রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে সে সময় জীবিত ফিরে আসা একমাত্র ব্যক্তি দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল সেলিনা পারভীনকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের আলবদর হেডকোয়ার্টারের একটি রুমে ২০-২৫ জন লোকের সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছিল।
১৮ ডিসেম্বর শহীদ সেলিনা পারভীনের লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। দুচোখ গামছা দিয়ে বাঁধা, কোমরের গামছায় দু হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। গোটা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। নির্মম ও পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছিল তাকে৷ পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত, মুখমণ্ডল বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। চেনার উপায় নেই। তার ভাই তাকে শনাক্ত করেন পায়ে পরা সাদা মোজা দেখে।
১৯৭২ সালে ২ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘কাটাসুরের বধ্যভূমি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন অধ্যাপিকা হামিদা রহমান। তিনি লিখেছিলেন সেলিনা পারভিনের বিকৃত লাশ পড়ে থাকার বিষয়েও।
‘সামনে চেয়ে দেখি, নিচু জলাভূমির ভিতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর চোখ দুটো উপড়ানো, শূন্য কোটরে জমে আছে চাপ চাপ কালচে রক্ত। নিষ্প্রাণ পড়ে আছে দেহটা। সেখানে এক নয়, দুই নয়— একেবারে বারো/তেরোজন সুস্থ সবল মানুষ। একের পর এক শুয়ে আছে, প্রত্যেকের দেহটা মোরব্বার মতো কেঁচে ফেলা হয়েছে বেয়নেট দিয়ে। এরপর আরও একটু এগিয়ে যেতেই সামনে বড় বড় দুটো মস্ত মানুষ, নাক কাটা, কান কাটা, মুখের কাছ থেকে কে যেন খামচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে হাত-পা বাঁধা...। আর একটু এগিয়ে যেতেই বাম হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই— কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা মেয়েটি সেলিনা পারভীন, সাংবাদিক, শিলালিপির এডিটর!
যে সেলিনা পারভীন আজীবন কারো কাছে মাথা নোয়াননি, আজীবন লড়াই করে নিজের মেধায় এই দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন, যে সেলিনা পারভীন একা সব বিপদে, সব বাধা পেরিয়ে হয়ে উঠেছেন অনন্য সেই সেলিনা পারভীনকে টর্চার সেলে বিভৎস পাশবিক নির্যাতনে হত্যা করে পাকিস্তানি নরপিশাচ ও এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরেরা। আর তার নেতৃত্বে ছিল আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। মূলত তার নির্দেশেই তুলে নিয়ে বীভৎস নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় সেলিনা পারভীনকে।
একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য, একটি আধুনিক সমাজের জন্য, নারী শক্তির জন্য, মুক্তবাক আর ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য এবং নতুন ধারার সাংবাদিকতার জন্য সেলিনা পারভীনের ত্যাগ অবর্ণনীয়। তার প্রতি এই দেশের ঋণ কয়েক জন্মে শোধ হওয়ার নয়।
আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক সেলিনা পারভীনের জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তার প্রতি।
তথ্যসূত্র - শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন স্মারকগ্রন্থ/ সম্পাদনা সুমন জাহিদ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সুমন জাহিদের দেয়া সাক্ষ্য।
ভাইয়ের স্মৃতিতে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন/ ভয়েস অব আমেরিকাতে দেয়া ডা. একে এম সাহাবউদ্দিনের সাক্ষাৎকার
কাটাসুরের বধ্যভূমি/ অধ্যাপিকা হামিদা রহমান; ২ জানুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ।
আরও পড়ুন:
এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিবেটি কাঁকন হেনইঞ্চিতা
‘যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না’
Comments