২১ এপ্রিল ১৯৭১: ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা, বিশ্ব নেতাদের ভাসানির চিঠি
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২১ এপ্রিল গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টদের কাছে গণহত্যা বন্ধের আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠান। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন মঠের বাঙালি হিন্দু সন্ন্যাসীদের উপর চালিয়েছিল নারকীয় গণহত্যা। পঞ্চগড় শহরও বাদ যায়নি হানাদারদের পৈশাচিকতার কবল থেকে।
২১ এপ্রিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশের এক মুক্তাঞ্চল থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, গণচীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন লাই, সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ, চেয়ারম্যান কোসিগিন ও প্রধানমন্ত্রী পদগর্নি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিডো, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আরব লীগের মহাসচিব আবদেল খালেক হাসুনা ও আরব ঐক্য সংস্থার মহাসচিব দায়লো টেলির কাছে পাঠানো পৃথক বার্তায় অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগের আবেদন জানান।
তিনি বলেন, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর উচিত বাংলাদেশে যে সামরিক বাহিনীর বর্বরতা চালাচ্ছে তা স্বচক্ষে দেখার জন্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক পাঠানো। তাদের উচিত বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের উপর যে ঘৃণ্য গণহত্যা চলছে তা অবলোকন করা।
ঢাকায় মুসলিম লীগ নেতা খান এ. সবুর সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতার জন্যে নিজ নিজ এলাকায় ভিজিলেন্স কমিটি গঠনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, শত্রুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সব ধরনের সাহায্য প্রদান বর্তমানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি কেবল জাতিসংঘেই নন, বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও বিদেশিদের বিবৃতি
এদিন লন্ডনের আইরিশ শ্রমিক দলের কর্মকর্তা ড. কোনার ক্রুইজ এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও প্রশাসন যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা সাম্রাজ্যবাদী ও দমনমূলক যুদ্ধের এক দৃষ্টান্ত।
আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপ ও পাকিস্তান সরকারের চালিত সামরিক অভিযানের উপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে তার এবং আলজেরিয়ার মানুষের।
ঢাকার বাইরে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা
ফরিদপুরের শ্রী অঙ্গন গণহত্যা
২১ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভোরবেলায় ফরিদপুরে গোয়ালন্দঘাটে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের পর সকাল ৯টায় গোয়ালন্দ ঘাট দখল করে হানাদারেরা। এরপর তারা ফরিদপুরে প্রবেশ করে গোলেখামোত এলাকার মধ্য দিয়ে। এদিকে হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরে ছত্রীসেনা নামায় পাকিস্তানিরা। গোলেখারমত দিয়ে যাওয়ার সময় শ্রীঅঙ্গন মঠে কীর্তন হচ্ছিল।
পাকিস্তানি হানাদারদের এদিক দিয়ে আসার খবর শুনে, কিছু আবাসিক সন্ন্যাসী মঠ থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু ৯ জন সন্ন্যাসী আশ্রম ছেড়ে যেতে প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে ক্যাপ্টেন জামশেদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার ও বিহারীরা মঠের সামনে এলে সন্ন্যাসীরা কীর্তনে মগ্ন ছিলেন। পাকিস্তানি হানাদারেরা কীর্তনরত সাধুদের হুকুম দিয়ে বলে ‘বাহার মে আও’। কিন্তু সাধুরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কীর্তন চালিয়ে যান। মন্দিরের প্রার্থনা সভায় কীর্তন গানে তখন গাওয়া হচ্ছিলো "জয় জগৎবন্ধু হরি! জয় জয় জগৎবন্ধু হরি।" বিহারিরা তখন পাকিস্তানি হানাদারদের বললো সন্নাসীরা বলছে "জয় বঙ্গবন্ধু। সন্ন্যাসীরা শেখ মুজিবুর রহমানের জয়ের আশায় চিৎকার করছে"। এরপর পাকিস্তান হানাদারেরা আশ্রম ঘেরাও করে। পাকিস্তানি হানাদারেরা এরপর প্রার্থনা সভায় প্রবেশ করে মন্দিরের পাশে চালতা গাছের নিচে মন্দিরের সামনে সন্নাসীদের উন্মুক্ত স্থানে টেনে নিয়ে যায়। নবকুমার ব্রহ্মচারী নামের এক সন্ন্যাসী পালিয়ে গিয়ে সিঁড়ির নিচে রুমে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বাকি ৮ জন সন্ন্যাসীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হানাদারেরা ব্রাশফায়ার করে। বারো রাউন্ড গুলি চালানো হয় কেবল এক সন্নাসীর উপরই। হত্যার পর পাকিস্তানি হানাদারেরা ও বিহারীরা আশ্রমের সিন্দুক ভেঙ্গে মূল্যবান জিনিসপত্র ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে সন্ন্যাসীদের লাশ ফরিদপুর পৌরসভার একটি ট্রাক নিয়ে যায়। ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ডায়নামাইট ব্যবহার করে শ্রীঅঙ্গন মঠের শিখর ধ্বংস করে দেয়।
অন্যদিকে এদিন ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর একটি দল যশোরে পাকিস্তানি হানাদারদের নাভারন ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে ১০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহত হয় আরও ১০ জন।
এদিন মেজর ইমামুজ্জামান এর নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য লাকসাম ত্যাগ করে কুমিল্লার মিয়ার বাজারে চলে এসে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলে।
২১ এপ্রিল দিনাজপুরের হিলিতে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী পিছু হটায় পাকিস্তানি হানাদারেরা হিলি দখল করে নেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের কিশোরগঞ্জ প্রতিরক্ষা ঘাঁটির ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে কিশোরগঞ্জের পতন হয়।
এদিন পাকিস্তানি হানাদারেরা দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড় শহর দখল করে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে, পুরো পঞ্চগড় বাজার পুড়িয়ে দেয়, বহু মানুষকে মহানন্দা নদীর পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ১৯৭১ এর ২১ এপ্রিল
২১ এপ্রিল শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার দিনলিপি একাত্তরের ডায়েরিতে লিখেছিলেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমির সঙ্গে রুমির মুক্তিযুদ্ধে যোগদান নিয়ে কথোপকথন সম্পর্কে। ছেলের জেদের সামনে তিনি কিভাবে হার মানলেন তাও দেখা মেলে তার ডায়েরিতে। তিনি লিখেছেন, “রুমীর সাথে ক’দিন ধরে খুব তর্কবিতর্ক হচ্ছে। ও যদি ওর জানা অন্য ছেলেদের মতো বিছানায় পাশ-বালিশ শুইয়ে বাবা-মাকে লুকিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যেত, তাহলে একদিক দিয়ে বেঁচে যেতাম। কিন্তু ঐ যে ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছি লুকিয়ে বা পালিয়ে কিছু করবে না। নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছি। রুমী আমাকে বুঝিয়েই ছাড়বে, সে আমার কাছ থেকে মত আদায় করেই ছাড়বে। কিন্তু আমি কি করে মত দেই? রুমীর কি এখন যুদ্ধ করার বয়স? এখন তো তার লেখাপড়া করার সময়। কেবল আই.এস.সি পাস করা এক ছাত্র, এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে, আবার আমেরিকার ইলিনয় ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতেও ওর অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। এই বছরের ২ সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে ক্লাস শুরু হবে। ওকে আমেরিকা যেতে হবে আগস্টের শেষ সপ্তাহে। সেখানে গিয়ে চার বছর পড়াশোনা করে তবে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। আর এই সময় সে কি না বলে যুদ্ধ করতে যাবে?
তুইতো এখানে পড়বি না। আই.আই.টি’তে তোর ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বরে, তোকে না হয় কয়েক মাস আগেই আমেরিকা পাঠিয়ে দেবো।
আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিনও মাখা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?
কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার উজ্জ্বল তারকা রুমী কোনদিনই বিতর্কে হারেনি প্রতিপক্ষের কাছে, আজই বা সে হারবে কেন? আমি জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললাম। “না, তা চাই নে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।”
তথ্যসূত্র -
৭১ এর দশ মাস/ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী
মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর/ আবু সাইদ খান
দৈনিক পাকিস্তান ২২ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম খণ্ড, নবম খণ্ড ও দ্বাদশ খণ্ড।
একাত্তরের দিনগুলি/ জাহানারা ইমাম
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
আরও পড়ুন:
সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে যিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজের প্রাণ
১৯ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা
১৮ এপ্রিল ১৯৭১: বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন
স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সূচনা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ
১৬ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার শপথের অপেক্ষা, ঢাকায় কারফিউ শিথিল
১৫ এপ্রিল ১৯৭১: নিভৃতে কেটেছে বাংলা নববর্ষ, ভয়ে-আতঙ্কে ঢাকা ছাড়ে মানুষ
১৩ এপ্রিল ১৯৭১: চারঘাট গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন
১২ এপ্রিল ১৯৭১: বালারখাইল গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন
১১ এপ্রিল, ১৯৭১: দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান তাজউদ্দীন আহমদের
Comments