হেফাজত বলছে ‘না’, ছবি বলছে ‘হ্যাঁ’
গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত তিন দিনে হেফাজত ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৫৮টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, দুইটি মন্দিরসহ জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাড়ি ও অফিসে হামলা, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। তবে, এখন এসব হামলা-ভাঙচুরে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করছে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজত ‘না’ বললেও এসব ঘটনায় ধারণকৃত ছবি, ভিডিও ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট।
গত ৫ এপ্রিল দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব পরিদর্শনে এসে হেফাজতে ইসলামের জেলা শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সাজেদুর রহমান দাবি করেন, তাণ্ডবে তাদের সংগঠনের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয়। বরং তাণ্ডবের কারণে তাদের কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা পুলিশ বলছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও তাণ্ডব চালানো হয়েছিল হেফাজত ইসলামের নেতৃত্বেই। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল তারা। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত (১৫ এপ্রিল) ২৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকার থেকে আজ পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৩০ জন হেফাজত কর্মী ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সর্বশেষ তাণ্ডবের পরদিন গত ২৯ মার্চ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে আয়োজিত সভায় বলেন, ‘সমস্ত ঘটনার দায় হেফাজতকেই নিতে হবে।’
তবে, ক্ষমতাসীন দলের জেলা শাখার এই দুই শীর্ষ নেতা হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের জন্য পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকেও দায়ী করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার জন্য হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন শোভন বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের নেতারা ঘটনার শুরু থেকেই মিথ্যা বলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ তিন দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চালানো তাণ্ডবের ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এসবের ভিডিও ফুটেজ ও ছবি আমাদের সবার কাছেই সংরক্ষিত আছে। ফেসবুকে সয়লাব হয়ে আছে তাদের ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র। তাদের মিথ্যা বক্তব্য ধর্মপ্রাণ মানুষকে মর্মাহত করেছে।’
তাণ্ডব নিয়ে মিথ্যাচারের জন্য হেফাজতে ইসলামের নেতাদের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায় ছাত্রলীগ। ক্ষমা না চাইলে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত টানা তিন দিন তাণ্ডবের মধ্যে শেষ দিন হরতাল চলাকালে পাঞ্জাবি ও টুপি পরিহিত মাদ্রাসাছাত্রদের পাশাপাশি জিনস প্যান্ট ও টি-শার্ট পরিহিত যুবকরাও হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটে অংশ নিয়েছিল। সেদিন তাদের হাতে দা, হকিস্টিকসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। হেফাজতে ইসলামের পাশাপাশি একটি ‘বিশেষ চক্রও’ হরতালের সময় লুটপাটে শামিল হয়। যে কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলে।
২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ লাইনস, সরাইল হাইওয়ে থানা ও আশুগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর টোল প্লাজায় হামলার ঘটনায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে শত শত প্যান্ট-শার্ট পরিহিত যুবকদের দেখা যায়। হামলাকারীদের অনেকের মাথায় হেলমেটও পরা ছিল।
হরতালের দিন সকাল সাড়ে নয়টার পর থেকেই হেফাজতের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে পড়েন। তাদের সঙ্গে বহিরাগত একদল যুবক মিশে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর এবং পেট্রোল ও গান পাউডার ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। তারা পৌরসভা কার্যালয়, পৌর মিলনায়তন, পুলিশ লাইনস, সদর থানা, খাঁটিহাতা বিশ্বরোড হাইওয়ে থানা, শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দির, দক্ষিণ কালিবাড়ি, জেলা আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্যের কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের কার্যালয়, তার নিজের ও শ্বশুরবাড়ি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা চৌধুরী আফজাল হোসেন নিসারের বাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আনার, জামাল খানের বাড়ি, বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার কার্যালয়, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী মহিলা কলেজ, ছাত্রলীগ সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন শোভনের বাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে।
বেলা ১১টার পর হেফাজতের হরতাল সমর্থকরা জেলা পরিষদ ভবনে আগুন দেয়। ভবনটির নিচতলার একাধিক কক্ষে অগ্নিসংযোগের পর এসি বিস্ফোরিত হয়। এর পরপরই সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার এবং পৌরসভায় ভাঙচুর ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আগুনে সদর উপজেলা ভূমি অফিসের নিচতলার বিভিন্ন কক্ষে থাকা সকল নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের শ্রেণিকক্ষ ও জাদুঘরে থাকা সবকিছু পুড়ে যায়। সেখানকার সরোদ মঞ্চের সকল টেবিল ও চেয়ার আগুনে ভস্মীভূত হয়।
সেদিন দুপুর ১২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। শহরের হাসপাতাল রোড এলাকায় প্রেসক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামিরের ওপর হামলা চালায় তারা। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত এই তাণ্ডব চলে। এ ছাড়া, জেলার আশুগঞ্জ ও সরাইলের একাধিক স্থানে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশ ও মাদ্রাসাছাত্রদের সংঘর্ষের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একদল মাদ্রাসাছাত্র গত ২৬ মার্চ শহরে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে সেদিন টুপি-পাঞ্জাবি পরিহিত মাদ্রাসাছাত্ররা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে রেলস্টেশন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, দুই নম্বর পুলিশ ফাঁড়ি, সার্কিট হাউস, বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, জাতীয় বীর আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুক্ত মঞ্চ, সিভিল সার্জন ও মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে আগুন দেয়। তা ছাড়া, হেফাজতের ডাকা হরতালের সুযোগেই ২৮ মার্চ তাদের সঙ্গে মিশে একদল অস্ত্রধারী ভাঙচুর ও লুটপাট করে। ফলে হরতাল আহ্বানকারী হিসেবে এসবের দায় হেফাজতে ইসলামেরই।’
হেফাজতে ইসলামের জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা সাজেদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ-ভাঙচুর করে, তারা কোনোদিন হেফাজতের নেতা বা কর্মী হতে পারে না। হরতালের দিন হেফাজতে ইসলামের নেতাদের অবস্থান ছিল শুধু জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার সামনে। আমাদের কেউ হামলা-ভাঙচুরে অংশ নেয়নি। বরং ভাঙচুরের জন্য আমাদের কর্মসূচিটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা এসব ভাঙচুরের প্রতিবাদ জানাই এবং দোষীদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিচারের দাবি জানাই।’
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ও জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার মোহতামিম মুফতি মুবারক উল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার যতটুকু বিশ্বাস, আমাদের কোনো মানুষ তাণ্ডব করেনি। যারা এমন ন্যক্কারজনক কাজ করেছে, সেটি তদন্তের মাধ্যমে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. রইস উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদেরও গ্রেপ্তার করছি। সহিংসতার সময়ে যে ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণ করা হয়েছে, তা দেখে আসামিদের শনাক্ত করছে পুলিশ। প্রতিনিয়ত সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এরপরই তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং হচ্ছে।’
জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার তথ্য অনুযায়ী, তাণ্ডবের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে হেফাজতে ইসলামের ৯৪, জামায়াত-শিবিরের তিন ও বিএনপির ৩৭ নেতা-কর্মী রয়েছেন। এ ঘটনায় মোট দায়ের করা ৫৪টি মামলায় ৪১৪ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা ৩৫ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় ৪৯, আশুগঞ্জ থানায় তিন ও সরাইল থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়।
উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর, সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলায় ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা। সেসময় শহরের বিভিন্ন স্থানে ও সরাইল বিশ্বরোড এলাকায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাদ্রাসাছাত্রসহ ১৩ জন মারা গেছেন। যদিও হেফাজতের দাবি, নিহতের সংখ্যা ১৭।
আরও পড়ুন:
৩ দিনে ঝরে গেল ১৩ প্রাণ, হেফাজতের দাবি ১৭
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব: ৪৫ মামলায় ৩৩ হাজার আসামি, নাম নেই হেফাজতের কারও
আবারও পোড়ানো হলো ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব: ৭ মামলায় হেফাজতের কারও নাম নেই
হেফাজতের তাণ্ডব: ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা
‘হেফাজতের তাণ্ডব ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব: ১১ মামলা, ১০ হাজারের বেশি আসামি, গ্রেপ্তার ২১
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষোভ, রেলস্টেশন ভাঙচুর
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডবের ঘটনায় মামলা ৩, আসামি ৬৫০০
ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিহত আশিকের
সরাইলে ফাঁড়িতে হামলা, ১৫ পুলিশ সদস্য আহত
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভূমি অফিস, গণগ্রন্থাগার, আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে আগুন
Comments