হোম ডেলিভারি: মহামারিকালে ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান

Home Delivery.jpg

ঘরে বসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাবারদাবারসহ অনলাইনে কেনাকাটার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। যেটি করোনা মহামারির মধ্যেও অনেক কর্মহীন মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। গত এক বছরে প্রায় এক লাখ মানুষ অনলাইনে কেনা পণ্যের ডেলিভারি কাজের সুযোগ পেয়েছেন। 

খাদ্য সরবরাহকারী ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিপুল পরিমাণ অনলাইন অর্ডারের পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে হাজার হাজার ডেলিভারিপারসন নিয়োগ দিচ্ছে।

মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ঘরে বসে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কিনতে সহায়তা করছেন এসব ডেলিভারিপারসনরা।    

ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম মন্দাবস্থার কারণে যেখানে লাখ লাখ মানুষ কাজ হারাচ্ছেন, সেই পরিস্থিতিতেও নতুন করে কাজের সুযোগ পাওয়া তাদের জন্য বেশ স্বস্তিরও ব্যাপার। অর্ডার করা পণ্য নিয়ে তারা দলবেঁধে ছুটে যাচ্ছেন ডেলিভারি দিতে।

ডেলেভারিপারসন ফয়সাল হোসেন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম। গত বছরের মার্চ মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে সরকার দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এর ফলে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে আমার চাকরিটাও চলে যায়।’

‘এর কয়েকদিন পরে ফেসবুকে ইভ্যালির একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সেখানে আবেদন করলে ডেলিভারিপারসন হিসেবে কাজ পেয়ে যাই’, বলেন ফয়সাল।

তিনি আরও বলেন, ‘মহামারির প্রথম দিকে মানুষের বাসাবাড়িতে নিত্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজটা বেশ যুদ্ধের মতো ছিল, তবে আমরা সেটা করতে পেরেছিলাম।’

তিনি এখন প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২টি পণ্যের ডেলিভারি দিতে পারেন এবং প্রতিটি পণ্য ডেলিভারির জন্য তাকে দেওয়া হয় ৭০ টাকা করে। যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ টাকার মতো আয় করেন ফয়সাল।

দেশে যেখানে গড়ে ১০ জনের একজন যুবক বেকার, সেখানে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কারণে এ খাতে দিন দিন কাজের সুযোগ বাড়ছে।

২০১৬-১৭ সালের জনশক্তি জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, দেশের শ্রমবাজারে প্রায় দুই কোটির মতো তরুণ রয়েছে, যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে আবার প্রায় ২১ লাখ কর্মহীন।

মহামারির কারণে হোম ডেলিভারির চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়েছে উল্লেখ করে অনলাইনে পণ্য বিক্রেতারা বলছেন, একইসঙ্গে ই-কমার্সের জন্য বিশাল সম্ভাবনারও দুয়ার খুলে গেছে।

মহামারির আগে অনেক বেকার শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারে বা বাসায় প্রাইভেট টিউটর হিসেবে পড়িয়ে উপার্জন করতেন। করোনাভাইরাসের কারণে তাদের বেশিরভাগই কাজ হারিয়ে পণ্য ডেলিভারির কাজে যোগ দিয়েছেন।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ই-কমার্স সেক্টরে এক লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।’

ঢাকাসহ দেশের আটটি জেলায় ইভ্যালি ৭০০ জন স্থায়ী কর্মী নিয়োগ দিয়েছে, যাদের ৪৫ শতাংশ নারী। এ ছাড়া, গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে তারা পাঁচ হাজারের বেশি ডেলিভারিপারসন নিয়োগ দিয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে খাদ্য এবং বিলাসপণ্যও তারা ডেলিভারি করেন। 

ইভ্যালির প্রদান বিপণন কর্মকর্তা আরিফ আর হোসেন বলেন, ‘মহামারির সময়ে হাজার হাজার পণ্যের ডেলিভারি দিতে আমাদের এই জনশক্তি কাজে লাগাতে হয়েছিল।’

‘মূলত এই কঠিন পরিস্থিতিতে ই-কমার্সের মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতি টিকে আছে এবং অনেকে নতুন করে কাজেরও সুযোগ পাচ্ছেন’, বলেন আরিফ।

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, অধিকাংশ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বেশিরভাগ ডেলিভারিপারসন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। প্রতিটি ডেলিভারির জন্য তারা ২০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।

ফুড ডেলিভারি খাতে সবচেয়ে বড় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আছে ফুডপান্ডা। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০১৩ সালে দেশে প্রতিষ্ঠানটি চালু হওয়ার পর এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি।

গতবছর ফুডপান্ডা ফুড ডেলিভারি ছাড়াও সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘পান্ডামার্ট’র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ডেলিভারির জন্য অতিরিক্ত ১০ হাজারেরও বেশি ফ্রিল্যান্সার নিয়োগ দেয়, যারা নিয়মিত কাজ করছেন। এ ছাড়া, দেশের ৬৪ জেলায় তাদের ২০ হাজারেরও বেশি কর্মী রয়েছে।

ফুডপান্ডার একজন ডেলিভারিপারসন জানান, প্রতিটি ডেলিভারির জন্য তাদের ৩৮ টাকা করে দেওয়া হয়। তবে দূরত্ব বেশি হলে টাকার পরিমাণও বেড়ে যায়।

ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী কাজ করেন ডেলিভারিপারসন হিসেবে। তিনি জানান, দৈনিক তিন ঘণ্টা করে কাজ করলে গড়ে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা আয় করা যায়।

পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিসের একজন ডেলিভারিম্যান জানান, তিনি মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতনে সেখানে চাকরি করেন। এজন্য তাকে প্রতিদিন প্রায় ৩০টা করে পণ্য পৌঁছে দিতে হয়।

পাঠাওয়ের প্রেসিডেন্ট ফাহিম আহমেদ বলেন, ‘জীবিকার সংকটে পড়া কর্মীদের সঙ্গে লভ্যাংশ শেয়ারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পাঠাও। ফুড, কুরিয়ারি এবং পার্সেল ডেলিভারি এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে পাঠাও গত বছরে কয়েক হাজার কর্মীর কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।’

‘মহামারির মধ্যেও আমরা প্রায় এক হাজার কর্মী নিয়োগ দিয়েছি’, বলেন ফাহিম আহমেদ।

দেশের অন্যতম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দারাজ। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬০ হাজার পণ্য ডেলিভারি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। দারাজ জানায়, গত বছর তারা তিন হাজার ১৮৫ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এ ছাড়া, চলতি বছর নিয়োগ দিয়েছে আরও চার হাজার ৬৯ জন।

পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পেপারফ্লাই। ভারতের ই-কম এক্সপ্রেস যার বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক। প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান বিপণন কর্মকর্তা রাহাত আহমেদ জানান, মহামারির মধ্যেও প্রতিষ্ঠানটি এক হাজারের বেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির অন্যতম ই-কমার্সভিত্তক প্রতিষ্ঠান চালডাল জানিয়েছে, মহামারির সময়ে তাদের অর্ডারের পরিমাণ ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। এসব পণ্য সরবরাহ করতে তাদের নতুন করে ১ হাজার ২৫০ জন নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে তাদের কর্মী সংখ্যা এখন দুই হাজার ১০০ জন।

চালডালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াসিম আলিম বলেন, ‘ডেলিভারিপারসন ছাড়াও ওয়্যারহাউজ, প্রসেসিং ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলের জন্যেও আমরা কর্মী নিয়োগ দিয়েছি।’

গত বছর দেশের ই-কমার্স ও এফ-কমার্স প্লাটফর্মের অনলাইন পণ্য ডেলিভারির জন্য নতুন করে বেশ কিছু পণ্য সরবরাহকারী ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। যেখানে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

গত বছর প্রতিষ্ঠিত প্রভাতি কুরিয়ারের একজন ডেলিভারিপারসন জানান, তিনি মাসিক সাত হাজার টাকা বেতনে সেখানে চাকরি করেন। প্রতিদিন তাকে ৩০ থেকে ৩৫টি ডেলিভারি দিতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে দেশে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটেছে। এর ফলে নতুন করে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এটা বাড়তে থাকবে, মহামারি পরবর্তী সময়েও মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করবে, ফলে এ খাতে আরও বেশি কর্মসংস্থান হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ মাত্র ১০ শতাংশের বেশি, কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এই অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। তাই অনলাইনভিত্তিক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ খাতে আরও বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারের উচিত প্রণোদনা দেওয়া।’

তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, ‘এই খাতকে ন্যূনতম হলেও নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা উচিত, যাতে কর্মীরা কিছুটা হলেও সুরক্ষা ও সুবিধা পেতে পারেন।’

Comments

The Daily Star  | English

Doubts growing about interim govt’s capability to govern: Tarique

"If we observe recent developments, doubts are gradually growing among various sections of people and professionals for various reasons about the interim government's ability to carry out its duties."

13m ago