মহামারিতে চালের দাম ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে
মহামারির মধ্যে চালের দাম যে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা জেনেও খাদ্য মন্ত্রণালয় সরকারের খাদ্য মজুদ রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে নাই।
যেখানে সরকারি গুদামে চালের মজুদ হওয়া উচিত অন্তত সাড়ে ১২ লাখ টন সেখানে চাল এসে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ১০ লাখ টনে। ২০০৮ সালের পরে চালের মজুদ এত নিচে আর নামে নাই। এটা যথেষ্ট উদ্বেগের ব্যাপার।
আমাদের দেশে গেল অর্থ বছরে খাদ্য শস্যের চাহিদা ছিল ৩ দশমিক ৫৮ কোটি টন।
তার মানে প্রতি মাসে কমবেশি ৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন হয়। সেখানে আমাদের সরকারের স্টোরেজ ক্যাপাসিটি হচ্ছে মাত্র ১৯ লাখ টন। আরও কিছু সাইলো আর গুদাম তৈরি হচ্ছে। সেগুলোর কাজ শেষ হলে এই মজুদ ক্ষমতা যেয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৪ লাখ টনে।
সরকার যদি তার সমস্ত গুদামে খাদ্যশস্য মজুদ রাখে সেটা দিয়ে সারা দেশের মানুষকে খাওয়াতে চায় তাহলে সারা দেশের মানুষকে তিন সপ্তাহও খাওয়াতে পারবে না।
সুতরাং সরকার যে খাদ্য মজুদ করে সেই মজুদ থেকে দেশের সব জনগণকে খাওয়াতে হবে সে জন্য না। এই মজুদের উদ্দেশ্য মূলত দুটি—
প্রথমত: সরকারের যেসব বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে খাবার জোগান দেওয়ার কর্মসূচি আছে যেমন— ভিজিডি, ভিজিএফ বা ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বা কাজের বিনিময়ে খাদ্যের কর্মসূচিতে চালের যোগান দেওয়া।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে— বাজারে চালের দাম বেড়ে গেলে মার্কেট ম্যানুপুলেট করে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন, বেশি বেশি ওপেন মার্কেট সেল চালু করা। তাতে করে বাজারে চালের চাহিদা কমবে, ফড়িয়ারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ইচ্ছে মতো দাম বাড়াতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে দুর্যোগপূর্ণ দেশ। প্রতিবছরই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হয় বন্যা নয় সাইক্লোন বা অতিবৃষ্টি, খরা বা লবণাক্ততার কারণে কোনো না কোনো অঞ্চলে ফসল নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।
এক মৌসুমে হয়তো হাওড়ে আকস্মিক বন্যা হলো, তো তার পরের বছর হয়তো ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’র মতো দুর্যোগে উত্তরাঞ্চলের বা চলন বিলের ফসল নষ্ট করে দিয়ে গেল। এবার তো অনাবৃষ্টি আর হিট ওয়েভের কারণে ধানের ফুল পুড়ে গেল।
সে জন্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দেশের খাদ্যমজুদ যদি ২৪ বা ২৫ লাখ টন থাকে সেটা খুব ভালো। তবে এই মজুদ ১৫ লাখ টনের বেশি থাকলে নিরাপদ। আর সেটা যদি সাড়ে ১২ লাখ টনের নিচে নামে, তাহলে বাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করবে।
ঠিক সেই ব্যাপারটাই এবার ঘটেছে। এই অর্থবছরের শুরুতে জুলাইয়ের ১ তারিখে খাদ্যশস্য মজুদ ছিল ১১ লাখ টনের একটু বেশি।
এখন চালের মজুদ এসে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ টনের মতো। চাল ও গম মিলিয়ে মজুদ রয়েছে সাড়ে চার লাখ টনের মতো।
যেহেতু সরকারের মজুদ ক্রমাগত কমছে সেহেতু মহামারির এই সংকটকালে চালের দামও ক্রমাগত বাড়ছে। গত এক বছরে খোলা বাজারে মোটা চালের দাম ১৩ থেকে ১৪ টাকা বেড়ে ৪২ টাকা থেকে ৪৫ টাকা হয়েছে।
কিন্তু, সত্যি বলতে কী গত বোরো মৌসুম পর্যন্ত দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি ছিল না। গত বছর আমাদের প্রয়োজন ছিল ৩ দশমিক ৫৮ কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। আমাদের উৎপাদন হয়েছে ৩ দশমিক ৬০ কোটি টন।
আমরা গত মৌসুমেই ইন্দোনেশিয়াকে পিছনে ফেলে তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ হয়েছি। গত বছর আমাদের ঐ অর্থে কোনো আমদানি করতে হয়নি। আমরা বলতে গেলে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম। অর্থাৎ, উৎপাদন ও ভোগ ছিল প্রায় সমানে সমান।
কিন্তু, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যখন আমাদের গত আমন মৌসুম মার খায়, তখন সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান চাল সংগ্রহ করার যে উদ্যোগ নেয় তা ব্যর্থ হয়।
কারণ, ধান ও চালের যে উৎপাদন মূল্য তার চেয়ে কম মূল্যে ধান-চাল কেনার দাম ধার্য করে সরকার। চাল ৩৬ টাকা ও ধান ২৬ টাকা। কিন্তু, কৃষকের উৎপাদন মূল্যই হচ্ছে ধান প্রায় ২৭ টাকা ও চাল ৩৬ টাকার একটু বেশি। সুতরাং প্রায় ৮ লাখ টন কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করলেও সরকার কিনতে পেরেছ মাত্র ৮৫ হাজার টন। কারণ মিলার ও কৃষক সরকারি গুদামের চেয়ে বাজারে বেশি দাম পাচ্ছিল। এটাও মজুদ কম হওয়ার একটা বড় কারণ।
আমাদের প্রায় ২০ লাখ টন খাদ্য আমদানি করা দরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয় তা আগেই জানতো। তা বুঝতে পেরেছিল গত ডিসেম্বরে। সরকারি পর্যায়ে ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত হয় ভারত, ভিয়েতনাম, রাশিয়া ও ক্রোশিয়া থেকে। কিন্তু, সরকার এই আমদানি প্রক্রিয়াতে অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলে— প্রায় চার মাস। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে মাত্র ২ দশমিক ৬২ লাখ মেট্রিক টন ও বেসরকারিভাবে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে।
সরকার যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি করে চাল আনার উদ্যোগ নিতেও অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলে।
আর যারা আমদানির অনুমতি পেয়েছে তারা বেশিরভাগই মাঝারি চাল ব্যবসায়ী বা প্রকৃত আমদানিকারক না। তারা চাল আমদানি করে আশানুরূপ লাভ করতে পারেন নাই। তাই তারা প্রথমে কিছু চাল আমদানির পর আর পরের কিস্তি আমদানি করতে চাচ্ছেন না। এটাও আমদানি কম হওয়ার একটা কারণ।
ফলে ধীরে ধীরে মজুদ সংকট দেখা দিয়েছে। এটা আগেই বুঝতে পেরে সরকার তার কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে খাদ্যশস্যের বদলে সমপরিমাণ নগদ অর্থ দিচ্ছে বেশ কয়েক মাস ধরে। সীমিত আকারে ওএমএস, ভিজিড, ভিজিএফ কর্মসূচি চালু রেখেছে।
সরকারের মজুদে চাল নেই বুঝতে পেয়ে চাল ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। সরকার বুঝতে পেরেও মোকাবিলা করতে পারল না— এটি অবশ্যই উদ্বেগের ও এই মহামারির সময়ে এই ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।
এমন পরিস্থিতি হতে পারে গত কয়েক মাস ধরে সরকার তা জানতো। কিন্তু জানার পরও সেটা ঠিক মতো সামলে নিতে পারে নাই। এই করোনাকালে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৩ থেকে ১৪ টাকা। যখন মানুষের কাজ নাই, নিয়মিত আয় নাই, ভাড়াটিয়ারা ঘর ভাড়া দিতে পারছে না, সেখানে এই বাড়তি দামে চাল কেনা খুবই কষ্টের।
কিন্তু, সৌভাগ্যের বিষয় হলো বোরো ধান বাজারে আসা শুরু করেছে। সরকারও সাড়ে ১১ লাখ টন চাল ও সাড়ে ছয় লাখ টন ধান কেনার উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষকের যা উৎপাদন মূল্য তার চেয়ে এক টাকা বেশি দামে চাল কেনা হবে। ধানের ব্যাপারেও একই রকম সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন ধান ও চালের যে উৎপাদন মূল্য তার চেয়ে এক টাকা বেশি দাম ধরলে সরকারের ধান চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। এতে করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে সরকারের গুদামে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল যোগ হবে।
তবে তারা কৃষকের কাছ থেকে আরও বেশি ধান কেনার কথাও বলেছেন। তাতে করে সরকারের গুদামে চাল জমা হবে। আবার প্রান্তিক কৃষক তার ধানের দাম পাবে। ধান কেনা শুরুর সম্ভাব্য তারিখ ২৮ এপ্রিল আর চাল কেনা শুরু হতে পারে মে মাসের ৭ তারিখ থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যেহেতু বোরো ধান বাজারে এসেছে তাই খাদ্য ঘাটতির কোনো সম্ভাবনা নাই। কারণ বোরো ধান দিয়ে ৫০ ভাগেরও বেশি খাদ্যশস্যের চাহিদা পূরণ হয়। সুতরাং, এখন থেকে সামনের দিনগুলোতে ক্রমান্বয়ে অবস্থার উন্নতি হবে। বাজারে চালের দাম কমে আসবে। সেটা তরান্বিত হবে সরকার যদি মজুদ থেকে এক লাখ টন চাল খোলা বাজারে ছেড়ে দেয়।
পিনাকী রায়, প্রধান প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments