চিরকালের চির আরাধ্য মহানায়িকা

মহানায়িকা কাকে বলা যায়? যিনি খ্যাতির শীর্ষে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত শিখরে থাকা অবস্থাতে স্বেচ্ছায় চিরকালের জন্য পর্দার অন্তরালে চলে যেতে পারেন। এরপর টানা ৩৬ বছরেও তার জনপ্রিয়তা এক বিন্দু পরিমাণও কমে না। বরং বছরের পর বছর নিজেকে সমস্ত কিছু থেকে গুটিয়ে নিলেও মানুষের হৃদয়ে তার প্রতি ভালোবাসা আর আকর্ষণ থেকেই যায়। দীর্ঘ তিন যুগ স্বেচ্ছায় পর্দার অন্তরালে নিজেকে গুটিয়ে নিলেও মানুষের আগ্রহ আর আকর্ষণ আর উন্মাদনার শেষ সীমায় থাকেন তিনি। তাকে একবার দর্শনের জন্য নামজাদা অভিনয়শিল্পীরাও বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে থাকেন।

মহানায়িকা কাকে বলা যায়? 

যিনি খ্যাতির শীর্ষে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত শিখরে থাকা অবস্থাতে স্বেচ্ছায় চিরকালের জন্য পর্দার অন্তরালে চলে যেতে পারেন। এরপর টানা ৩৬ বছরেও তার জনপ্রিয়তা এক বিন্দু পরিমাণও কমে না। বরং বছরের পর বছর নিজেকে সমস্ত কিছু থেকে গুটিয়ে নিলেও মানুষের হৃদয়ে তার প্রতি ভালোবাসা আর আকর্ষণ থেকেই যায়। দীর্ঘ তিন যুগ স্বেচ্ছায় পর্দার অন্তরালে নিজেকে গুটিয়ে নিলেও মানুষের আগ্রহ আর আকর্ষণ আর উন্মাদনার শেষ সীমায় থাকেন তিনি। তাকে একবার দর্শনের জন্য নামজাদা অভিনয়শিল্পীরাও বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে থাকেন।

জনপ্রিয়তা আর খ্যাতি যে তার নিজ সিদ্ধান্ত থেকে এক বিন্দু পিছু হটায়নি তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। ২০০৫ সালে তাকে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘দাদা সাহেব ফালকে’ এর জন্য মনোনীত করা হলো তাকে। পুরস্কারটি নিতে হবে ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সশরীরে। কিন্তু তার আপত্তি, তিনি যেতে পারবেন না। মহানায়িকা বুঝি একেই বলে। যিনি খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, লোভ, ক্যারিয়ার সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে।

জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনা জেলার সদর উপজেলায়। অবশ্য তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল পাবনার সিরাজগঞ্জ মহকুমার বেলকুচির ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে (বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলা)। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর মা ইন্দিরা দেবী। ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা। তার জন্মের সময় তার বাবা ছিলেন পাটনায়। ঠাকুরদা জগবন্ধু দাশগুপ্ত নাতনির নাম রাখলেন কৃষ্ণা। কিন্তু বাবা করুণাময় পাটনা থেকে ফিরে এসে মেয়ের নাম রাখলেন রমা। বাড়ির সকলে তখন কৃষ্ণা বলে ডাকতো, স্কুলে ভর্তির সময়  নাম দেওয়া হলো রমা দাশগুপ্ত। একসময় রমা নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল কৃষ্ণা। বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও কবি রজনীকান্ত সেন ছিলেন তার আরেক ঠাকুরদা। 

একসময় বহু তদবির করে ভারতের পাটনা থেকে বদলি হয়ে পাবনায় চলে এলেন করুণাময় দাশগুপ্ত।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় দুই ক্লাসের মাঝের সময়ে ডেস্কের উপর বসে গল্প করতে করতে সেসময়ের রমা বন্ধুদের একদিন হঠাৎ বলেই ফেলেছিলেন ‘আমি এমন নাম করব যে, পৃথিবী চিরকাল আমায় মনে রাখবে।’ 

দেশভাগের কয়েক মাস আগে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমার। স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে শেষের দাশগুপ্ত কেটে বসলো সেন। মূলত বিলেত ফেরত ছেলে দিবানাথ সেনকে সংসারী হওয়ার জন্য রমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন আদিনাথ সেন। 

দেশভাগের কিছুদিন আগে স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলেন রমা সেন। 

এর পাঁচ বছর পর ১৯৫১ সালে বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা পৌরসভার স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে কর্মরত থেকে অবসরে যান। আর ১৯৬০ সালে পাবনায় তাদের বাড়িটি জেলা প্রশাসনের কাছে ভাড়া দিয়ে পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে যান করুণাময় দাশগুপ্ত৷ এরপর আর বাংলাদেশে ফিরে আসেননি তারা।

স্বামী দিবানাথের মামা ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার বিমল রায়। একবার বিমল রায় রমা সেনকে দেখে পারিবারিক আলোচনায় চলচ্চিত্রে আনার জন্য দিবানাথ ও তার শ্বশুর আদিনাথকে প্রস্তাব দেন। 

রাজি হয়ে গিয়েছিলেন দিবানাথ ও আদিনাথ। মূলত স্বামী দিবানাথ সেনের ইচ্ছেতেই রমা সেনের চলচ্চিত্রে আসা। তার হয়ে অগ্রিম পারিশ্রমিকও নিয়ে ফেলেছিলেন দিবানাথ সেন। শেষ পর্যন্ত এক ‘অনিচ্ছুক শিল্পী’ হিসেবে "শেষ কোথায়" চলচ্চিত্রের জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন রমা সেন। এই চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়েই তার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় কিন্তু অর্থাভাবে একসময় এই চলচ্চিত্রটি আর কখনোই মুক্তি পায়নি। "শেষ কোথায়" চলচ্চিত্র মুক্তি না পেলেও নেপথ্য গায়িকা হিসেবে স্টুডিওতে গিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। সুকুমার দাশগুপ্ত দেখেই বললেন, "আমার চলচ্চিত্রে অভিনয় করবে?" প্রস্তাবে আর হ্যাঁ না করতে পারেননি তিনি। এর মধ্যে স্বামী দিবানাথ হাজির। বললেন, অবশ্যই করবে। কেন করবে না। সাত নাম্বার কয়েদী চলচ্চিত্রে তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন সমর রায়। 

শুটিংয়ের এক পর্যায়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত বললেন, তোমার নামটা তো পাল্টাতে হবে। এই নাম চলবে না। তারপর নাম নিয়ে ভোট হলো চলচ্চিত্র ইউনিটের মধ্যে। অনেকে নানা নাম বললো, হঠাৎ সহকারী পরিচালক নিতিশ রায় বললেন, "সুচিত্রা সেন"। সবার এই নাম পছন্দ হলো। চলচ্চিত্রে রমা উদয় হলেন সুচিত্রা নামে।  ১৯৫৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেল "সাত নাম্বার কয়েদী"  চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে সমর রায়ের বিপরীতে দারুণ অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। তবে সে বছর মুক্তিপ্রাপ্ত একটি চলচ্চিত্রই তাকে নিয়ে গেল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। নির্মল দে পরিচালিত বিখ্যাত কমেডি চলচ্চিত্র "সাড়ে চুয়াত্তর" উত্তম কুমারের বিপরীতে রমলা চরিত্রে তার অভিনয় অবর্ণনীয়। প্রায় সত্তর বছর পরে এসে আজও এই চলচ্চিত্র সমানভাবে জনপ্রিয়।

তার বোন উমা দেবী তখন একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'তুই সিনেমায় নামলি যে, অভিনয়ের কী জানিস?'  জবাবে সুচিত্রা সেন বলেছিলেন, 'না দিদি, টাকার খুব দরকার, সিনেমা করতেই হবে। চেষ্টা করে দেখি, কতোটা পারি।' 

১৯৫৪ সালে অগ্রদূত নির্মাণ করলেন "অগ্নি পরীক্ষা"  চলচ্চিত্র।  এই চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়েই মূলত প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পায় উত্তম-সুচিত্রা জুটি। দারুণ ব্যবসা সফল হয় এই চলচ্চিত্র। টানা ১৫ সপ্তাহ শীর্ষে ছিল এই চলচ্চিত্র। ১৯৫৪ সাল ছিল সুচিত্রা সেনের ক্যারিয়ারে এক অন্যতম মাইফলকের বছর। এই বছর মুক্তি পেয়েছিল সুচিত্রা সেনের ৯টি চলচ্চিত্র। তার মধ্যে ৬টিই উত্তম কুমারের বিপরীতে। ওরা থাকে ওধারে, মরণের পরে, সদানন্দের মেলা, অন্নপূর্ণা মন্দির, গৃহ প্রবেশ, অগ্নি পরীক্ষা।

১৯৫৫ সালের পহেলা জানুয়ারিতে মুক্তি পেল বিখ্যাত চলচ্চিত্র “দেবদাস”। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস দেবদাস অবলম্বনে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার বিমল রায় হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করলেন দেবদাস। সে বছরের  প্রথম দিনটাই দারুণভাবে শুরু হয়েছিল সুচিত্রা সেনের। একদিকে তার প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিষেক, তাও আবার  দিলীপ কুমারের বিপরীতে।দেবদাসের মুক্তির পর সাড়া পড়ে গিয়েছিল গোটা ভারতে। দেবদাস হয়েছিল সুপারহিট। পার্বতী (পারু) চরিত্রে সুচিত্রা সেনের অভিনয় তো চোখের প্রশান্তি। সেই ১৯৫৫ সালেই এই চলচ্চিত্র আয় করেছিল ১ কোটি রুপি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে এই চলচ্চিত্র শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছিল। আজ পর্যন্ত এই চলচ্চিত্রকে বলিউডের ইতিহাসের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি গণ্য করা হয়। সে বছর উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। সাঁঝের প্রদীপ, শাপ মোচন, সবার উপরে। ১৯৫৫ সালে উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করা তিনটি চলচ্চিত্রই দারুণ ব্যবসা সফল হয়েছিল।

১৯৬১ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত অজয় করের বিখ্যাত চলচ্চিত্র “সপ্তপদী”র কথা না বললেই নয়। এই চলচ্চিত্রে অসামান্য অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন "সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস" লাভ করেন। এটিই ছিল কোন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার লাভ। 

এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের এক অলিখিত নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ছিলেন সুচিত্রা সেন। এই চলচ্চিত্রে উত্তম কুমারের বিপরীতে তার অভিনয়ের জন্য তিনি পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন ২ লাখ টাকা, যেখানে  উত্তম কুমারের পারিশ্রমিক ছিল ৮০ হাজার টাকা। এরপর প্রতিটি চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেনই সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেতেন। কেবল তাই না, তার অভিনীত চলচ্চিত্রে শিডিউল থেকে শুরু করে, তিনি কোথায় অভিনয় করবেন, চলচ্চিত্রের পোস্টারে তার নাম কীভাবে যাবে, চলচ্চিত্রের অভিনেতা কে হবেন এসব কিছুই তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হতো। একসময় উত্তম কুমারও মেনে নিলেন তাদের জুটির নাম উত্তম-সুচিত্রা নয়, বরং সুচিত্রা-উত্তম। উত্তম কুমার তাইতো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সুচিত্রা পাশে না থাকলে আমি কখনোই উত্তম কুমার হতে পারতাম না। এ আমার বিশ্বাস। আজ আমি উত্তম কুমার হয়েছি, কেবল ওর জন্য।’

168805592_1064302954090712_3308648267267455318_n.jpg
উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রা সেন। ছবি: সংগৃহীত

এর আগের বছর ১৯৬০ সালে সত্যজিত্‍ রায় তার জন্য প্রস্তাব নিয়ে এলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে দেবী চৌধুরানী চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য। কিন্তু সবিনয়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন সুচিত্রা সেন। কারণ তখন শিডিউল মিলছিল না সুচিত্রা সেনের। আবার সত্যজিৎ রায় এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে দেবী চৌধুরানী চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় অন্য কোন চলচ্চিত্রে শুটিং করা যাবে না। এদিকে তখন আরও দুটি চলচ্চিত্রের জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিলেন সুচিত্রা সেন। এই প্রসঙ্গে তিনি পরে বলেছিলেন ‘যেসব পরিচালক আমাকে সুচিত্রা সেন বানিয়েছেন এখন যদি এই ছবির জন্য তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই, তাহলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে।’ কেউ কেউ অবশ্য বলেন, এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করলে এই চলচ্চিত্রে তিনি থাকবেন পুতুলমাত্র। কারণ সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে পরিচালকই সর্বস্ব। সুচিত্রা সেন রাজি না হওয়ায় সত্যজিৎ রায় নিজেই এই চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। অবশ্য সুচিত্রা সেন ঠিকই দেবী চৌধুরানী চলচ্চিত্রে দেবী চৌধুরানী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

তা আবার কীভাবে?   

১৯৭৪ সালে দীনেন গুপ্ত "দেবী চৌধুরানী" নির্মাণ করেছিলেন। এই চলচ্চিত্রেই নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। 

সুচিত্রা সেন কেবল যে উত্তম কুমারের সঙ্গেই জুটি বেঁধে সফল হয়েছেন তা কিন্তু নয়। সৌমিত্র-সুচিত্রা জুটিও ছিল দারুণ সফল। ১৯৬৩ সালে "সাত পাকে বাঁধা" চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে সৌমিত্র-সুচিত্রা জুটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই চলচ্চিত্রেরও পরিচালক ছিলেন অজয় কর।  সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে দারুণ অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন আবার "সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস" পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৭৮ সালের ৯ জুন মুক্তি পেয়েছিল সুচিত্রা সেন অভিনীত মঙ্গল চক্রবর্তী পরিচালিত চলচ্চিত্র “প্রণয় পাশা”। এই চলচ্চিত্রে বাসবদত্তা চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন।   

এই চলচ্চিত্রের শুটিং শেষে দৃষ্টির অন্তরালে চলে যান সুচিত্রা সেন। নিজের  অভিনয় ছাড়ার কথা তিনি প্রথম জানালেন তার সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী মেকআপ আর্টিস্ট মোহাম্মদ হাসান জামানকে। জামান বাড়ি ফিরে তার স্ত্রী জামিলাকে বললেন, "ম্যাডাম আর ছবিতে অভিনয় করব না।"  জামিলা প্রথমে ভেবেছিলো স্বামীর পাগলামি।  

পরে যখন সাংবাদিকেরা জামানকে জিজ্ঞেস করল, জামান প্রতিউত্তরে বললেন, "ম্যাডাম কসম খাটিয়ে বললো, তাকে ঐ ধরনের  প্রশ্ন যেন না করি।" একসময় সুচিত্রা সেন সরে আসছিলেন আধ্যাত্মিকতার দিকে ৷ চোখে রোদ চশমা পরে, কালো কাচ ঢাকা গাড়িতে চেপে কলকাতার বেলুড় মঠ, দক্ষিণেশ্বর, তারকেশ্বর হয়ে উঠছিল তার বাড়ির বাইরের একমাত্র গন্তব্যস্থল৷ বেলুড় মঠের ভরত মহারাজের কাছে তিনি নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছিলেন। হয়তো নির্মোহ হয়ে ওঠার শিক্ষার শুরু সেইখান থেকেই। সেখান থেকেই এক নতুন সুচিত্রা সেনের জন্ম। সেই সুচিত্রা সেনকে সাধারণ বাঙালি একেবারেই চেনে না। শোনা যায়, নিজের বাড়িতে যে ঘরের দেওয়াল এক সময় ভর্তি থাকতো তার অভিনীত চলচ্চিত্রের নানা ছবি, পোস্টারে। সেই ঘরের দেওয়াল একদিন সুচিত্রাহীন করে দিয়েছিলেন তিনি নিজে। তার  বদলে ঘরের দেওয়ালে থাকতো কেবল রামকৃষ্ণ আর সারদার ছবি। একসময় বদলে ফেলেছিলেন নিজের দৈনন্দিন জীবন-যাপনও। মাঝে কেবল একবার ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কলকাতার এক কলেজে দীর্ঘ অন্তরাল ভেঙে ক্যামেরার সামনে এসেছিলেন তিনি। তাও আবার ভোটার আইডি কার্ডের জন্য। সেই শেষ তাকে লোকের দেখতে পাওয়া।

মৃত্যুর আগে হাসপাতালে যখন তিনি ভর্তি, তখনও বহু আলোকচিত্রীরা রাতের পর রাত জেগেও একটা ছবি তার তুলতে পারেনি। পারেনি মৃত্যুর পরও। শবযাত্রায় তাকে বহনকারী ভ্যানে কফিনে শুয়ে চিতায় গেলেন তিনি, একটা ছবি তোলার সুযোগও কেউ পায়নি। তিনি রয়ে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের চির রহস্যময়ী এক অধ্যায় হয়ে। পর্দার অন্তরালে থেকে তবুও কি সুচিত্রা সেনের এক বিন্দু জনপ্রিয়তা কমেছে? না, বরং বেড়েছে শতগুণ। তিনি চির আরাধ্য ছিলেন যেমন, চির আরাধ্য হয়ে আছেন আজও। তাইতো তিনি তারকার ঊর্ধ্বে, বাংলার আকাশের একমাত্র মহানায়িকা। তিনি ছিলেন, তিনি থাকবেন আজীবন অভিনয়ে তার নিজস্ব ধারায়, চির ভাস্বর হয়ে। 

আজ কিংবদন্তী অভিনেত্রী মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ৯০তম জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তার প্রতি।

সূত্র:

সম্পূর্ণ সুচিত্রা/ আনন্দলোক সংকলন। 

আমার বন্ধু সুচিত্রা সেন/ অমিতাভ চৌধুরী।

আহমাদ ইশতিয়াক 

[email protected]

আরও পড়ুন:

মেঘ ছাপিয়ে যাওয়া এক স্বপ্নবান স্থপতি ফজলুর রহমান খান

২ এপ্রিল ১৯৭১: জিঞ্জিরা গণহত্যা

স্রোতের বিপরীতে লড়াই করা এক আজন্ম সংগ্রামী পথিক

সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমেদ আজও প্রাসঙ্গিক

এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিবেটি কাঁকন হেনইঞ্চিতা

‘যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না’

২ মার্চ জাতীয় পতাকা দিবস

স্বাধীনতাই একমাত্র গন্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের: মওলানা ভাসানী

যার ওভারকোটের পকেট থেকে বেরিয়েছিল আধুনিক রুশ সাহিত্য আর সাহিত্যিকেরা

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago