এক নির্মোহ শিল্পীজীবনের পোস্টার মিতা হক
এ দেশে অনেকেই শিল্পী। কিন্তু সুরের সাধক, ক’জনার যাপিত জীবনকে বলা যায়? মিতা হক তেমনই এক নির্মোহ সুরের সাধক। যিনি জীবনে ধারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দর্শন। এমন শিল্পবোধের মানুষ, রবীন্দ্র সাধনের এমন আলোকবর্তিকাকে আমরা হারালাম ৫৯ বছর বয়সে। বড় ক্যানভাসের মানুষ বা আদর্শিক মানুষদের আয়ু পরম করুণাময়ের কাছে এত কম পৃষ্ঠায় কেন থাকে, সেই প্রশ্নও জাগে মনে। তিনি কিডনিজনিত রোগের পাশাপাশি সর্বশেষ পোস্ট কোভিডের আক্রমণ সইতে না পেরে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
একটি ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করি। ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরের সামনে মিতা হকের গানের স্কুল ‘সুরতীর্থে’ নতুন এক শিক্ষার্থী ভর্তি হতে এসেছেন। বার বার কথায় কথায় অনবরত ইংরেজি বলার পারঙ্গমতা দেখানো সেই তরুণীকে গীতবিতান রেখে ছোট্ট একটি গল্পগুচ্ছের বই হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখান থেকে দুটি গল্প পড়ে পরের ক্লাসে এসে আমাদের শোনাবে।’
মেয়েটি অবাক, ‘আমি তো আপনার কাছে গান শিখতে এসেছিলাম!’
মিতা হক বলেছিলেন, ‘আগে সেই মানুষটাকে জানো, উপলব্ধিতে আনো।’
একজন মিতা হক ছিলেন এমনই রবীন্দ্রসাধক। শুধু ভালো গাইতে পারা নয়, জীবনবোধের সঙ্গে সেই সম্মিলনটা খুব যত্নে গড়ে দিতে চাইতেন তিনি।
‘সুরতীর্থ’ নামের যে গানের স্কুল বা সংগীত সংগঠন, তা ছিল মূলত মিতা হকের প্রতিদিনকার অক্সিজেন। সেখানে কোনো ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক তিনি গড়েননি। বরং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়েই ছিল তার গোটা পরিবার। এ দেশের কতজন শিক্ষার্থী যে মিতা হকের বাসায় আশ্রয় পেয়ে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা নিয়েছে, তার তালিকাও কম দীর্ঘ হবে না। আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অগুনিত শিক্ষার্থীদের লাঞ্চব্রেকসহ দুপুরের খাওয়া, আড্ডা আর গুরু মিতা হকের কাছে গানের তালিম নেওয়া যেন নিত্য ব্যাপার। মাস শেষে হয়তো ভার্সিটি ফি-অন্যান্য খরচ শেষ করে হাতে টাকা নেই। গান শেখার পয়সা কোত্থেকে দেবে? উল্টো মিতা হক কিছু হাত খরচ দিয়েছেন এমন তরুণ-তরুণী এ দেশে একশরও ওপরে গোনা যাবে। একজন মিতা হকের মূল্যায়নে এসব কথা জরুরি। কারণ, সবাইকে নিয়ে জীবনের আনন্দ উদযাপন সবাই পারেন না। তার মতো মানুষেরা তাই অনেক দিক দিয়ে অনন্যা। নির্মোহ জীবনের পথিকৃৎ হয়ে থাকেন।
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় জন্ম শিল্পী মিতা হকের। চাচা এ দেশের কিংবদন্তী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক। যিনি এ দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ। একজন প্রাজ্ঞ রবীন্দ্র গবেষকের যোগ্য শিষ্য ছিলেন মিতা হক। এ দেশের কুসংস্কারমুক্ত সমাজের কথা যেমন ওয়াহিদুল হক বলতেন, তেমনি মিতা হক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা বলেছেন একাধিক সময়ে, একাধিক প্লাটফর্মে। এ নিয়ে টিভি টকশো বা মৌলবাদীদের সঙ্গে বাহাসও হয়েছে তার।
এ কথা আজ মিতা হকের প্রয়াণে এ কারণেই বললাম যে, শিল্পী বা তারকা খ্যাতির দাম্ভিক পোশাক তিনি কখনোই পরতে চাননি। বরং প্রচলিত ঘুণে ধরা সমাজের কিছু বিকৃত মানুষের রোষানলে পড়তে পারেন জেনেও মিতা হোক সোচ্চার হয়েছেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবে, ফেসবুকে বা কিছু গণমাধ্যমে কথাও বলেছেন।
অথচ প্রচলিত স্বভাবজাত শিল্পী হয়ে গান বা নিজের নামে দিনব্যাপী সংগীত কর্মশালা করে নিজের তারকা খ্যাতির ব্যাপ্তি তিনি করতেই পারতেন। তা তিনি করেননি। সমসাময়িক অনেক শিল্পীই যখন দেশীয় সাংস্কৃতিক সংকটে চুপ হয়ে থেকেছেন, তখন মিতা হক ছিলেন বোধ জাগরণের বিষয়ে সোচ্চার।
রবীন্দ্রসংগীতের গায়কীর ক্ষেত্রে সানজীদা হক, ওয়াহিদুল হক, মিতা হকের পরম্পরা এ দেশে শুদ্ধ গায়কী হিসেবে স্বীকৃত। আর ব্যক্তিগত চেষ্টায় মিতা তার ‘সুরতীর্থ’ নামের যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, তা মূলত তরুণ-তরুণীদের রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি অনুরাগ বা প্রেম ঘোরে রাখার জন্যই।
এ নিয়ে ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। শান্তি নিকেতনের ‘পৌষ মেলা’ ভীষণ বিখ্যাত উৎসব। এই পৌষ মেলাকে ঘিরে সেখানে নানা ধরণের উৎসব হয়। একইসঙ্গে শিল্পানুরাগী পর্যটকদেরও আনাগোনা হয় প্রচুর। সেখানেই বাংলাদেশ থেকে ৫৫ জনের একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে আমার যাবার সুযোগ হয়। সেখানে বিশ্বভারতীর উদ্যানে খোলা মাঠে বিকেল বেলার অনুষ্ঠান। ওখানকার আয়োজক বিশ্বভারতীর অধ্যাপক মঞ্চে উঠে বললেন, ‘গায়কীতে পরম্পরায় অনেকে বিশ্বাসী নন। অনেকে বলেন- এটাকে আটকে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা ওখানকার মিতা হক ও তার অনুসারীরাই শুদ্ধভাবে ধরে রেখেছেন।’
এই কথা বলার পর ‘সাধু সাধু’ ধ্বনিত হলো। মিতা হকের সাক্ষাৎ অনুসারী ছিলেন সেই সফরে অনেকে। তাদেরকে কোরাস গানের প্রথম সারিতে রাখা হলো। দুই বাংলার এই চমৎকার আয়োজন কাভার করে ফিরে আমি দৈনিক যুগান্তরের শেষ পৃষ্ঠায় একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি পড়ে মিতা হক ফোন দিলেন অফিসে। আমাকে খুঁজলেন। সেই প্রথম আলাপ। অনুষ্ঠানে কী কী গান গাওয়া হলো, কে কে পারফর্ম করলেন জানতে চাইলেন। বললেন, ‘আমার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা পৌঁছে দিও।’
সুরতীর্থ বা একজন শিক্ষক মিতা হক দেশীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা না করলেও, যেখানেই যেতেন সেখানেই থাকতেন মধ্যমণি হয়ে। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের হয়ে বছরান্তে যে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় সফর হতো সেসবে। সেখানে মিতা হকের উপস্থিতি মানে শুধু গান শোনা নয়, ব্যাক স্টেজে মিতা হককে ঘিরে রাখতো তরুণ-তরুণীর দল।
সেই মফস্বলের কোনো এক তরুণী হয়তো ঢাকায় এসেছেন জীবিকার সন্ধানে। সেই মেয়েটি মিতা হককেই প্রথমে ফোন দিতেন। কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকলেও মিতা হককে অস্থির হয়ে যেতে দেখেছেন তার পরিবারের অনেকেই। যেভাবেই হোক মেয়েটিকে কোথাও কোনো চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একজন নির্মোহ শিল্পীর এই যে আত্মত্যাগ, আত্মগরিমাহীন প্রচারবিমুখ হয়ে সাধারণ হয়ে অচেনা কারোর জন্য মায়ার টান, এই অভ্যেস এসময়ে বিরল। মিতা হক তেমনই একটি আদর্শিক জীবনযাপন করে গেছেন।
স্বামী দেশের বরেণ্য অভিনেতা খালেদ খান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন বলে মিতা হকের শেষ দিকের অনেকগুলো বছর মূলত ঘরেই কাটে। দেশের বাইরে প্রোগ্রাম থাকলেও তেমন একটা যেতেন না বা যেতে পারতেন না, সংসার সামাল দেওয়ার কাজেই ব্যস্ত থাকতেন।
মিতা হকের সবসময়ের একটি কথাই ছিল ট্যাগলাইন, ‘একা বেঁচে সুখ নেই। সবাইকে নিয়েই বাঁচতে হয়।’
এ কথা বিভিন্ন অনুষঙ্গে, বিভিন্ন প্লাটফর্মে তিনি একাধিকবার বলেছেন এবং এই মহামূল্যবান কথাটি তিনি জীবনে অনুধাবন করে গেছেন।
প্রাপ্তির খাতা পরিপূর্ণ হয় তখনই কোনো এক শিল্পীজীবনের, যখন তার প্রয়াণে অগুনিত মন ব্যথাতুর হয়। মিতা হক তেমনই এক সম্মানের আকর হয়ে থাকলেন আমাদের সংগীতাঙ্গনে। পেয়েছেন একুশে পদকসহ নানা সম্মাননা।
কন্যা জয়িতা এ দেশের গুণী সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। জীবনে বাড়তি আড়ম্বর যেমন রাখেননি একজন মিতা হক, তেমনি পরিবারের সবাইকেই সেই দীক্ষায় গড়ে তুলেছেন।
একইসঙ্গে নিজ কন্যা গান করেন বলেই বাড়তি সুবিধা নেওয়ার কোনো বাসনা তৈরি করতে চাননি। শুধু তাই নয়, দেশীয় শিল্পাঙ্গনে একটি মুখরোচক কথা প্রচলিত, তা হলো- শিল্পীরা পারস্পরিক প্রশংসা বা অনুপ্রেরণা জানাতে ভীষণ কৃপণ হয়। অগ্রজ-অনুজদের ব্যাপার হলে তো কথাই নেই। মিতা হক এ ক্ষেত্রে ছিলেন বিরলতম উদাহরণ। সংগীতে পাণ্ডিত্য এলে প্রায়সময়ই অনুজদের ভুল ধরার প্রক্রিয়া বেশি দেখা যায়। অথচ কেউ একটু ভালো গাইলেই তাকে উৎসাহ দিতেন। বিভিন্ন প্লাটফর্মে রেফার করতেন। তাই একজন মহতী শিল্পীর বাইরেও এক অনবদ্য সফল সংগঠক হিসেবে তিনি পরমপ্রিয় ছিলেন সবার কাছে।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরটি জানার পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শিল্পীর যাবতীয় বিষয় তদারকির ব্যাপারে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেছেন। রাষ্ট্রের কাছে, এ দেশের কাছে মিতা হক তাই নির্মোহভাবে শুধু দিয়ে গেছেন। প্রচারের আলো, শিল্পীজীবনের বাড়তি দম্ভ, আভিজাত্যের মুখোশ পরা শিল্পীসমাজের যে অভ্যেসে এখন আমরা অনেকেই বিরাজমান। সেখানে একজন মিতা হককে পাঠ করাটা আমাদের এই সমাজের জন্য ভীষণ জরুরি। যিনি সগর্বে রবীন্দ্রনাথের গানে গানে সব কুসংস্কার থেকে মুক্তির কথা বলে গেছেন।
লেখক: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সুরকার ও গণমাধ্যমকর্মী
Comments