শ্রদ্ধাঞ্জলি

‘সন্ধ্যানদীর জলে’ ও কবি শঙ্খ ঘোষ

Shankha Gosh.jpg
কবি শঙ্খ ঘোষ ও তার ভ্রমণকাহিনী ‘সন্ধ্যানদীর জলে’। ছবি: সংগৃহীত

সন্ধ্যা নদী। বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অন্যতম প্রধান নদী। কবি শঙ্খ ঘোষের নাড়ি ছেঁড়া নদী। নিজ পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়া ছুঁয়ে আছে এই নদী। কবি এখানে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন।

বরিশালের কাউকে দেখলেই সন্ধ্যা নদীর জলে ফিরে আসার আকুতি জানাতেন কবি। ১৯৯৭ সালে কবি নিজ গ্রামে আসেন। এরপর ফিরে গিয়ে লিখেছিলেন এক ভ্রমণকাহিনী ‘সন্ধ্যানদীর জলে’। প্রথমা প্রকাশন ২০১৯ সালে বইটি বের করেছে। বইটির পরতে পরতে কবি তার দেখা সন্ধ্যা নদীকে তুলে এনেছেন বারংবার।

১৯৯৭ সালে কবির এই নিজ গ্রাম দেখার সময়ে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বানারীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ও বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত সুজন হালদার।

তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি কবিকে খাল ধরে নৌকায় সিনেমাহল সংলগ্ন জায়গায় নামতে, পরে তিনি নিজ ভিটে-বাড়িসহ বানারীপাড়ার স্মৃতিময় জায়গা ঘুরে দেখেন। এখন যেখানে আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জু মোল্লার বাড়ি, সে সংলগ্ন স্থানেই কবি নিজ ভিটে-বাড়ির অবশিষ্টাংশ খুঁজে পান। যাওয়ার সময় তিনি নিজ ভিটে-বাড়ির মাটি নিয়ে যান। পরে গত বছর মার্চ মাসে তার সঙ্গে কফি হাউসে আবার দেখা হয়। সেসময় তিনি বলেন, শরীরটা যদি একটু সুস্থ হয়, তাহলে আবার বানারীপাড়া যেতে চাই।’

গতবছর বাংলা একাডেমিতে কবির লিখিত ভাষণ পাঠ করেন রামেন্দু মজুমদার। সেখানেও লিখিত ভাষণের পরতে পরতে কবি নিজ পৈতৃক ভিটা, বিশেষ করে সন্ধ্যা নদীতে ফিরে আসার আকুতি জানান।

কবির মৃত্যুর পর এক ফেসবুক পোস্টে কবি টোকন ঠাকুর লিখেন, ‘কথা ছিল, আবার দেখা হবে, একসঙ্গে বরিশাল যাব...’

কবি নিজেই ‘সন্ধ্যানদীর জলে’ স্মৃতিকথায় বিধৃত করেছেন-

‘সন্ধ্যা ১৯৯৭-

মাইলফলক দেখেই যে এত রোমহর্ষণ হয়, তা কে জানত। পঞ্চাশ ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে চলেছি নিজের গ্রামে। বরিশাল শহর থেকে পাকা রাস্তা ধরে গাড়ি চলছে, আর ভাবছি এভাবে কি কখনো গিয়েছি আগে দেশের বাড়িতে? আমাদের তো বাহন ছিল নৌকা, আমাদের তো পথ ছিল খাল-বিল। কীর্তনখোলা, কীর্তিপাশা, কালিজিরা নদী পেরিয়ে এসে সেই ডাকাতিয়া-কালিজিরা, খালের মধ্য দিয়ে দেশের বাড়ি। ...

থামল গাড়ি নদীর ঠিক সামনে। হ্যাঁ, ওই তো বাজার। এক ঝাপে নেমে পড়ি। সঙ্গীদের পিছনে রেখে ছুটে যাই জলের একেবারে সামনে। সকাল বেলার আলোয় ঝলমল করছে সন্ধ্যা নদীর জল। স্টিমারঘাটা এখন আর নেই। আছে শুধু সারবাঁধা নৌকা। তারইমধ্যে এক নৌকায় উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান এক বৃদ্ধ। মাঝিরাও তাকিয়ে থাকে, জানতে চায় আমি কি ওপারে যেতে চাই? ...

এই নদী অনেক আত্মীয় নদী। এর কোনো ভাঙন-উল্লাস নেই, পঞ্চাশ বছরজুড়ে একই জায়গায় স্থির থাকতে পারে এর তীর।’

গোটা গ্রাম ঘুরে ফিরে আসেন তিনি এক স্মৃতিময়তা নিয়ে। আসার সময় নিজ ভিটে-বাড়ির মাটি নিয়ে যাত্রা করেন।

কবি তার ভ্রমণকাহিনীতে স্থানীয় একজনের কথাও লিখেছেন-

‘চার ঘণ্টা গোটা গ্রাম পায়ে হেটে বেড়াবার সেই সময়টা জুড়ে এক মুহূর্তও আর আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি জব্বর। এমন নয় যে তিনি পথ পরিচায়কের কাজ করছিলেন। সে কাজ কাউকেই করতে দিইনি আর। পশ্চিমে স্টিমারঘাটের সেই বিন্দু থেকে শুরু করে একেবারে পূবপ্রান্তে আমাদের ছেড়ে আসা বাড়িটা পর্যন্ত প্রত্যেক কোন আমার চেনা, পড়ে আছে যেন সেই পুরনো চেহারায়, কিছু বা ভগ্নাবশেষ হয়ে।

একে যে বিন্দুতে বিন্দুতে চিনি আমি। সবারই আগে চলে সেটা বোঝাতে চাইছিলাম। তবু জব্বর আমাকে ছুঁয়ে থাকলেন ঠিক সেইরকমই আলতোভাবে, সন্ধ্যা নদী যেভাবে ছুঁয়ে আছে আমাদের গ্রাম।’

সন্ধ্যা নদীর জল ছুঁয়ে যাওয়া কবি অসুস্থ ছিলেন কিছুদিন ধরেই। গত ১৪ এপ্রিল তার কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়ে। আজ বুধবার সাড়ে ১১টায় নিজ বাসায় ৮৯ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।

শঙ্খ ঘোষের আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পিতা মণীন্দ্র কুমার ঘোষ, মাতা অমলা ঘোষ। ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ায় কাটলেও পড়াশোনা করেছিলেন পাবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে।

এখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে শঙ্খ ঘোষ যাদবপুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ও যাদবপুর থেকেই ১৯৯২ সালে অবসর নেন।

কবি শঙ্খ ঘোষ শুধু নির্বিবাদে কবিতাই লিখে যাননি, সময়ের প্রয়োজনে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল তার কলম। বিশেষ করে নন্দীগ্রামে গুলির ঘটনায়, ভারতের নাগরিকত্ববিরোধী আন্দোলন কিংবা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বার বার কলম ধরেছেন তিনি। তার কাব্যসত্তার মধ্যেই প্রতিবাদী সত্তার এক অপূর্ব যুগলবন্দী লক্ষণীয়।

‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’, ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘জন্মদিনে’, ‘আড়ালে’, ‘সবিনয়ে নিবেদন’, ‘দিনগুলি রাতগুলি’ ইত্যাদি তার কবিতাগ্রন্থ। এ ছাড়াও, ‘শব্দ আর সত্য’, ‘উর্বশীর হাসি’, ‘এখন সব অলীক’ ইত্যাদি তার প্রবন্ধ গ্রন্থ। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তার অনবদ্য গবেষণা গ্রন্থ।

১৯৭৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরষ্কার, সরস্বতী সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম সম্মান ও ২০১১ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন কবি শঙ্খ ঘোষ।

Comments

The Daily Star  | English
Israeli strikes on Iran 2025

Israel launches major attack on Iran: what we know so far

‘Nuclear plant, military sites’ hit; strikes likely killed Iranian chief of staff, top nuclear scientists; state of emergency declared in Israel, fearing Iranian retaliation

5h ago