বিদায় শ্রাবণ!
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/rathord.jpg?itok=xhAt3o0O×tamp=1619189286)
চলে গেলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী ও সংগীত পরিচালক শ্রাবণ কুমার রাঠোর। করোনার কাছে হার মেনে মুম্বাইয়ের মহিমের একটি হাসপাতালে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আশিকি খ্যাত এই সংগীত পরিচালক।
বলিউড সিনেমার বিখ্যাত সংগীত পরিচালক জুটি নাদিম-শ্রাবণের একজন এই শ্রাবণ। নিজে একা কাজ করার চেয়ে কৈশোরের বন্ধু নাদিম আক্তার সাইফির সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করতেন। ১৯৯০ এর দশকে এই জুটির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। ভারতের সীমা ছাড়িয়ে সেই জনপ্রিয়তা পৌঁছে যায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশে।
আশিকি সিনেমার মাধ্যমে ১৯৯০ সালে এই জুটি জনপ্রিয়তা পেলেও তারা কাজ শুরু করেন আরও আগে থেকেই।
শ্রাবণের সঙ্গে নাদিমের পরিচয় হয় ১৯৭৩ সালে মুম্বাইয়ের একটি অনুষ্ঠানে। তখন তারা দুজনই ১৯ বছরের তরুণ। এরপর তারা জুটি বেঁধে কাজ শুরু করেন ভোজপুরি সিনেমা ‘দঙ্গল’-এ। ১৯৭৩ সালে কাজ শুরু করলেও এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালে। বলিউডে কাজের সুযোগ পান ১৯৮১ সালে ‘ম্যায়নে জিনা সিখ লিয়া’ সিনেমায়। এরপর ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করলেও আলোচনায় আসেন ১৯৯০ সালে আশিকি সিনেমার মাধ্যমে।
সিনেমাটির গান এতোটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, রাতারাতি এই জুটি বিখ্যাত হয়ে যায়। আশিকি সিনেমার গানের অ্যালবাম ২০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়, যা ‘অল টাইম বেস্ট সেলিং বলিউড অ্যালবাম’ হিসেবে রেকর্ড অর্জন করে। যে রেকর্ড এখনো ভাঙেনি।
এরপর ১৯৯১ সালে ‘সাজন’ ও ‘ফুল আউর কাটে’, ১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’, ‘দিল কা কেয়া কসুর’, ‘দিল হ্যায় কা মানতা নেহি’, ১৯৯৩ সালে ‘হাম হায় রাহি পেয়ারকি’, ‘রং’, ১৯৯৪ সালে ‘দিলওয়ালে’, ১৯৯৫ সালে ‘রাজা’, ‘বারসাত’; ১৯৯৬ সালে ‘অগ্নি সাক্ষী’, ‘জিত’, ‘রাজা হিন্দুস্ততানি’, ১৯৯৭ সালে ‘পারদেশ’, ১৯৯৯ সালে ‘স্রিফ তুম’ এবং ২০০০ সালে ‘ধাড়কান’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডের সংগীতাঙ্গনে রাজত্ব করেছেন এই জুটি।
তারা কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন অনেকবার। আশিকি, সাজন ও দিওয়ানা সিনেমার জন্য ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পর পর তিন বার ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর অ্যাওয়ার্ড’ পান। ১৯৯৭ সালে আরও একবার এই পুরস্কার পান রাজা হিন্দুস্তানির জন্য। এ ছাড়া, ১৯৯৮ সালে পারদেশ সিনেমার জন্য ‘স্টার স্ক্রিন বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর অ্যাওয়ার্ড’ পান এবং ২০০৩ সালে রাজ সিনেমার জন্য ‘জি সিনে বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর অ্যাওয়ার্ড’ পান।
শুধু পুরস্কারের সংখ্যা বিচারে এই জুটির জনপ্রিয়তা এবং অবদান বিচার করা যাবে না। বলিউডের প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত শিল্পীই এই জুটির সুর করা গান গেয়েছেন। এদের মধ্যে কুমার শানুর আবির্ভাব হয় আশিকি সিনেমার মাধ্যমে। অনুরাধা পাড়ওয়াল, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অলকা ইয়াগনিক, উদিত নারায়ণ, বিনোদ রাঠোর, মোহাম্মদ আজিজ, অমিত কুমার, পংকজ উদাস, সাধনা সারগম, সুরেশ ওয়াদেকার, পূর্ণিমা, হরিহরণ, জাসপিন্দার নারুলাসহ অনেক গুণী শিল্পী গেয়েছেন এই জুটির সুর করা গান।
তাদের সুর করা ‘আব তেরে বিন জিলেঙ্গে হাম’, ‘মেরা দিল ভি কিতনা পাগল হ্যায়’ ও ‘সোচেঙ্গে তুমহে পেয়ার করতা’ গেয়ে কুমার শানু ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সালে পর পর তিনবার ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মেইল সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড’ পান। অবশ্য ১৯৯৪ এবং ১৯৯৫ সালেও তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন।
শ্রাবণের সুর করা সাজন সিনেমার গান ‘দেখা হ্যায় পেহেলি বার’ খুবই জনপ্রিয় একটি গান। এ ছাড়া, আশিকি সিনেমার ‘সাসোকি জরুরত জ্যায়সে’, ‘নজরকি সামনে জিগারকি পার’, সাজন সিনেমার ‘জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে’, দিওয়ানা সিনেমার ‘এইসে দিওয়ানগি’, দিল কা ক্যায়া কসুর ছবির ‘মেরা সনম’, ‘মিল নে কি তুম কোসিস কর ন ‘, হাম হয় রাহি পেয়ারকি ছবির ‘কাস কোয়ি লাড়কি’, ‘ঘুংঘাটকি আড় সে’, দিলওয়ালের ‘জিতা থা জিসকে লিয়ে’, অগ্নি সাক্ষীর ‘ও ইয়ারা দিল লাগানা’, রাজা হিন্দুস্তানির ‘পারদেশি পারদেশি’, ধাড়কানের ‘তুম দিলকি ধাড়কান ম্যায়’, ‘না না করতে পেয়ার হ্যায় ম্যায়’, পারদেশ সিনেমার ‘ইয়ে দিল দিওয়ানা’, ‘দো দিল মিল রাহা হ্যায়’ গানগুলো এখনো শ্রোতাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে।
নাদিম-শ্রাবণ জুটির সুর করা অসংখ্য গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কুমার শানু। তার অসাধারণ গায়কী দিয়ে এই জুটির সুর করা বেশিরভাগ গান পোঁছে দিয়েছেন সাধারণ শ্রোতাদের অন্তরে।
এই জুটির একজন আজ এই জগতে নেই। তিনি পাড়ি দিয়েছেন অন্য এক জগতে। মাত্র ৬৮ বছর বয়স এই মহাজগতের তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু, এই অল্প সময়ে তিনি তার মেধা এবং শ্রম দিয়ে উপমহাদেশের সংগীতকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন— তা অনন্য। সবচেয়ে বড় কথা আপামর মানুষকে তিনি সুরের জাদুতে মোহাবিষ্ট করেছেন।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে— মিউজিক ইজ দ্য বেস্ট হিলার। সংগীত সবকিছুকে ভুলিয়ে দেয়। সুর সমস্ত অসুরকে বিনাশ করে। তাই শ্রাবণ কুমার রাঠোরের মতো একজন গুণী সংগীত পরিচালকের প্রয়াণ সংগীতাঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। করোনা আরও একজন গুণী মানুষকে কেড়ে নিলো। বিদায় শ্রাবণ!
অরুণ বিকাশ দে, সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments