‘ধর্মতলা কর্মখালি’

পাখির ধর্ম ওড়া। হর্ষ বা বিষাদে পাখি যা বলে তা সুরেলা গান হয়ে যায়। নদীর ধর্ম সাগরে বয়ে চলা। সে চলার মনমোহিনী এক ছন্দ আছে। নদীর কাছে গেলে শান্তি মেলে। ঝরনা ঝরে। লোহা আকর্ষিত হয়, চুম্বক আকর্ষণ করে। এ ধরায় সবার ধর্ম নির্ধারিত হয় নিজ নিজ কর্মে।
প্রতীকী ছবি। (সংগৃহীত)

পাখির ধর্ম ওড়া। হর্ষ বা বিষাদে পাখি যা বলে তা সুরেলা গান হয়ে যায়। নদীর ধর্ম সাগরে বয়ে চলা। সে চলার মনমোহিনী এক ছন্দ আছে। নদীর কাছে গেলে শান্তি মেলে। ঝরনা ঝরে। লোহা আকর্ষিত হয়, চুম্বক আকর্ষণ করে। এ ধরায় সবার ধর্ম নির্ধারিত হয় নিজ নিজ কর্মে।

শুধুমাত্র মানুষের বেলায় এসে ধর্মের রীতি বদলে যায়। মানুষের ধর্ম হয় মুখের কথায়। কেউ বলে আমি মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বলে আমি বৌদ্ধ। মন ও প্রাণে বুঝে বা না বুঝে ধর্মের ছাঁচে নিজেকে ফেলে। নিজের মনের আনন্দের কর্মে খুব কম মানুষের ক্ষেত্রেই তার ধর্ম বিবেচিত হয়। শান্তি মেলে এমন মানবের সন্ধান করতে যারপরনাই গলদঘর্ম হতে হয়।

যার যেটা কর্ম সেটাই তার ধর্ম, যা দাবি করা হয় তা ধর্ম নয়। লোহা যদি বলে আমি লোহা নই সোনা, তাহলে কি লোহা সোনা হয়ে যাবে? বিড়াল যদি নিজেকে বাঘ দাবি করে, তবে কেউ কি তাকে সে স্বীকৃতি দেবে? আমরা যারা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য যেকোনো ধর্মের বলে দাবি করছি, তাদের অবস্থা ভাবনার অবকাশ রাখে।

নদী যখন দুপাশের ভূমি উর্বর করতে করতে শান্তভাবে বয়ে চলে, তখন তাকে অনেকে মায়ের আসনে স্থান দেয়। আবার সাগরে যেতে যেতে নদী যখন একের পর এক জনপদ দুপায়ে মাড়ায়, তখন তাকে রাক্ষুসি ডাকে।

কেউ যদি শান্তি নষ্ট করে আর বলে তার ধর্ম ইসলাম, তাহলে হবে? ইসলাম যেখানে শান্তির নামান্তর। চারদিকে শুধু অপবিত্রতা দেখলে সে কি হিন্দু হয়? সৃষ্টিকর্তা সর্বদা সর্বস্থানে বিরাজমান হলে অপবিত্রতার স্থান গৌণ হয়ে যায় নাকি? ঘৃণা ছড়িয়ে খ্রিস্টান হওয়া যাবে? কিংবা হিংসা করে বৌদ্ধ? না সূচক উত্তরই তো মিলে প্রতিবার।

বিপত্তিটা হচ্ছে তখনই যখন ক্রিয়াবাচক ধর্ম নামবাচক রূপ নেয়। অর্থাৎ মস্তিষ্ক যখন অর্ধেক কাজ করে, আরও ভেঙে বলা যায় যে, আমরা নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে না লাগিয়ে অন্যের কথায়, বা আরও সহজে লালনের ভাষায় বলা যায়, ‘আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে’ ‘কানার হাটবাজার’ বসিয়ে চলেছি, তখনই বিপত্তি ঘটছে।

মৃতদেহের ধর্ম কী? পচে যাওয়া, বিলীন হওয়া। যেমন অস্তিত্বহীন ছিল জন্মের আগে তেমনি হারিয়ে যাওয়া। এমনই এক মৃতদেহ বৌদ্ধ কী মুসলমান তা নিরূপিত না হওয়ায় ইতোপূর্বে কক্সবাজারে এক নারীর শেষকৃত্য দেরি হওয়ার খবর পড়েছি। ভাষার ধর্ম নিতান্ত ভাব বিনিময়ে সাহায্য করা। কিন্তু, নামবাচক ধার্মিকদের হাতে পড়ে ভাষার ধর্মও পরিবর্তিত হতে হয়েছে। কদিন আগে ‘জান’ ও ‘জবান’ নিয়ে বিতর্ক সংবাদপত্রে স্থান পেয়েছিল। অতি সম্প্রতি ‘শান্তিকামীদের সুরক্ষা’ দানকারীদের কর্মকাণ্ডে পুরো দেশের মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মৃত্যুদূত চাহিবামাত্র দিয়ে দেবেন বলে।

অশিক্ষা, অর্ধজ্ঞান ও জ্ঞান অন্বেষণে অকর্মন্যতার ফলেই এমন অজ্ঞানতা ও ক্ষতিকর উন্মাদনার জন্ম। এ দেশের মানুষের সমস্যার অন্ত নেই। অথচ সেগুলোর দিকে কোনো নামবাচক কল্যাণকামীর দৃষ্টি নেই। কিন্তু, মানুষের যা যা ভালো লাগে, যেমন: সুর, গান বা সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম, যেগুলোতে মানুষ নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ পায়, শান্তি লাভ করে, কল্পনা করতে শেখে (কল্পনা ছাড়া কি সৃষ্টি হয়?), সে সবগুলোকে এই অজ্ঞানরা তাদের শত্রু বলে মনে করে। কেন করে তাও পরিষ্কার নয়। এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যার জন্য সুকুমার রায়ের শতবর্ষ আগের একটা লেখার আশ্রয় নেওয়াটাই বরং ভালো।

সুকুমার রায় তার ‘দ্রিঘাংচু’ গল্পে এক বকধার্মিক ও অকর্মণ্য রাজার কাহিনি বর্ণনা করেছেন। রাজা রাজকার্যে দরবারে বসে ঝিমাচ্ছিলেন। এমন সময় এক দাঁড়কাক এসে সিংহাসনের থামের ওপরে বসে বলে ওঠে ‘কঃ’।

রাজা জরুরি রাজকার্যে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে জল্লাদ ডাকলেন। লম্ফ ঝম্ফতে কাক গেল উড়ে। কী আর করেন। রাজা পণ্ডিতদের জড়ো করলেন, জানতে চাইলেন কাক কেন ‘কঃ’ বলল। পণ্ডিতেরা কাকের ‘কঃ’ বলার কী কারণ আর দেখাবেন? যে যা বোঝেন বললেন, তাতে দুই পণ্ডিতের শাস্তি হলো।

শেষে এলো এক বুদ্ধিমান। সে ব্যাখ্যা দিল দাঁড়কাকটা আসলে ছিল একটা ‘দ্রিঘাংচু’। দ্রিঘাংচু কী সে নিজেও জানে না। তবে, শুনেছে দ্রিঘাংচু দাঁড়কাক হয়েই দেখা দেয় আর ‘কঃ’ শব্দ করে। সে নিজেও দ্রিঘাংচু খুঁজছে, কারণ দ্রিঘাংচুর সামনে এক মন্ত্র বলতে পারলে আশ্চর্য সব কাণ্ড ঘটবে। কী কাণ্ড তাও অজানা।

যাহোক, রাজা মন্ত্রটা শিখে নিলেন এবং সারাজীবন ধরে দাঁড়কাক দেখলে মন্ত্র আওড়ে গেলেন। কোনোদিন দ্রিঘাংচুর দেখা মেলেনি, আশ্চর্য কিছুও ঘটেনি।

মন্ত্রটি ছিল—

‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং

ইট পাটকেল চিৎ পটাং

মুস্কিল আসান উড়ে মালি

ধর্মতলা কর্মখালি।’

এরকম মন্ত্র সৃজন সুকুমার রায়ের মতো সৃষ্টিশীলদের খেয়ালি চিন্তা থেকেই কেবল বের হতে পারে। এর মানে বোঝা কঠিন, কিন্তু শব্দের নিখুঁত বুনন ও পতনহীন ছন্দের কারণে একে অস্বীকার করাও কঠিন। যেমন কঠিন পাখির গানের মানে বোঝা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ চর্চা করেছেন। ধর্মগ্রন্থগুলোতেও দুর্বোধ্য শব্দের বিচরণ আছে। তবে, সেটা বিষয় নয়। বিষয় হলো, আবিষ্কারের প্রেক্ষিত জানা না গেলেও এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই মন্ত্র একেবারে যে ফাঁকা বুলি, তা নয়।

আনোয়ার আলী: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago