লিসবনের লাল-নীল-হলুদ-সবুজ মেট্রোর গল্প
ইউরোপের দেশ পর্তুগালের রাজধানী লিসবন। ‘সাগর কন্যা’ হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও সাত পাহাড়ের শহর হিসেবেও ডাকে অনেকে। ছোট-বড় সাতটি পাহাড় নিয়ে আটলান্টিকের পাড়ে গড়ে ওঠা এক অপরূপ মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শহর লিসবন। পর্তুগিজ ভাষায় যাকে বলা হয় ‘মেট্রোপলিটনো ডি লিসবোয়া’।
পৃথিবীর অন্যান্য বড় শহরের মতো লিসবনের গণপরিবহন মেট্রোরেল নির্ভর, যার প্রায় পুরোটাই আবার মাটির নিচ দিয়ে চলে। ছয় দশক আগে শুরু হওয়া মেট্রো পরিষেবা এখন রাজধানী শহরটির সবচেয়ে বড় যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। যদিও এই শহরের গণপরিবহণ বৃত্তে বাস-ট্রাম-ট্রেনও আছে। তবুও লিসবন মেট্রোটি শহর ঘোরার দ্রুততম উপায় এবং দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণের ভালো বিকল্প।
নীল, হলুদ, লাল ও সবুজ-চার রঙের বা লাইনের মেট্রোরেল শহরটিকে অনেক ছোট করেছে তার বাসিন্দা এবং বিশ্ব পর্যটকদের কাছে। মেট্রোতে করে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে যাওয়া যায় নিমিষেই। সহজ, সাশ্রয়ী আর দ্রুততার জন্য এই শহরের প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছেও জনপ্রিয় বাহন মেট্রোরেল। ঢাকা মেট্রোরেলও যেন এমন হয়ে ওঠে সেই প্রত্যাশা প্রবাসীদেরও।
পর্তুগাল বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এসোসিয়েশনের সভাপতি, কমিউনিটির সিনিয়র ব্যক্তিত্ব রানা তাসলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা জানি পর্তুগালের ইতিহাস হাজার বছরের ইতিহাস। ইউরোপের মধ্যে বর্তমানে পর্তুগাল জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক দিয়ে দুর্বল হলেও এর আছে বিস্তৃত ইতিহাস। যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে রাজধানীর ছয় দশকের লিসবন মেট্রোরেল, যা দেশটির অগ্রযাত্রার প্রতীক।’
লিসবনে মেট্রোরেল সেবা শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। তখন শহরে মাত্র সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ পথ ছিল, বাইশা শিয়াদু থেকে জারদিম জুলোজিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমানে চারটি লাইনে ভাগ হয়ে ৪৬ কিলোমিটার বেড়েছে। শহর জুড়ে ৫৫টি স্টেশন দিয়ে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে শুরু করে রাত ১টা পর্যন্ত চলে নিরবচ্ছিন্ন সেবা। প্রতি ৪-১২ মিনিট পর পর স্টেশন ছেড়ে যায় মেট্রো। সোম থেকে শুক্র সপ্তাহের কর্মদিবসে সকাল ও সন্ধ্যার সময় এই পরিবহন ব্যবস্থায় মানুষের প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়।
দুইটি জোন বা অঞ্চলে ভাগ করা হলেও এক জোনেই রয়েছে বেশিরভাগ স্থাপনা, দর্শনীয় স্থান এবং বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু। এই পরিষেবা আপাতত শহরের পূর্বে ও উত্তরে বিস্তৃত, পশ্চিমে নেই। তাই পশ্চিমের বেলেম যেতে ট্রামই হল বিকল্প ব্যবস্থা।
সান্তা পলোনিয়া থেকে রিভোলেইরা পর্যন্ত বিস্তৃত নীল মেট্রোর লাইন পুরোটাই মাটির নিচে। পথিমধ্যে লাল লাইন সাও সিবাসতিও, হলুদ লাইন মারকেস পম্বল ও সবুজ লাইনে বাইশা সিয়াদো অতিক্রম করে।
হলুদ লাইনটি রাটো থেকে ওডিভেলাস পর্যন্ত বিস্তৃত যা মারকেস পম্বলে নীল লাইন, সালদানাতে লাল লাইন এবং কাম্পো গ্রান্দেতে সবুজ লাইন অতিক্রম করে। এরপরে লাল লাইনটি যা ওরিয়েন্ট লাইন হিসেবেও পরিচিত তা সাও সিবাস্টিও থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত বিস্তৃত। মাঝখানে সালদানাতে হলুদ লাইন এবং আলামিদাতে সবুজ লাইনকে অতিক্রম করে। তাছাড়া সবুজ লাইন কাইস ডো সোডরে থেকে তেলহেরেস পর্যন্ত চলাচল করে এবং মাঝখানে বাইশা সিয়াদোতে নীল লাইন আলামেদাতে লাল লাইন এবং কাম্পো গ্রান্দেতে হলুদ লাইনকে অতিক্রম করে।
এ প্রসঙ্গে লিসবনের বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তা তানভীর আলম জনি বলেন, ‘লিসবনের মেট্রোরেলের ৪টি লাইনের আন্তঃসংযোগ এতটাই সুপরিকল্পিত যে, আপনি যে স্টেশন থেকেই ওঠেন না কেন; সর্বোচ্চ একবার লাইন পরিবর্তন করেই আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন এবং তা খুব অল্প সময়েই। তাই বাংলাদেশি কমিউনিটি বেশি ভাড়ায় শহরের কেন্দ্রে না থেকে অদূরে যে কোনো মেট্রো স্টেশনের কাছাকাছি কম ভাড়ার বাসা নিয়ে অর্থ সাশ্রয় করতে পারেন।’
একটি একক ভ্রমণ টিকিটের মূল্য দেড় ইউরো। তাছাড়া, ছয় ইউরো ৪০ সেন্টে ২৪ ঘণ্টার টিকিট সংগ্রহ করা যায় যা দিয়ে অসংখ্যবার ভ্রমণ করা যায়। প্রত্যেক যাত্রাতে একটি ভিভা ভিয়াজেই টিকেট সংগ্রহ করতে হয়, যা ৫০ সেন্ট খরচ পড়ে।
পরবর্তীতে একক অথবা ২৪ ঘণ্টার টিকিট সংগ্রহ থেকে শুরু করে নিদিষ্ট পরিমাণ টাকা রিচার্জ করা যায় এই কার্ডে। এই কার্ডটি আবার লিসবনের সকল গণপরিবহনে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী শহর কাসকাইস বা সিন্ত্রার ট্রেন ভ্রমণেও এটি ব্যবহার করা যায়।
সাধারণ একক টিকেটের চেয়ে ৩ ইউরো থেকে ৪০ ইউরো রিচার্জে খরচ একটু কম পড়ে। যেমন একক একটি টিকেটের মূল্য ১.৫ ইউরো কিন্তু কার্ডে রিচার্জ থাকলে তা প্রতিবার ব্যবহারে ১.৪ ইউরো কাটবে। তাছাড়া রয়েছে সাপ্তাহিক এবং মাসিকভিত্তিক রিচার্জ নিয়মিত চলাচলের জন্য অনেক সুবিধাজনক। মাসিকভিত্তিতে মেট্রো ব্যবহারের জন্য দুটি আলাদা অফার আছে। প্রথমটি শুধুমাত্র লিসবন মিউনিসিপ্যাল যা ৩০ ইউরো খরচ পড়ে এবং দ্বিতীয়টি মেট্রোপলিটন যা ৪০ ইউরো খরচ পড়ে। তাছাড়া যারা ন্যূনতম বেতনে কাজ করে এবং যাদের বিগত বছরের আয়কর বিবরণী আছে তারা আরও কম মূল্যে মাসিক কার্ডের সুবিধা পায়।
খুব সহজেই কাউন্টার অথবা অটোমেটিক ভেন্ডিং মেশিন থেকে নগদ অর্থ, কয়েন বা ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে টিকিট অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণের ইউরো রিচার্জ করা যায়। মোটামুটি সব স্টেশনের কাউন্টারে ইংরেজি জানা সার্ভিস অফিসার থাকে এবং সহজেই যে কোনো বিষয়ে সহযোগিতা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশেও মেট্রো রেলের জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। দেরিতে হলেও দেশের অন্যতম বড় শহর রাজধানী ঢাকাবাসী পেতে যাচ্ছে আধুনিক ও যানজটমুক্ত গণপরিবহন মেট্রোরেলের সুবিধা উপভোগের সুযোগ। এ নিয়ে আনন্দিত পর্তুগালের প্রবাসী বাংলাদেশিরাও।
পর্তুগালের ছাত্র সংগঠক শাহিন দর্জি বলেন, ‘লিসবনসহ ইউরোপের উন্নত ও ব্যস্ত শহরে মেট্রো দেখে এক সময় ভাবতাম আমাদের ঢাকায় এটা খুবই প্রয়োজন। আজ তা বাস্তবায়নের পথে। দেশবাসীর মতো আমরাও আনন্দিত। আশাকরি খুব শিগগির রাজধানীর যানজটে নিরসনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে, দেশে ফিরলে আমরাও লিসবনের মতো স্বস্তি পাব।’
ইউরোপের অন্যতম নিরাপদ এবং পরিচ্ছন্ন মহানগর হিসেবে বিবেচনা করা হয় লিসবনকে। এর পেছনে মেট্রো রেলেরও অবদানটা কোনো অংশে কম নয়। এমন তথ্য দিয়ে সরকার নিবন্ধিত পর্তুগাল বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি রনি মোহাম্মদ বলেন, ‘যাতায়াতে সুবিধার পাশাপাশি সময় ও খরচ সাশ্রয়ে এদেশের নাগরিকদের সঙ্গে প্রবাসীদের কাছেও লিসবন মেট্রোরেলই সবচেয়ে পছন্দের গণপরিবহণ হয়ে উঠেছে। আশা করি ঢাকার মেট্রোরেলও সবার জন্য এমন নিরাপদ, সহজ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠবে।’
লেখক: পর্তুগাল প্রবাসী ও শিক্ষার্থী, ক্রিয়েটিভ লিডারশিপ প্রোগ্রাম
Comments