হুজির নিয়ন্ত্রণে হেফাজত?

পুলিশসহ বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ (হুজি) ফিরে এসেছে। এবার এটি সংগঠিত হয়েছে হেফাজতের বেশ ধরে।
গত ২৮ মার্চ বায়তুল মোকাররমের সামনে হেফাজতের মিছিল। ছবি: পলাশ খান/স্টার

পুলিশসহ বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ (হুজি) ফিরে এসেছে। এবার এটি সংগঠিত হয়েছে হেফাজতের বেশ ধরে।

‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে’ গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত টানা তিন দিন হেফাজত দেশজুড়ে যে তাণ্ডব চালায়, তার সঙ্গে হুজির যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা জানান, ‘এটা আসলে হুজির পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড ছিল।’

বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন কয়েকজন সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনার পর ২০০৫ সালে হুজিকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও ওই হামলায় ২২ জন নিহত হন। এক বছর আগে থেকে হেফাজতের ছায়ায় আবারও সংগঠিত হতে শুরু করে হুজি। সম্প্রতি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির ওপর কিছুটা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে তারা।

ইসলামের প্রচার-প্রসার নিয়ে কাজ করা মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম হেফাজত ২০১৩ সালের পর থেকে দ্রুতই রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী একটি দলে পরিণত হয়। ফলে হুজি, জেএমবি ও আনসার আল-ইসলামের মতো চরমপন্থি ইসলামী সংগঠনগুলো হেফাজতে যোগ দিয়ে এর ছায়ায় আবারও সংগঠিত হতে শুরু করে।

তদন্তকারীরা জানান, সম্প্রতি গঠিত হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে হুজির বেশ কয়েকজন নেতা পদ পাওয়ার পর সংগঠনটির ওপর হুজির প্রভাব বাড়তে শুরু করে। কিছুদিন আগে যেই সহিংসতায় ১৭ জন নিহত হলেন, তা হুজিই উসকে দিয়েছিল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা শাখা) মাহবুব আলম কিছুদিন আগে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তদন্তে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে হেফাজতের যোগসূত্র থাকার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। ধর্ম-ভিত্তিক এই সংগঠনটির সঙ্গে আফগানিস্তানফেরত একটি দল ও জামায়াত-শিবিরের কিছু সদস্য যুক্ত হয়েছে।’

হুজি নেতারা ‘আফগান যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার জানান, আফগানিস্তানফেরতদের এই দলটি হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনে। তারাই মূলত হেফাজতের বেশ ধরে ধ্বংসাত্মক কাজগুলো করেছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে তাদের (আফগানিস্তানফেরত) চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিন দিনের ওই সহিংসতায় কয়েক ডজন সরকারি স্থাপনা, রেলওয়ে স্টেশন, পুলিশ স্টেশন ও ফাঁড়িতে হামলা চালায় হেফাজত কর্মীরা।

হুজি কী চায়

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হেফাজতের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীকে হুজির পছন্দ হচ্ছে না। কারণ তিনি তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করছিলেন না।

তারা এমন একজনকে হেফাজতের শীর্ষ পদে দেখতে চায়, যিনি সরকারের প্রভাবের বাইরে গিয়ে কাজ করতে সক্ষম হবেন এবং একইসঙ্গে হেফাজতের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হাটহাজারী মাদ্রাসার দায়িত্ব নিতে পারবেন।

তিন দিনের তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের ১৬টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ওপর। পিবিআই জানিয়েছে, তারাও এই সহিংসতার সঙ্গে হুজির সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে।

তদন্তের দায়িত্বে থাকা পিবিআইয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হেফাজতের ছদ্মবেশে হুজি তাদের সদস্য নিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

নাম গোপন রাখার শর্তে পিবিআইয়ের আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে এমন অন্তত একজন হেফাজত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যিনি আসলে হুজির কার্যক্রম পরিচালনা করতেন বলে পরে জানা গেছে। চট্টগ্রামের লালখান বাজারের একটি মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডেইলি স্টারের হাতে আসা একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হেফাজতের সদ্যবিলুপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির ২৪৯ জন সদস্যের মধ্যে অন্তত আট জন হুজির সাবেক সদস্য কিংবা জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, গত ২৪ মার্চ চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হেফাজতের চার জনের মৃত্যু হওয়ার পর হুজির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দলটির নেতারা কোনো ধরনের ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহতদের মরদেহ নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করেন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের উপ-কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম জানান, তাদের তদন্তেও দেখা গেছে, হেফাজতের কমিটিতে হুজির কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন পদে রয়েছেন।

‘হুজির সদস্যরা নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে এখন হেফাজতের ব্যানার ব্যবহারের চেষ্টা করছেন’, বলেন তিনি।

আরেকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হেফাজতের প্রায় ডজনখানেক নেতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে আরেক জঙ্গি সংগঠন আনসার-আল-ইসলামের।

জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে হেফাজতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি, চট্টগ্রাম রেঞ্জ) আনোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে প্রকৃত চিত্র পাওয়ার চেষ্টা করছি।’

সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও হেফাজতের সাম্প্রতিক তাণ্ডবের সঙ্গে হুজি ও জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ইঙ্গিত দেন।

তবে, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গত ১২ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে দাবি করেন, হেফাজতের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই।

‘জঙ্গিবাদের সঙ্গে হেফাজতের কোনো নেতারই কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই। এ বিষয়ে যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে, তাহলে সরকার কেন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে না?’, বলেন তিনি।

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে Is Huji taking over Hefajat?

Comments

The Daily Star  | English
Islami Bank's former managing director Abdul Mannan

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago