আইসিইউ শয্যা দুর্লভ, ভেন্টিলেটর যেন অধরা
হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) একটি শয্যা পাওয়ার চেষ্টা করাটা যে কতটা বেদনাদায়ক, এই মুহূর্তে শুধু গুরুতর অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীদের পরিবারের সদস্যরাই তা জানেন। সারা শহরজুড়ে আইসিইউ ওয়ার্ডগুলোতে এক বিন্দু জায়গাও খালি পাওয়া যাচ্ছে না। আর গুরুতর রোগীরা অপেক্ষমাণ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
কেউ যদি ইতোমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে না থাকে, তাহলে তার জন্যে সরকারি হাস্পাতালে আইসিইউ শয্যা পাওয়া যেন এক অলীক স্বপ্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউর বাইরে একাধিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার হয়েছে যে, একটি আইসিইউ শয্যা খুঁজে পেতে হলে অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ৩০-৩২ জন রোগী হাসপাতালটির ১০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউতে একটি শয্যা পাওয়ার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন।
একমাত্র বিকল্প হিসেবে আছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২৯টি বেসরকারি হাসপাতালের ৪৭৬টি আইসিইউ শয্যাকে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্যে তালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাটি আরও বেশি।
একটি আইসিইউ শয্যা খুঁজে পাওয়ার যে স্বস্তি, তার কোনো কিছুরই তুলনা হয় না।
এক্ষেত্রে হয়তো ধরে নেওয়া যায় যে, রোগীটি শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু, তারপর হয়তো দেখা গেল যে রোগীর পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং তার শরীরে টিউব ও ঘনীভূত অক্সিজেন প্রবেশ করানোর প্রয়োজন হচ্ছে। এ অবস্থায় হঠাৎ রোগীর পরিবার আবিষ্কার করলো যে তাদেরকে দেওয়া আইসিইউ শয্যার সঙ্গে ভেন্টিলেটর সুবিধা নেই।
তখন নতুন আরেকটি শয্যার জন্য আবারও খোঁজাখুঁজি শুরু হয়, শুরু হয় বিভিন্ন হাসপাতালে ফোন করার সেই ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা এবং তাদের প্রায় সবার কাছ থেকে একই উত্তর আসে— ‘কোনো শয্যা কিংবা ভেন্টিলেটর খালি নেই’।
যেকোনো হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর, সিপিএপি, বাইপ্যাপ ও হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাকে আবশ্যিক মেডিকেল যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্যে নির্দিষ্ট করা আইসিইউগুলোর পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। তবে সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহ্যবাহী হাসপাতালগুলো অথবা ফ্র্যাঞ্চাইজি হাসপাতালগুলো কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। সেখানে আইসিইউ শয্যার সমপরিমাণ ভেন্টিলেটর রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ: শমরিতা হাসপাতালে আটটি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে ১২টি ভেন্টিলেটর ও চারটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। কমফোর্ট হাসপাতালেও সমপরিমাণ আইসিইউ শয্যা ও ভেন্টিলেটর রয়েছে।
তবে, দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতারা ঢাকার ১৬টিরও বেশি বেসরকারি হাসপাতালে সরেজমিনে দেখেছেন, আইসিইউ শয্যার সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে ভেন্টিলেটরের মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্র যথেষ্ট পরিমাণে নেই।
সত্যি কথা বলতে গেলে, ভেন্টিলেটর সংকট সারা বিশ্বজুড়েই তীব্র এবং গত বছর মহামারি শুরু হওয়ার পরে প্রথমবারের মতো এর ব্যাপক চাহিদার বিষয়টি বোঝা গিয়েছিল।
উত্তরার হাই-কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপক (হাসপাতাল ও ব্যবসায়িক উন্নয়ন) মীর ওমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের কাছে কোভিড রোগীদের জন্য ১০টি আইসিইউ শয্যা, পাঁচটি ভেন্টিলেটর ও ছয়টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। প্রতিদিন হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার খোঁজে প্রায় ১৫টির বেশি ফোন আসে। কিন্তু, তাদেরকে খুব কম সময়ই আমরা এই সেবাটি দিতে পারি।’
‘তিনদিন ধরে চেষ্টা করার পর মাত্রই একজন রোগী ভর্তি হলেন’, গতকাল জানিয়েছেন ফারুক।
কাছেই অবস্থিত শিন-শিন জেনারেল হাসপাতালে আছে ছয়টি আইসিইউ শয্যা ও দুটি ভেন্টিলেটর। কিন্তু, সেখানে কোনো হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা নেই বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম। ‘যদি রোগীর হঠাৎ ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হয় এবং কোনোটি সে মুহূর্তে খালি না থাকে, তখন তারা আমাদের কাছে বিকল্প খুঁজলে আমরা তাদেরকে অন্য জায়গায় রেফার করে দেই’, বলেন তিনি।
ক্রিসেন্ট হাসপাতালের তথ্য-সেবা ডেস্ক থেকে জানা গেছে, সেখানে ২৫টি আইসিইউ শয্যায় থাকলেও মাত্র ১০টি ভেন্টিলেটর ও ১০টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
গ্রিন রোডের ধানমন্ডি ক্লিনিকের আইসিইউ বিভাগের প্রধান জানান, সেখানে ১৭টি আইসিইউ শয্যা থাকলেও মাত্র সাতটি ভেন্টিলেটর ও পাঁচটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
বিজয় সরণির কিওর স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক রবিউল আলম শাহীন জানান, সেখানে আটটি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে পাঁচটি ভেন্টিলেটর ও পাঁচটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
এই অমিল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আইসিইউ শয্যাগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করার জন্যে সম্পূর্ণ অপারেশন থিয়েটার বন্ধ করে দিয়েছি।’
প্রতিদিন হাসপাতালটি ২০টি ফোন পায়। কিন্তু, তারা সবাইকে সেবা দিতে পারে না। গত সপ্তাহে হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডে ভর্তি দুই জন রোগী আইসিইউ শয্যার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
নিউ লাইফ হাসপাতালের ব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ ও প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সেখানে ১০টি আইসিইউ শয্যা, আটটি ভেন্টিলেটর ও চারটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সেলিম রেজা জানান, তাদের হাসপাতালে ছয়টি আইসিইউ শয্যার সঙ্গে চারটি ভেন্টিলেটর ও তিনটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা যুক্ত রয়েছে। ‘আমরা প্রতিদিন ২০টির মতো ফোন পাই। কিন্তু, সবাইকে সাহায্য করা অসম্ভব। একটি শয্যা খালি হলে তাতে পুনরায় রোগী ভর্তি হতে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন ঘণ্টার মতো লাগে’, জানান তিনি।
এএমজেড হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যা, আটটি ভেন্টিলেটর ও আটটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
হাসপাতালের তথ্যসেবা ডেস্কের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি বলেন, ‘প্রতিদিন আইসিইউ শয্যার খোঁজে আমরা রোগীদের কাছ থেকে দুই শর বেশি ফোন পাই। আমাদের ওয়ার্ডে দৈনিক দুই থেকে চার জন রোগীর আইসিইউ শয্যার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।’
বেটার লাইফ হাসপাতালে ২৪টি আইসিইউ শয্যা থাকলেও সেখানে ১২টি ভেন্টিলেটর ও মাত্র দুটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের উপ-পরিচালক তানভীর উদ্দিন আহমেদ।
ধানমন্ডি জেনারেল ও কিডনি হাসপাতালের প্রশাসন বিভাগের পরিচালক শামীম মাহবুব জানান, সেখানে সাতটি আইসিইউ শয্যা, পাঁচটি ভেন্টিলেটর ও দুটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেশিওলজিস্টের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেস্থেশিয়া, অ্যানালজেসিয়া ও নিবিড় পরিচর্যা মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, ‘যদি একটি শয্যায় ভেন্টিলেটর না থাকে, তবে এটি আইসিইউ শয্যা হিসেবে বিবেচিত হবে না। যতগুলো শয্যা থাকবে, ততগুলো ভেন্টিলেটর থাকতে হবে।’
দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতা যে হাসপাতালগুলোতে গিয়েছেন, তার প্রায় সবগুলো থেকেই জানানো হয়েছে যে, তারা বেশি ভেন্টিলেটরের মজুত রাখছে না। কারণ সব রোগীদের যান্ত্রিক ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হয় না। তবে, অনেক বিশেষজ্ঞই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ কথার সঙ্গে একমত নন।
কুর্মিটোলা হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের পরিচালক শাহজাদ হোসেন মাসুম বলেন, ‘একজন রোগীর অবস্থা কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই গুরুতর হয়ে যেতে পারে। তাই আইসিইউ শয্যায় শুধু ভেন্টিলেটর থাকাটাই আবশ্যক নয়, বরং কিছু বাড়তি ভেন্টিলেটরও মজুত থাকা উচিত, যাতে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলেও সমস্যা না হয়।’
‘হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাও খুবই জরুরি। প্রথমে আমাদেরকে রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার জন্যে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার মাধ্যমে নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। এ চেষ্টা ব্যর্থ হলে যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন প্রক্রিয়ায় যেতে হয়’, বলেন অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক।
উপরে উল্লেখিত একটি হাসপাতালের আইসিইউতে যথেষ্ট পরিমাণে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা না থাকা সেখানে চিকিৎসাধীন এক নারী রোগী ও তার পরিবার ভোগান্তিতে পড়েতে হয়েছিল। গত ১০ এপ্রিল ওই নারীর মৃত্যু হয়। তার পরিবারের অভিযোগ, রোগীর অক্সিজেন ঘনত্বের পরিমাণ কমে যাওয়ার পর তাকে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে সরাসরি টিউবের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল। যথেষ্ট পরিমাণে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা না থাকার কারণেই এটি করা হয়েছিল।
রোগীর ছেলে বলেন, ‘আমরা অন্যান্য হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চেয়েছি যে, তার কি প্রকৃতপক্ষে লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন ছিল কি না এবং সবাই জানিয়েছেন যে তাকে আগে নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন দেয়া উচিত ছিল।’
রোগীর পরিবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকায় এ প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালটির নামও গোপন রাখা হয়েছে।
Comments