আইসিইউ শয্যা ফাঁকা পাওয়াই দায়

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত এক প্রবীণের চিকিৎসা চলছে। গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুতে রেকর্ড হচ্ছে। আজ এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ছবি: রাশেদ সুমন

গতকাল রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) একটি শয্যা খুঁজে পাওয়া ছিল খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতোই কঠিন কাজ।

এক সপ্তাহ ধরে আইসিইউর জন্যে অপেক্ষা করে গতকাল ভোরে মারা গেছেন নজরুল ইসলাম (৭৫)।

নিউমোনিয়া ও গুরুতর শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ১ এপ্রিল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পোস্ট-করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি ছিলেন নজরুল। সেখানে তাকে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল। তবে, এটি যথেষ্ট ছিল না। নজরুলের প্রয়োজন ছিল আইসিইউ সাপোর্ট।

গত ১ এপ্রিল থেকেই তিনি আইসিইউর অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু, এই এক সপ্তাহে ঢামেকের ২০টি কোভিড আইসিইউ শয্যার একটিও তার জন্যে খালি পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে ঢামেক হাসপাতালে ফাঁকা আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বেশিরভাগ দিনই শূন্য থেকে একের মধ্যে থেকেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ২ এপ্রিল, সেদিন ছয়টি শয্যা খালি হয়েছিল।

নজরুলের ছেলে জামাল উদ্দিন পেশায় সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই আমরা আইসিইউ ইউনিটে গিয়েছি, আর তাদেরকে একটি শয্যার জন্যে অনুরোধ করেছি। ঢামেকের চিকিৎসকেরাই আমাদেরকে এ পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রতিদিনই আমাদের একজন আইসিইউ ইউনিটের সামনে বসে ছিলেন।’

বুধবার রাত ২টার দিকে মারা যান নজরুল।

‘আমরা বাবাকে অন্য কোনো আইসিইউতেও স্থানান্তর করতে পারিনি। কারণ, এক মিনিটের জন্যেও তাকে অক্সিজেন সাপোর্ট থেকে সরানো যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় কীভাবে আমরা তাকে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে নিতাম?’ বলেন তার ছেলে।

নজরুলই একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি আইসিইউর অপেক্ষায় থেকে মারা গেলেন। তার মৃত্যুর ছয় ঘণ্টা পরে ৫৫ বছর বয়সী রোকেয়া বেগমও এইচডিইউতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনিও গত ৩০ মার্চ থেকে আইসিইউ শয্যার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন।

জাহাঙ্গীর হোসেন নামে রোকেয়ার এক আত্মীয় বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করাতে পেরেছিলাম। কিন্তু, তাতে কোনো লাভ হয়নি। কারণ আমাদের রোগীর আইসিইউ শয্যা দরকার ছিল।’

ঢামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি খুবই সংকটজনক।’

‘ঢামেকে আইসিইউতে ফাঁকা শয্যা পাওয়া এখন সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন এরকম অনেক রোগী আশঙ্কাজনক অবস্থায় দিন গুনছেন শুধু বাঁচার একটি সুযোগের অপেক্ষায়। আমরা কাউকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না। যেসব রোগীকে আমরা আইসিইউ শয্যা দিতে পারছি না, তাদেরকে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে’, বলেন তিনি।

ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে আরও ১৪টি নতুন শয্যা যুক্ত করার চেষ্টা চলছে বলেও জানান হাসপাতালটির উপপরিচালক।

গতকাল সকালে সরেজমিনে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে শুরুতেই দেখা গেল গোলাপি রঙের নাইটগাউন পরা কঙ্কালসার, দুর্বল এক বৃদ্ধাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলবার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তার মাথা একপাশে ঝুঁকে ছিল। মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল ফেনার মতো তরল। তিনি প্রায় অচেতন অবস্থায় হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন। তার মুখে অক্সিজেন মাস্কটি উলটো করে পরানো ছিল, যে কারণে সিলিন্ডার থেকে আসা অক্সিজেন তার ফুসফুসে না গিয়ে মাস্কের কোণা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। তার আত্মীয়রা তাকে স্ট্রেচারে বসানোর জন্য মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটি খুলে ফেলার পর আরও বেশি করে ফেনার মতো তরল বের হতে শুরু করে।

তার এক আত্মীয় বলেন, ‘এখানে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। তিনি এখানে ভর্তি ছিলেন। এই মুহূর্তে তার আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন। আমরা তাকে রামপুরা নিয়ে যাচ্ছি।’

পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তারা এতটাই বিপর্যস্ত ছিলেন যে, এই প্রতিবেদক রোগীর বিষয়ে আর কোনো বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেননি।

কুর্মিটোলায় ১০টি আইসিইউ শয্যা আছে এবং সবগুলোই রোগীতে ভর্তি। হাসপাতালের কর্মীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ২৯ জন মানুষ অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছেন। অর্থাৎ পুরো আইসিইউ ইউনিট তিন বার খালি হলেই কেবল গতকাল পর্যন্ত যারা অপেক্ষমাণ আছেন, তারা সবাই চিকিৎসা পাবেন। আশঙ্কা করা যায়, প্রতিদিনই অপেক্ষমাণ তালিকায় রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত কুর্মিটোলায় একটি আইসিইউ শয্যাও খালি হয়নি।

কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে একটি গাছের নিচে বসে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আসাদুজ্জামান। কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি থাকা তার ভাইয়ের জন্যে তিনি হন্যে হয়ে একটি আইসিইউ শয্যা খুঁজছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের ফুসফুসের ৪৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের এখন জরুরিভিত্তিতে একটি আইসিইউ শয্যা দরকার। কিন্তু, এ হাসপাতালের আইসিইউ শয্যাগুলো বেশ কিছুদিন ধরে ফাঁকা হচ্ছে না। এটা কীভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব যে, শুধুমাত্র কারও মৃত্যু হলেই কেবল আমরা আইসিইউ পেতে পারি?’

আসাদুজ্জামান ও তার অন্য আত্মীয়রা একের পর এক হাসপাতালে ফোন করছিলেন। কিন্তু, সব জায়গা থেকেই নেতিবাচক উত্তর আসে। এক পর্যায়ে পকেট থেকে টাকার একটি বান্ডিল বের করে এক আত্মীয়ের হাতে দিয়ে আসাদুজ্জামান শহরের আরেক প্রান্তের একটি হাসপাতালে গিয়ে একটি সিট খুঁজতে বলেন।

কয়েক ঘণ্টার আপ্রাণ চেষ্টার পর অবশেষে তারা হাই-কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল লিমিটেডে একটি সিট খুঁজে পান।

হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক মীর ওমর ফারুক বলেন, ‘গত তিন দিন ধরে এ রোগীকে এখানে ভর্তি করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানে উনার এক আত্মীয় থাকার কারণেই অবশেষে তিনি ভর্তি হতে পেরেছেন।’

এই হাসপাতালটিতে ১০টি আইসিইউ শয্যা আছে।

ফারুক বলেন, ‘প্রতিদিন রোগীদের মৃত্যু হয় না, আর তাই আমাদের এখানে কোনো শয্যাও ফাঁকা হয় না। আমাদের এখানে শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর মতো ফাঁকা জায়গাও নেই।’

একটি সূত্র জানিয়েছে, নার্স স্বল্পতার কারণে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ শয্যা খালি পড়ে আছে।

সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে গণমাধ্যমে কথা বলতে নিষেধ করেছে উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সূত্রটি বলে, ‘আমাদের এখানে দুই শ জনেরও বেশি নার্স ছিল। কিন্তু তা কমে গিয়ে এখন দেড় শ হয়েছে। প্রায় ২৫ জন নার্সের কেউ করোনায় আক্রান্ত আর কেউ অন্তঃসত্ত্বা। তাই আমাদের এখানে ১০টি শয্যা ফাঁকা থাকার পরও আমরা রোগী ভর্তি করাতে পারছি না।’

এই হাসপাতালটির ১৬টি ব্যবহারযোগ্য আইসিইউ শয্যা গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রোগীতে ভর্তি। শুধু গত পরশু দিন হঠাৎ তিনটি শয্যা খালি হয়েছিল।

কুর্মিটোলা হাসপাতালের আইসিইউ’র একজন চিকিৎসক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ওয়ার্ডের অসংখ্য রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন এবং তারা কষ্ট পাচ্ছেন। আইসিইউ শয্যা না পেয়ে তারা কোথায় যাচ্ছেন? কেমন আছেন তারা? আমরা কি তাদের পরিবারের আহাজারি শুনতে পাচ্ছি?’

গোলাপি রঙের নাইটগাউন পরা সেই নারী কি কুর্মিটোলা ছেড়ে যাওয়ার পর আইসিইউ শয্যা খুঁজে পেয়েছিলেন? তিনি কি বেঁচে আছেন এখনো? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago