আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্থগিত: অভিবাসী কর্মীদের স্বপ্নভঙ্গ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আগামীকাল থেকে এক সপ্তাহের জন্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্থগিত করার সিদ্ধান্তে হতাশাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা।
দুই বছরের ওয়ার্ক পারমিট, ভিসা ও প্লেনের টিকিটসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র গুছিয়ে ১৭ এপ্রিল সৌদি আরবগামী একটি ফ্লাইটে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন তারিকুল ইসলাম (৩৮)। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে মাসে এক হাজার ৩০০ রিয়াল বেতনের চাকরি নিয়ে একটি নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছিলেন তারিকুল। আশা ছিল এর মাধ্যমেই ময়মনসিংহের ফুলপুরে বসবাসরত তাদের চার সদস্যের পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হবে।
তারিকুল বলেন, ‘মহামারির কারণে ইতোমধ্যেই আমরা অনেক বিপদে আছি। এখন ফ্লাইট স্থগিত করায় আমার আয়ের সুযোগটি বিলম্বিত হয়েছে। অথচ এখন আমার পরিবারের জন্যে অর্থনৈতিক সহায়তা খুবই প্রয়োজন।’
ফ্লাইট স্থগিত করার বিষয়টি জানার পর চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তারিকুল। তবে, সেখানকার কর্মকর্তারা তাত্ক্ষণিকভাবে পরবর্তী ফ্লাইটের সময় সম্পর্কে তারিকুলকে নিশ্চিত করে কিছু জানাতে পারেননি।
শুধু তারিকুলই নয়, তার মতো হাজারো অভিবাসী শ্রমিক চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্যে ফ্লাইটের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু, ফ্লাইট স্থগিতের সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে সেই অপেক্ষায় যোগ হলো এক ধরনের অনিশ্চয়তা।
রিক্রুটিং এজেন্টদের একটি প্ল্যাটফর্ম ‘ঐক্য পরিষদ’র তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার অভিবাসী শ্রমিক আগামীকাল থেকে শুরু করে পরবর্তী এক সপ্তাহের মাঝে তাদের নিজ নিজ ফ্লাইটের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।
পরিষদের সভাপতি টিপু সুলতান বলেন, ‘রিক্রুটিং এজেন্টরা ইতোমধ্যেই কর্মীদের টিকিটগুলো “বুক ও নিশ্চিত” করে রেখেছে। কিন্তু, এই স্থগিতাদেশের কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হবে।
‘আগেও এরকম হয়েছে যে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারণে দেরি হয়ে কর্মীদের ভিসার মেয়াদই শেষ হয়ে গিয়েছিল’, বলেন তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি আরও বলেন, ‘একইসঙ্গে ফ্লাইটের টিকিটের স্বল্পতাও রয়েছে’।
‘কখনো কখনো আপনাকে একটি ২০ হাজার টাকা দামের টিকিট ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিয়েও কিনতে হবে।’
গত বছর করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্থগিত রাখার কারণে অনেক অভিবাসী শ্রমিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
মহামারির মাঝে সর্বাধিক শ্রমিকের চাকরিদাতা দেশ সৌদি আরব একাই প্রায় ২৫ হাজার অভিবাসী কর্মীকে তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ভিসা পুনরায় ইস্যু করার জন্যে নতুন করে কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) রোববার দেওয়া একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানায়, ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা থেকে ২০ এপ্রিল রাত ১১টা ৫৯ পর্যন্ত বর্তমান স্থগিতাদেশটি প্রযোজ্য থাকবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চার্টার্ড ফ্লাইট, কার্গো ফ্লাইট, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এবং বিশেষ ফ্লাইট এ স্থগিতাদেশের আওতার বাইরে থাকবে।
এ ফ্লাইটগুলোর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রশস্ত কাঠামোর উড়োজাহাজে সর্বোচ্চ ২৬০ জন যাত্রী এবং সংকীর্ণ কাঠামোর উড়োজাহাজে সর্বোচ্চ ১৪০ জন যাত্রী বহন করতে পারবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অভিবাসী কর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীদেরকে বিস্মিত করেছে।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধের জন্যে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিধিগুলোকে সঠিকভাবে পালন করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তারা বলেছেন, এই স্থগিতাদেশটি দেশের বৈদেশিক শ্রমবাজারকে এক ধাপ পেছনে নিয়ে যাবে। গত বছর মহামারির মধ্যে এই খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং এখনো সেই ক্ষতি কেবল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছিল।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বিদেশে কর্মরত কর্মীর সংখ্যা কমে দুই লাখ ১৭ হাজারে নেমে এসেছিল। এর আগের বছর এই সংখ্যা সাত লাখেরও বেশি ছিল।
গত ৫ এপ্রিল একটি আলোচনা সভায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জানান, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় এক লাখ ৪৪ হাজার প্রবাসী কর্মী বিদেশে কাজ খুঁজে পেয়েছেন।
অভিবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে অভিবাসী শ্রমিকরা দেশে প্রায় ১৮ দশমিক দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় এক লাখ ৫৪ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা) রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন এবং চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত তারা প্রায় ১৮ দশমিক ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় এক লাখ ৫৭ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা) পাঠিয়েছেন।
এ মুহূর্তে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী বিশ্বের ১৬০টিরও বেশি দেশে বসবাস করছেন।
আরও পড়ুন:
১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্থগিত
১৪-২১ এপ্রিল: নতুন বিধি-নিষেধে যেভাবে চলার নির্দেশনা
১৪ এপ্রিল থেকে বন্ধ হতে পারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট
১৪ এপ্রিল থেকে ৭ দিনের কঠোর লকডাউন: জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী
১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউনের চিন্তা: সেতুমন্ত্রী
Comments