আমার মা সারাহ বেগম কবরী: একজন অতিমানবীর প্রতি শ্রদ্ধা

এ সপ্তাহের শুরুর দিকে- একটি নিশ্চুপ গ্রীষ্মের রাতে যখন পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে, তখন জাতি এক কিংবদন্তীকে হারায়। সারাহ বেগম কবরী নিঃশব্দে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেত্রী, রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবী। দুর্বিনীত ভাইরাসের কষাঘাতে লাখো ভক্তের মন ভেঙে গেল এবং একটি প্রজন্ম একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বকে হারাল। তার মতো কিংবদন্তীকেও বিদায় জানাতে হলো এবং এ মহামারির হাত ধরেই ঘটলো তার বর্ণাঢ্য জীবনের যবনিকাপাত।
সারাহ বেগম কবরী। ছবি: সংগৃহীত

এ সপ্তাহের শুরুর দিকে- একটি নিশ্চুপ গ্রীষ্মের রাতে যখন পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে, তখন জাতি এক কিংবদন্তীকে হারায়। সারাহ বেগম কবরী নিঃশব্দে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেত্রী, রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবী। দুর্বিনীত ভাইরাসের কষাঘাতে লাখো ভক্তের মন ভেঙে গেল এবং একটি প্রজন্ম একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বকে হারাল। তার মতো কিংবদন্তীকেও বিদায় জানাতে হলো এবং এ মহামারির হাত ধরেই ঘটলো তার বর্ণাঢ্য জীবনের যবনিকাপাত।

এসব কিছুর মধ্যে যেটা নজর এড়িয়ে গেছে, মা হারা পাঁচ সন্তানের যন্ত্রণা। আমি সেই দুর্ভাগাদের একজন; আমি উনার দ্বিতীয় সন্তান। সেদিন, আমিও সমগ্র জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে শোক প্রকাশ করেছি। আমি মনে মনে অনেকগুলো ছবির তালিকা দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই দীর্ঘ তালিকায় রয়েছে বিশ্বের অসংখ্য তারকাদের নাম, যারা ভক্তদের হতবাক করে দিয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। হঠাৎ আমার মা-ও সে তালিকার অংশ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যখন চারপাশের শোরগোল কমে আসবে এবং গণমাধ্যম অন্যান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, তখনও আমরা বিশ্বাস করতে পারবো না যে আমাদের মা আর নেই, আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। এই শূন্যতার চিরস্থায়িত্বকে অনুধাবন করতে আমাদের বেশ সংগ্রাম করতে হবে। মেনে নিতে হবে অপরিবর্তনশীল এ মৃত্যুকে, এর আজীবনের প্রভাবকে।

আমাদের সাথে কী ঘটেছে তা অনুধাবন করতেও আমি সংগ্রাম করছি। আর আবেগের আতিশয্যে অভিভূত হচ্ছি। সত্য বলতে গেলে, দুঃখবোধের সাতটি পর্যায়কে একশোটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ের মতো করে অনুভব করছি। এই আবেগগুলো বর্ণনাতীত। তাকে আর কখনো দেখবো না, এ সত্যটি অনুধাবন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

একটি করে দিন যাচ্ছে, আর আমি আমাদের জীবনের সে মুহূর্তগুলো স্মরণ করছি, যখন আমরা সবাই সুখী ছিলাম এবং একে অপরের সান্নিধ্য উপভোগ করতাম। সুসময়ের স্মৃতিগুলো ছাড়া আর কী-ই বা আছে ধরে রাখার মতো? পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, এ রকম অসংখ্য-অসাধারণ মুহূর্ত রয়েছে। আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো সব সময় হাসি ও ঠাট্টায় মেতে থাকতো। আমার মা তার হাসি এবং অসামান্য ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে যে কোনো জায়গাকে আলোকিত করতে পারতেন। তিনি জানতেন কীভাবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে হয় এবং আমরা একসঙ্গে এমন সব অসাধারণ স্মৃতি তৈরি করেছি, যা মনে করেই সারা জীবন পার করে দেওয়া যাবে।

যখনই সবাই একত্র হতাম, আমরা জাদুকরী সময় কাটাতাম। প্রতিটি মুহূর্তই হয়ে উঠতো মূল্যবান এবং প্রতিটি কথোপকথনই অর্থবহ হতো। জীবন, সমাজ, ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে তার ভাবনাগুলোকেই আমরা মূলত আমাদের জীবনযাত্রার পাথেয় হিসেবে ধারণ করেছি। আমাদের ব্যক্তিত্বের ওপর তার প্রভাব অনস্বীকার্য। তিনি সব সময় গরিব, হতভাগ্য, বিশেষত যারা নিজেদের জন্য তেমন কিছু করতে পারেনি তাদের রক্ষাকর্তা ছিলেন। সমাজসেবা, বিশেষত দাতব্য কাজে যেন আমরা অংশ নিই তিনি সব সময় আমাদের উৎসাহিত করতেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারটি তার দেওয়া শিক্ষার একটি মূলস্তম্ভ ছিল। আমি আজও সেই চেতনা গর্বের সঙ্গে ধারণ করি।

তিনি আমাদের কঠোর পরিশ্রমের গুরুত্ব শিখিয়েছেন। নিজের কাজের ক্ষেত্রে সেরাটা দিতে চাইতেন। ক্লাস প্রজেক্ট থেকে শুরু করে বছর শেষে পাওয়া ফলাফল পর্যন্ত প্রতিটা ক্ষেত্রে আমরা যেন আমাদের সেরাটা দিই সেই তাগিদ দিতেন। আমরা লক্ষ রাখতাম, সেরাটা না হলেও যেন ভালো ফলাফল আসে। জ্ঞানের অন্বেষণ অপরিহার্য একটি ব্যাপার, এই কথাটি তিনি আমাদেরকে সব সময় মনে করিয়ে দিতেন। আমাদের জীবনের সব অর্জন তার কাছ থেকে পাওয়া উৎসাহ ও উদ্দীপনার ফসল।

কেবলমাত্র বাইরে গেলেই আমরা টের পেতাম আমাদের মা একজন খ্যাতিমান তারকা। বিশেষত সত্তরের দশকে। তাকে ঘিরে মানুষের বিশাল ভিড় জমে যেত। আমরা প্রায়ই অভিভূত হয়ে যেতাম। এ রকম একদিন আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের গাড়িকে চারপাশ থেকে প্রায় কয়েকশ ভক্ত ঘিরে রেখেছিল। কিছুতেই সামনে এগুতে পারছিলাম না। আমার এখনো সে মুহূর্তটি পরিষ্কার মনে আছে, তার মুখে ফুটে উঠলো হৃদয়হরণ করা সেই হাসি।

তিনি ভক্তদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। ভক্তরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মুহূর্তের মধ্যে তিনি একজন মমতাময়ী মা থেকে জাতীয় তারকা হয়ে উঠছেন। আমি উপলব্ধি করলাম কী চমৎকারভাবে তিনি দুটি জগতের সমন্বয় করে চলেছেন। তিনি শুধু আমার মা ছিলেন না— প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন আমার সুপারহিরো।

আমাদের আশৈশব তিনি নিশ্চিত করেছেন আমাদের চোখ যেন সব সময় মাটির দিকে থাকে। তারকাখ্যাতি আমাদের জীবনকে সেভাবে প্রভাবিত করেনি। প্রতিবেশী যেসব শিশুদের সঙ্গে আমরা বেড়ে উঠেছি, আমাদের জীবন তাদের মতোই সাধারণ ছিল। আমাদের কোনো দামি গাড়ি ছিল না, আমাদের যাপিত জীবনে উন্মাদনা ছিল না, ভোগবিলাসে নিমজ্জিত থাকার প্রবণতাও ছিল না। আমার মনে আছে, যখন বাড়িতে তারকাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো, তখন আমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জেগে থাকার অনুমতি পেতাম। এরপর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে চলে যেতাম। আমার মায়ের সহকর্মীরা দেশবাসীর কাছে বড় তারকা হিসেবে পরিচিত হলেও আমাদের কাছে ছিলেন শুধুই ‘আংকেল’ ও ‘আন্টি’।

সব মিলিয়ে বলা যায়, আমাদের কাছে তিনি শুধুই মা ছিলেন; একজন নানামুখী প্রতিভার অধিকারী মা। তিনি সব সময় আমাদের পাশেই আছেন, এ কথাটির ওপর জোর দিতেন। আমার এখনো মনে পড়ে, আমরা অসুস্থ থাকলে বা অন্য কোনো কারণে বাসায় থাকার প্রয়োজন পড়লে তিনি তার ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের যত্ন নেওয়ার জন্য ঠিকই সময় বের করে নিতেন। তিনি একসঙ্গে তার কাজ এবং আমাদের প্রতি দায়িত্বগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে চলতেন। এ ব্যাপারটি আমাদের খুব কম বয়সেই সমাজে নারীর ভূমিকা বুঝতে এবং তাদের প্রতি সম্মান জানাতে শিখিয়েছে।

সন্তানদের প্রতি মায়ের ছিল নিঃশর্ত ভালোবাসা ও স্নেহ। তার জীবনকে তিনি তার পেশা এবং জাতির জন্য নিবেদন করেছেন। একইসঙ্গে তিনি তার সন্তানদের প্রয়োজনগুলো আলাদা করে মিটিয়েছেন। তার অসম্ভব ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যেও তিনি আমাদের স্কুলের নাটক দেখতে আসতেন, ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলোতে আমাদের নিয়ে যেতেন, আমাদের প্রিয় খাবারগুলো রান্না করতেন, পোশাক কিনতে আমাদের বাজারে নিয়ে যেতেন এবং যত রাতই হোক, বাড়ি ফিরে আমাদের কপালে চুমু দিতো। আমি দেখতে পাই, তিনি আমার হাত ধরে আছেন এবং আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তার সৌম্য হাসিটি দিয়ে জানাচ্ছেন কতটা ভালোবাসেন তিনি আমায়। তিনি আমার মা, তিনি আমার কাছে কোনো মহাতারকা কিংবা কিংবদন্তী নন, শুধুই একজন মমতাময়ী মা যিনি তার সন্তানদের ভালোবেসে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তার আচরণে আমরা প্রত্যেকে এই বিষয়টি বুঝতে পারতাম। পাঁচজনই জানতাম, আমরা তার হৃদয়ের গভীরে আছি। তিনি আমাকে অনেক আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও ভালোবাসা নয়। তিনি বলেছিলেন, ভালোবাসা ইহজগতের বন্ধনকে ছাড়িয়ে যাবে, কেননা ভালোবাসা চিরন্তন।

আমি এটি কখনোই ভুলবো না। কালের প্রবাহে অনেক স্মৃতি ফিকে হয়ে যাবে কিন্তু আমাদের সবার জন্য তিনি যে ভালোবাসা ধারণ করতেন, তা আমি কখনো ভুলবো না। যে সময়টি তিনি আমাদের দিয়েছেন, তা অনেক মূল্যবান এবং যে ভালোবাসা তিনি আমাদের ভালোবাসায় আমাদের জড়িয়ে রেখেছিলেন তা একজন মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সন্তানের শ্রেষ্ঠ উপহার। ধন্যবাদ মা, তোমার ধৈর্যের জন্য, তোমার দিকনির্দেশনার জন্য এবং সব কিছুকে ছাপিয়ে তোমার চিরন্তন ভালোবাসার জন্য।

রিজওয়ান চৌধুরী, সদ্য-প্রয়াত বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরীর দ্বিতীয় সন্তান।

আরও পড়ুন:

Comments

The Daily Star  | English
government changed office hours

Govt office hours 9am-3pm from Sunday to Tuesday

The government offices will be open from 9:00am to 3:00pm for the next three days -- from Sunday to Tuesday -- this week, Public Administration Minister Farhad Hossain said today

2h ago