চিত্রকলা

উপমহাদেশের আধুনিক চিত্রশিল্পের পথিকৃৎ নন্দলাল বসু

প্রতিবেশী এক যুবকের হাত ধরে কলকাতার আর্ট স্কুলে কোন সকালে হাজির হলেন ২২ বছরের এক চটপটে যুবক নন্দ। মনে প্রবল ইচ্ছে আর্ট কলেজে পড়বে। যদি ভর্তি হওয়া যায়! এর আগে যদিও কলকাতার তিনটি কলেজে পড়া শেষ। মজার বিষয় হলো একটিতেও পাশ করতে পারেননি। প্রথমে জেনারেল এসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশন, এরপর মেট্রোপলিটন কলেজ আর শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজ। কিন্তু এই যে পড়াশোনা, গতানুগতিক এই পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ পেল না সে যুবক। বুঝেই ফেলল এই পথ তার নয়। অবশেষে আর্ট স্কুলে যদি ঠাঁই মিলে ক্ষণিকের তরে।
চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবেশী এক যুবকের হাত ধরে কলকাতার আর্ট স্কুলে কোন সকালে হাজির হলেন ২২ বছরের এক চটপটে যুবক নন্দ। মনে প্রবল ইচ্ছে আর্ট কলেজে পড়বে। যদি ভর্তি হওয়া যায়! এর আগে যদিও কলকাতার তিনটি কলেজে পড়া শেষ। মজার বিষয় হলো একটিতেও পাশ করতে পারেননি। প্রথমে জেনারেল এসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশন, এরপর মেট্রোপলিটন কলেজ আর শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজ। কিন্তু এই যে পড়াশোনা, গতানুগতিক এই পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ পেল না সে যুবক। বুঝেই ফেলল এই পথ তার নয়। অবশেষে আর্ট স্কুলে যদি ঠাঁই মিলে ক্ষণিকের তরে।

নিজের স্টুডিওতে ছবি আঁকছেন নন্দলাল বসু। ছবি: সংগৃহীত

এর কিছুদিন আগে কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাইস প্রিন্সিপাল পদে এসেছেন। আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ হ্যাভেল বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথকে ভাইস প্রিন্সিপালের পদে বসিয়েছিলেন। দুপুরে ঘুমের ব্যাঘাত হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মনিষ্ঠার অসহ্য বেড়াজালের ওজর তুলে অবনীন্দ্রনাথ সাহেব মাস্টারের প্রস্তাবকে পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন। হ্যাভেল সাহেব কিন্তু তাকে ছাড়েননি।

ভীষণ সুনাম তখন আর্ট কলেজের চারদিকে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো আগে থেকেই জনপ্রিয় এবং কিংবদন্তি, তার স্পর্শে এসে আর্ট কলেজের ধারণাই পাল্টে গেল। আর্ট স্কুলে তখন সবে শুরু হয়েছে দেশীয় শিল্পচর্চার কর্মযজ্ঞ।

নন্দদের বাড়িতে প্রবাসী পত্রিকা আসতো। অবনীন্দ্রনাথের বিখ্যাত চিত্রকর্ম বজ্র মুকুট, বুদ্ধ ও সুজাতা দেখে ভীষণ মুগ্ধ। এ দেখে তার প্রবল ইচ্ছে জাগলো যে করেই হোক আর্ট স্কুলে তাকে পৌঁছাতেই হবে। প্রতিবেশী সত্যেন বটব্যাল তখন আর্ট স্কুলে পড়তো। একদিন গিয়ে তিনি অবনীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে বললেন, স্যার একে কিন্তু আপনার নিতেই হবে বললাম। ওর কোন জায়গায় মন টেকে না, পড়তে চায় না। দারুণ আঁকে, খালি আঁকতে চায়। আর্ট কলেজে ভর্তি হবে বলে গোঁ ধরে বসে আছে।

অবনীন্দ্রনাথ দেখলেন শ্যামলা ছিপছিপে এক তরুণ দাঁড়িয়ে সামনে। হাত সটান করা, দুচোখ বুদ্ধিদীপ্ত। যা বোঝার বুঝে ফেললেন অবনীন্দ্র। চোখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, স্কুল পালিয়ে এসেছো বুঝি? ওখানে পড়াশোনা নেই, এখানে পড়াশোনা হয়ে যাবে? মসকরা করতে এসেছো?

তরুণ কিছু বললো না।

অবনীন্দ্রনাথ ফের বললেন, কি সে পড়তে এতদিন?

"আজ্ঞে কলেজে, তবে ফেল করেছি!"

ফেল করে এখানে এসেছো! তো ফেলের আমি কি করবো। আমার এখানে এসে কাজ কি? সাফ জবাব অবনীন্দ্রনাথের।

যদি একটাবার সুযোগ দেন তবে শিখতে চাই আপনার কাছে।

অবনীন্দ্রনাথ বললেন, তবে এই কাগজে আঁকো তো দেখি। ও তো বললো তুমি নাকি দারুণ আঁকো। দেখি তোমার হাতের কাজ।

নন্দ আঁকলো। একটা মেয়ে, পাশে হরিণ, লতাপাতা, শকুন্তলা।

অবনীন্দ্রনাথের মন ভরলো না। এখনো বাচ্চামো। হবে না। কাল একখানা গণেশের ছবি এঁকে এনো তো।

ব্যর্থ মনোরথে ফিরে গেল নন্দ। বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে লাগলো, প্রবাসী পত্রিকায় রবি বর্মা, অন্নদা বাগচিদের সঙ্গে আঁকা অবনীন্দ্রনাথের আঁকা বজ্রমুকুট, বুদ্ধ ও সুজাতা, নল দয়মন্তি, শাহজাহাঁ। কতো বিখ্যাত তো সব চিত্রকর্ম। সেই অবনীন্দ্রনাথের কাছে আঁকা শিখতে চেয়েছিল সে। অথচ কিনা প্রত্যাখ্যান। জেদ চেপে বসলো নন্দের। এখনো তো একটা সুযোগ আছে। চেষ্টা করলেই পারে। 

পরদিন ঠিক ফিরে এলো নন্দ। আসার সময় একটা কাগজে গণেশ এঁকে এনেছিল, আর সঙ্গে আঁকা "সিদ্ধিদাতা"। গণেশের আঁকা ছবি দেখে খানিক পরখ করলেন অবনীন্দ্রনাথ। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রথমে এই ছেলেটির আঁকা গণেশ বিশ্বাস করতে না চাইলেও সিদ্ধিদাতা নিয়ে অনেকক্ষণ কৌতুক করলেন মেজাজি অবনীন্দ্রনাথ। দেখেই অবাক হলেন, নন্দের পিঠ চাপড়ে বললেন, "সাবাস তুমি বেশ ভালো আঁকো।" অবনীন্দ্রনাথ তার আত্মস্মৃতিতে লিখেছিলেন, ‘‘একটি কাঠিতে ন্যাকড়া জড়ানো, সেই ন্যাকড়ার উপরে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। বেশ এঁকেছিল প্রভাতভানুর বর্ণনা দিয়ে। বললুম, ‘সাবাস’!’’

অবনীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে বললেন, ‘লেখাপড়া শেখালে বেশি রোজগার করতে পারবে কিন্তু।’ এতক্ষণ চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা সে ছেলের মুখ থেকে এবার কথা সরল, ‘লেখাপড়া শিখলে তো ত্রিশ টাকার বেশী রোজগার হবে না। এতে আমি তার বেশী রোজগার করতে পারবো।’ ভাইস-প্রিন্সিপাল আর না করতে পারলেন না।

সেবার জনৈক চিত্রপ্রেমী ‌আইরিশ মহিলা এসেছিলেন আর্ট স্কুলে। অবনীন্দ্রনাথ তাকে ছাত্রদের শিল্প-কর্ম দেখাচ্ছেন। তিনটে ছবিতে অতিথির চোখ আটকে গেল। প্রথমটি কৃষ্ণ-সত্যভামা’র তো পরের দু’টি কালী আর দশরথ-কৌশল্যা’র। ‘কৃষ্ণ-সত্যভামা’র ছবিতে সত্যভামার পা ধরে বাসব তার মানভঞ্জনে রত। অবাক হলেন অতিথি নারীর পা ধরে পুরুষের মানভঞ্জন! দৃষ্টিকটু বটে, খারাপ দেখায়। শিল্পীকে এ জাতীয় ছবি আর আঁকতে নিষেধ করলেন। দেবী কালীর ছবি তাকে তৃপ্তি দিয়েছিল যদিও, তবু দীর্ঘ বস্ত্র পরিহিতা সে কালীমূর্তি যেন স্বাভাবিকতার গণ্ডি খানিকটা অতিক্রম করে গিয়েছিল। মা-কালী যে দিগ্‌বসনা, প্রলয়ঙ্করী। শিল্পীকে তিনি কালী সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা কবিতাটি  (‘Kali the Mother’) একবার পড়তে বললেন।

তৃতীয় ছবি ‘দশরথের মৃত্যু-শয্যা’য় রামচন্দ্রের বনাগমনের শোকে মৃত দশরথের দেহের পদমূলে উপবিষ্ট কৌশল্যার বিয়োগ ব্যথা মূর্ত। হাতে তার একখানা পাখা। ছবিতে ফুটে ওঠা শান্তির বাতাবরণ অতিথির মন ছুঁয়ে গেল। এ যেন মা সারদা’র গৃহের প্রশান্তি! তবে স্মিত হেসে তিনি বললেন, কৌশল্যা রাজরানি। তার হাতে তালপাতার পাখা? রাজরানির হাতে হাতির দাঁতের পাখাই শোভা পায়। শিল্পীকে ডেকে বললেন, যাদুঘরে হাতির দাঁতের পাখা রাখা আছে, তিনি যেন একবারটি গিয়ে তা’ দেখে আসেন।

তারপর সেই আইরিশ নারী তাকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, কালে কালে এই ছেলে হয়ে উঠবে চিত্রশিল্পের প্রতিভূ।

এবার বলি সেই আইরিশ নারী কে ছিলেন! তিনি ছিলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল, মানে বিখ্যাত সমাজকর্মী ও লেখিকা ভগিনী নিবেদিতা।

গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। যাবার সময় তিনি বললেন, ‘গণেন একে তুমি আমার বাগবাজার বোসপাড়া লেনের বাড়িতে নিয়ে এসো।’ অসিতকুমার হালদারকে নিয়ে কিছুদিন পরেই নন্দলাল হাজির হয়েছিলেন তার বাড়িতে। কিন্তু নিবেদিতার গৃহে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা দারুণ।

বোসপাড়া লেনের ছোট্ট দোতলা বাড়ির আরও ছোট এক ঘর। মেঝেতে কার্পেট পাতা। তার ওপর সোফা। বসতে বলা হলে, নন্দলাল-রা সোফায় গিয়ে বসলেন। তা দেখে নিবেদিতা তাদের আসন করে বসতে বললেন। আসন করে বসা মানে তো মাটিতে বসা। নীরবে তারা সোফা থেকে নেমে মেঝেতে বসলেন। নন্দলালদের মনে অভিমানের ফুলকি জ্বলল।

বোধ হয় বুঝতে পারলেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন সে কথা, "বুদ্ধের দেশের লোক হয়ে তাদের সোফায় বসতে দেখে তার ভাল লাগে না। মাটিতে আসন করে বসাতে তাদের যেন ঠিক বুদ্ধের মতো লাগছে। দেখাচ্ছেও বেশ।"  কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে সে দিকে চেয়ে থেকে, কি দেখলেন কে জানে, খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে সঙ্গী ক্রিস্টিনাকে ডেকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর থেকে শুরু হলো বাগবাজারে নিবেদিতার কাছে নন্দলাল বসুর নিয়মিত যাতায়াত। সঙ্গী কখনও সুরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অসিতকুমার হালদার তো কখনও বা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একদিন নন্দলাল তার ‘জগাই-মাধাই’ স্কেচটা দেখালেন তাকে। খুব খুশি হলেন দেখে। জানতে চাইলেন, ‘ওদের মুখচ্ছবি কোথায় পেলেন?’ নন্দলাল জবাব দিয়েছিলেন, গিরিশবাবুর, মানে গিরিশচন্দ্র ঘোষের মুখ দেখে এঁকেছেন। এ কথায় হেসে ফেলেছিলেন নিবেদিতা। খানিক চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘ছবি সব সময় ধ্যান করে আঁকবে। এই তো আমাদের ভারতীয় ছবি আঁকার রীতি।’ ছবিটিতে জগাইয়ের কোমরে একখানা থেলো হুঁকো গোঁজা দেখে নিবেদিতা মন্তব্য করেছিলেন, ‘জগাইয়ের আমলে তামাক খাওয়ার চল ছিল না। ছবি আঁকার সময়, বিষয়ের সমসাময়িক আচার-ব্যবহার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার।’ সেটাই আজীবন অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন নন্দলাল বসু।

নন্দলাল বসুর জন্ম ১৮৮৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি বিহারের মুঙ্গের জেলার খড়ঙ্গপুরে। অবশ্য   তাদের আদিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার হরিপাল-তারকেশ্বর এর জেজুর গ্রামে। নন্দলাল বসুর বাবা পূর্ণচন্দ্র বসু ছিলেন দ্বারভাঙা এস্টেটের কর্মচারী। মা ক্ষেত্রমণি দেবী গৃহবধূ হলেও ছিলেন এক বিশেষ প্রতিভার অধিকারী। ছোট্ট নন্দলালের জন্য খেলনা মূর্তি তৈরি করতেন তিনি, কখনো আবার পুরনো খেলনাকে নবকলেবর দান করতেন। স্থাপত্য শিল্পের প্রতি আগ্রহ হয়তো নন্দলাল মায়ের থেকেই আহরণ করেছিলেন৷ নন্দলাল বসুর প্রাথমিক শিক্ষা খড়ঙ্গপুরেই। কলকাতায় এসে সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। প্রথাগত শিক্ষা কোনও দিনই ভাল লাগত না। ছোট থেকেই শিল্পের প্রতি অনুরক্ত। খড়্গপুরে শিল্পীদের প্রতিমা নির্মাণ বুঁদ হয়ে দেখতেন। তার পরে কাদামাটি দিয়ে দেবদেবীর মূর্তি গড়তেন। কলকাতায় এসেই নন্দলালের সঙ্গে প্রথম পরিচয় অবনীন্দ্রনাথের ছবির এবং সেই ছাপানো ছবি দেখে মুগ্ধ হন। যেন সন্ধান পেলেন জীবনের লক্ষ্যপথের।

আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পরে নন্দলাল বসুর ক্লাসিক্যাল চিত্রকলার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ হয় ১৯০৭ সালে। তাও আবার বিবেকানন্দের সহপাঠী প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী  প্রিয়নাথ সিংহের সঙ্গে। পুরো ভারত তখন চষে বেড়িয়েছিলেন নন্দলাল বসু। দেশের নানান বিখ্যাত কলা শিল্প, কালীঘাটের পট আড় লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে নিবারণ ঘোষের কাছে নন্দলাল। উদ্দেশ্য রেখা ও রঙের কাজ নিখুঁতভাবে শেখা। এর দু বছর পড় ভগিনী নিবেদিতার আগ্রহে তিন বিদেশি শিল্পী নিয়ে তিনি বের করলেন অজন্তা।

এই অজন্তা পত্রিকাতেই তার আঁকা স্কেচের দারুণ সুনাম হলো। চোখ এড়ালো না স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে নন্দলালকে দায়িত্ব দিলেন তার নতুন বই চয়নিকার প্রচ্ছদ আঁকার। সে বছরই কবি নন্দলাল বসুকে শান্তিনিকেতনে ডেকে নিয়ে সংবর্ধনা দিলেন।

পঞ্চানন মণ্ডলের ‘ভারতশিল্পী নন্দলাল’ এ লিখেছিলেন, “কবির সাথে আমার প্রথম দেখা জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে। যোগাযোগ হলো কি করে সে-কথা বলি। আমাদের হাতিবাগানের বাড়িতে এসেছিলেন বাঁকুড়ার এক সাধু। পূজার জন্য তাকে ‘তারা’ মূর্তি করে দিয়েছিলুম। তার কিছুদিন পরেই কবির জোড়াসাঁকোর বাড়িতে সহসা ডাক পড়লো আমার। সসঙ্কোচে গেলুম আমি দেখা করতে। কবি বললেন, তোমার তারামূর্তি আমি দেখেছি। বেশ হয়েছে। তা তোমাকে এখন আমার কবিতার বই (চয়নিকা) ইলাস্ট্রেট করতে হবে। কবিকে বললুম, আমি আপনার বই পড়িনি বললেই হয়। পড়লেও মানে কিছু বুঝিনি। কবি বললেন, তাতে কি, তুমি পারবে ঠিক। এই আমি পড়ছি, শোনো। বলে, তিনি তার চয়নিকার কবিতা পড়তে আরম্ভ করলেন।” ওয়াশ পদ্ধতিতে নন্দলাল চয়নিকার জন্য সাতটি ছবি আঁকেন। সেগুলো হচ্ছে- কেবল তব মুখের পানে চাহিয়া,  ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে, যদি মরণ লভিতে চাও, খেপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর, হে ভৈরব হে রুদ্র বৈশাখ (শিব তাণ্ডব),  ভূমির পরে জানু গাড়ি তুলি ধনুঃশর (নকলবুদি) ও   আমারে নিয়ে যাবি কে রে দিন শেষের শেষ খেয়ায়।

কিন্তু নন্দলালের আঁকা ছবিগুলো রবীন্দ্রনাথ’কে পুরোপুরি তৃপ্তি দেয়নি। মূল ছবির রস বই ছাপানোর পর ফুটে ওঠেনি। ১৯০৯  সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কবিগুরু চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখেন, ‘নন্দলালের পটে যে রকম দেখেছিলুম বইয়ে তার অনুরূপ রস পেলুম না। বরঞ্চ একটু খারাপই লাগলো।’ তবে কবিকে আর ভবিষ্যতে নন্দের ছবির ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় পড়তে দেখা যাবে না। কবি আর চিত্রীর দ্বৈতমিলনে জন্ম নিয়েছিলো পংক্তি-রেখার বৈভবময় অজস্র সৃষ্টিমালা। অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ নন্দলাল’কে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি বাজিয়েছি বাঁশের বাঁশি আর তোমরা সেই বাঁশে মঞ্জুরী ফুটিয়েছ।’ তোমরা’ - বহু বচনে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছিলেন নন্দলাল বসু ছাড়াও সমসাময়িককালে রবীন্দ্র- রচনায় অন্যান্য গ্রন্থ চিত্রকরদের কথা। তবে একমাত্র হরিশ চন্দ্র হালদার ওরফে ‘হ চ হ’ (রবীন্দ্রনাথের প্রথম গ্রন্থচিত্রী) ছাড়া বাকি সবাই রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগেও দীপ্যমান ছিলেন।

১৩১৭ বঙ্গাব্দ তথা ১৯১১ সালের ‘ভারতী’ পত্রিকায় জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় ছাপা হলো নন্দলালের ৬ ইঞ্চি বাই ৪ ইঞ্চি পোস্টকার্ড সাইজে আঁকা ‘দীক্ষা’ শিরোনামের জলরং। ছবিটি দেখে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হলেন রবীন্দ্রনাথ। জন্ম নিলো ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’ কবিতাটি। এরপর ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে ‘মডার্ণ রিভিউ’ পত্রিকায় সিস্টার নিবেদিতা অনুবাদ করলেন ‘কাবুলিওয়ালা’। সাথে ছাপা হলো নন্দলালের লাইন-ড্রয়িং এর ওয়াশ ( ৭ ইঞ্চি বাই ৫ ইঞ্চি) পুরো পাতা জুড়ে। একই বছর সাড়া জাগানো ‘ছিন্নপত্র’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ আঁকলেন নন্দলাল।

কবির সঙ্গে নন্দলালের প্রথম ভ্রমণ ছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে। সেবার বেশ কিছুদিন পদ্মার বোটে ছিলেন নন্দলাল বসু। তার বিখ্যাত স্কেচ পোকন মাঝি, জলকে চল, শীতের সন্ধ্যার পদ্মা তো পদ্মার বোটেই আঁকা। ১৯২৪ সালের ২১ মার্চ ‘ইথিওপিয়া’ নামের জাহাজে চেপে রবীন্দ্রনাথসহ বার্মা, চীন, জাপান ভ্রমণ করেছিলেন নন্দলাল বসু। যদিও ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান ভ্রমণে কবিগুরু জাপানী চিত্রকলা সম্পর্কে বিশদ ধারণা নেবার জন্য নন্দলালকে সাথে নেবার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু নেয়া হয়নি। ১৯২৪ সালের প্রাচ্য-ভ্রমণ নন্দলালের শিল্পদর্শনে গভীর ছায়া ফেলেছিল। প্রাচ্যের অংকনরীতির স্পর্শে নন্দলাল হয়ে উঠলেন আরো তীক্ষ্ণ। এই ভ্রমণের উপর ভিত্তি করে পৃথক পৃথকভাবে নন্দলালের ‘চীন-জাপানের চিঠি’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘চীন ও জাপানে ভ্রমণবিবরণ’ ছাপা হয়েছিল ১৯২৪ সালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় যথাক্রমে আশ্বিন ও কার্তিক সংখ্যায়। সেখানে নানা প্রসঙ্গে নন্দলালের লেখায় কবিগুরু সম্পর্কে আর কবিগুরু তার লেখায় বিধৃত করেছিলেন নন্দলাল’কে। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তখনো তার ইচ্ছে ছিল সাথে নন্দলাল বসুকে সাথে আনার। সে বছর ১০ জানুয়ারি রমেশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন এমন ভাবে "আপাতত এইটুকু বলে রাখছি আমাদের চিত্রকলাকুশল নন্দলাল বসুকে নিয়ে যাব, কালীমোহন ঘোষও যাবেন।’ কিন্তু সে যাত্রায় নন্দলাল শেষ পর্যন্ত আসতে পারেননি।"

একসময় মাসিক বৃত্তিতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে থেকেছিলেন প্রখ্যাত জাপানি মনীষী ওকাকুরা, হিশিদা, প্রখ্যাত জাপানিজ চিত্রকর টাইকান ও আনন্দকুমারা স্বামী। সে সময় জাপানি শিল্পের ধরন সম্পর্কে জেনেছিলেন নন্দলাল বসু। এর কিছুদিন পর আবার রবীন্দ্রনাথের আহ্বান। তিনি যোগ দিলেন রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা স্টুডিওতে। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় উঠে গেল বিচিত্রা স্টুডিও। ১৯১৯ সালে ফের রবীন্দ্রনাথের আহবান। সে বছরই রবীন্দ্রনাথ কলা ভবনের গোড়াপত্তন করেছিলেন। প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন অসিতকুমার হালদার। শান্তিনিকেতনে গেলেন বটে কিন্তু কিছুদিনের মাথায় আবার ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টে চিত্রকলার জন্য ডাকলেন গুরু অবনীন্দ্রনাথ। মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী কাজের অনুপ্রেরণায় চলতো সেই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখানে ভালো লাগলো না নন্দলাল বসুর। আবার ফের চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে।

এবার তো পাকাপাকিই। ১৯২২ সালে তাকে কলাভবনের অধ্যক্ষ করা হলো। এই দায়িত্বে থাকার সময় তার হাতে গড়ে উঠেছিল রামকিঙ্গর বেইজ, বিনোদবিহারীর মতো কিংবদন্তী শিল্পীরা। একটা জিনিস না বললেই না। তার ছাত্র বিখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ যখন বালি সিমেন্ট আড় কাঁকর দিয়ে পুরো শান্তিনিকেতনে একের পর এক ভাস্কর্য গড়ছেন তখন মাথায় ভেজা তোয়ালে আড় কেটলি হাতে চা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন নন্দলাল বসু।

শান্তিনিকেতন আশ্রমে ছাত্ররা তাকে ডাকতো মাস্টারমশাই বলে। শান্তিনিকেতনের আশ্রম থেকে একবার শিশু বিভাগ তুলে দেয়ার কথা উঠেছিল। প্রতিবাদ করলেন নন্দলাল। বললেন, "শিশুদের নিয়েই তো আমাদের আসল কাজ। শিশুরা না থাকলে আমরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাঁচবো না। প্রতিদিন অন্তত দেবদর্শন করা চাই আমাদের।" এমনই ভালোবাসতেন তিনি শিশুদের।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রাত জেগে পোস্টার আঁকতেন নন্দলাল। তার বাড়ির জানালার শিক আলগা করা থাকত। ছেলেরা এসে সে শিক উঠিয়ে ভিতরে ঢুকত। পোস্টার কোমরে বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে যেত। হরিপুরা কংগ্রেসে নন্দলাল বসুর কাজ তো একাধারে দেশপ্রেম ও শিল্পবোধের অসামান্য মেলবন্ধন। মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে হরিপুরা কংগ্রেসের মূল মঞ্চ সাজিয়েছিলেন তিনি। কাজ করতে করতে বাইরে চাটাই পেতে শুয়ে পড়তেন সকলে। লম্বা চাটাইতে পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধী ও নন্দলাল বসু শুয়ে। নন্দলাল বসু ভীষণ সংশয়ে থাকতেন, পাছে পা লেগে যায় মহাত্মা গান্ধীর  গায়ে! শান্তিতে ঘুমোতে পারতেন না। তার ছাত্ররা লক্ষ্য করেছিল, ওখানে কোনও নেতা এলে আগে থেকে ঘোষণা করা হত, ‘আ রহে হ্যায়’ এই আওয়াজে যারা গেট সামলাতেন, খুলে দিতেন। তো তখন নন্দলাল বসুর ছাত্ররাও তিনি আসা মাত্র, ‘নন্দলালজি আ রহে হ্যায়’ বলে চিৎকার করতেন। শান্তিনিকেতনের প্রতিটি উৎসবে তার উপস্থিতি তো বাধ্যতামূলক। উৎসবকে রঙ তুলিতে আলপনায় রাঙ্গিয়ে তোলার মূল দায়িত্ব তার। সে হোক প্রার্থনা গৃহের আলপনা, কিংবা মাঘ উৎসব, বসন্ত উৎসব, পৌষ মেলার নকশা, সমস্তেই।

ভারতের সর্বোচ্চ চার বেসামরিক পদক তথা ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী এই চারটির নকশা তো বটেই মানপত্রের সচিত্রকরণও তার হাতে তৈরি। ভারতের সংবিধানের মূল পাণ্ডুলিপিও নন্দলাল বসু ও তার ছাত্র রামমনোহর সিংহের হাতে আঁকা।

নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকা ছিল প্রার্থনার মতোই। যখন আঁকতে বসতেন তখন যেন‌ তিনি ধ্যানে বসেছেন। শোনা যায় ছবি আঁকতে বসলে তিনি নাকি পাত্রের জলে ফুল দিতেন, ধূপ জ্বালতেন তারপর আঁকতে বসতেন। এমনই অসামান্য এক স্রস্টা ছিলেন কিংবদন্তী চিত্রশিল্পী  শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু।

১৯৬৬ সালের ১৬ এপ্রিল চলে গিয়েছিলেন আধুনিক চিত্রশিল্পের পথিকৃৎ শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র:

মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু/ সম্পাদক: সুশোভন অধিকারী

নন্দলাল বসু ভারত শিল্পের পথিকৃৎ/ শোভন সোম ও দিনকর কৌশিক

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

আরও পড়ুন-

জাদুঘর থেকে চিত্রকলাকে যিনি পৌঁছে দিলেন মধ্যবিত্তের অন্দরে

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

14h ago