২৭ এপ্রিল ১৯৭১: কালীগঞ্জে গণহত্যা, ইপিআরের নাম পাল্টে ইপিসিএফ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৭ এপ্রিল ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউজ লন্ডনে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় যে গণহত্যা চলছে তা ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক। ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করা হচ্ছে।’ নীলফামারীর জলঢাকার কালীগঞ্জে এদিন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চালায় নির্মম গণহত্যা। এই গণহত্যায় শহীদ হন চারশর বেশী মানুষ। এদিন ইপিআরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইপিসিএফ। ঢাকায় পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ ১৪৮ নম্বর সামরিক বিধি জারি করে। দেশের নানান জায়গায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা সংগঠিত হয়, মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলে তীব্র প্রতিরোধ।
ঢাকায় ২৭ এপ্রিল
পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল তথা ইপিআরের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘পূর্ব পাকিস্তান বেসামরিক বাহিনী’ বা ইপিসিএফ।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ. রহিম খান ঢাকা আসেন। ঢাকায় তিনি সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে বিমান হামলা সম্পর্কে কৌশল নির্ধারণ করেন।
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ১৪৮ নম্বর সামরিক বিধি জারি করে। এ আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহায়তাকারীদের গণহারে শাস্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। এ আদেশে কোনো কারণ ছাড়াই কেবল সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে চরম শাস্তির লাইসেন্স দেওয়া হয় ঘাতকদের। এমনকি, যে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তৎপরতা চালাবে সে এলাকার লোকদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা লাভ করে দালালরা।
বিদেশি গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ২৭ এপ্রিল
ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস লন্ডনে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় যে মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর গণহত্যা চলছে, তা অবিশ্বাস্য। ঢাকায় ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করা হচ্ছে। সেখানে তাদের সামরিক বাহিনী যে কাজ করছে, তা নিঃসন্দেহে গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ভোটাররা যে ভোট দিয়েছেন, তা ফলাফলেই চাক্ষুষ প্রমাণ মিলে। আর এখন সামরিক জান্তা সরকার গণতান্ত্রিক রায়কে উপড়ে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি কি আদৌ উপেক্ষা করা যায়? ব্রিটিশ সরকারের উচিৎ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন ও পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত সামরিক জান্তা দ্বারা পরিচালিত গণহত্যা নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান প্রদর্শন করা। এই মুহূর্তে আমাদের চুপ করে বসে থাকা উচিৎ নয়।’
২৭ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের ডেইলি মিরর পত্রিকায় ব্রিটিশ এমপি উড্রো ওয়াটের একটি উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে লিখেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় এখনো লন্ডন, হাউজ অব কমন্স নীরব কেন? কেন এখনো পাকিস্তানের এমন পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে না? ভিয়েতনাম যুদ্ধে যারা মার্কিনী হামলার প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন দূতাবাসে যারা হামলা করতে পারেন, বিন্দুমাত্র সময় নেন না তারা আজ কোথায় গেলেন? আজ যারা বৈশ্বিক শান্তির কথা বলেন, পরমাণু অস্ত্র বর্জনের কথা বলেন, তাদের প্রতিবাদ তো চোখে পড়েনি। তারা এখন কি ঘুমিয়ে আছেন? কোথায় লুকিয়ে আছেন? পূর্ব পাকিস্তানে চলমান গণহত্যা ও নির্যাতন তো পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়ে বিপজ্জনক। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা নিয়ে তো কাউকে মুখ খুলতে দেখিনি। ব্রিটিশ সরকারের উচিৎ অবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া।
ডেইলি মিরর এবং বিবিসি ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি বৃহৎ গণমাধ্যমে ২৭ এপ্রিল বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বিদেশি রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতিবিদদের বিবৃতি
ভারতীয় সোশালিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা এস এম যোশী এদিন এক বিবৃতিতে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে পারে, তার জন্য ভারত সরকারের উচিৎ অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। যদি ভারতীয়রা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে আসে তবে দীর্ঘদিনের ভারতীয় মমত্ববোধ এবং দায়িত্বশীলতা প্রকাশ পাবে। একইসঙ্গে রক্ষা পাবে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
এদিন হাউজ অব কমন্স অধিবেশনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ সচিব স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বলেন , ‘১৯৬৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটেনের কোনো প্রকার নতুন অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। তিনি এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।’
২৬ এপ্রিল সুইডেনের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আয়োজিত সম্মেলন উপলক্ষে আসা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও প্রশাসন কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে চালানো গণহত্যা নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে অভিযোগ উত্থাপনের দাবি জানান।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এদিন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ভারত কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। তবে ভারতের ওপর অন্য কোনো দেশ আক্রমণ করলে বা যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে তবে ভারত বসে থাকবে না। এর কঠোর জবাব দিতে বাধ্য হবে।’
দেশের বাইরে সাধারণ মানুষের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
২৭ এপ্রিল কলকাতায় পাকিস্তানের নতুন ডেপুটি হাইকমিশনারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। ডিপুটি হাইকমিশনার পরে পুলিশি সাহায্যে কলকাতা শহর ছেড়ে পুলিশের এক মেসে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণ করেন। যদিও আন্দোলনকারীরা খবর পেয়ে সেই বাড়ির সামনে গিয়েও পাকিস্তানী হানাদারদের গণহত্যা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এদিন নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর প্রতি ঐকমত্য, সংহতি ও সমর্থন প্রকাশ করে। তারা বলেন, নেপাল সরকারের উচিৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি এবং গণমানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করা। একইসঙ্গে নেপালের ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিসের ন্যাশনাল কমিটি বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারদের দ্বারা সংগঠিত বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, নিপীড়নের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ করতে আহ্বান জানায়। একইসঙ্গে তারা বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের উচিৎ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের রায় মেনে নেওয়া এবং অবিলম্বে স্বাধীনতা প্রদান করা।
ঢাকার বাইরে গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ:
কালীগঞ্জ গণহত্যা দিবস
২৭ এপ্রিল নীলফামারীর জলঢাকার কালীগঞ্জ বাজারে নির্মম গণহত্যা চালায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। জলঢাকা থানা থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ছোট বাজার কালীগঞ্জ। এদিন চারশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সমবেত হয় কালীগঞ্জ বাজারে। এই সময় স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় খবর পেয়ে চারটি কনভয় করে প্রায় ত্রিশ জনের মতো হানাদার বাহিনীর সৈন্য এসে কিছু বুঝে উঠার আগেই ব্রাশফায়ার করে নিরীহ মানুষদের ওপর। মুহূর্তেই শহীদ হন চারশোর বেশী নিরীহ মানুষ। আহত যারা ছিলেন তাদেরকে একটি গর্তে মাটিচাপা দিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদাররা।
২৭ এপ্রিল কুমিল্লার মিয়াবাজারে পাকিস্তানী হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর বহু সৈন্য নিহত হয়।
খাগড়াছড়ির রামগড় দখলের জন্য চট্টগ্রামের হিকুয়ায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদারদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষেরই বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
২৭ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদারেরা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে নোয়াখালী, সান্তাহার ও মৌলভীবাজার দখল করে।
পাকিস্তানী হানাদারদের কমান্ডোরা মিজো গেরিলাদের নিয়ে ২৭ এপ্রিল মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। এইসময় ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের গোলাগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছুটে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকেন, যেন অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুবেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। গোলাগুলির একপর্যায়ে শত্রুর লাইট মেশিনগানের গুলিতে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের শহীদ হন।
পাকিস্তানী হানাদারেরা এদিন জনতার প্রতিরোধ ভেঙে কক্সবাজারের চকরিয়ায় প্রবেশ করে চিরিঙ্গার হিন্দুপাড়ায় ঢুকে গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বী শহীদ হন।
মৌলভীবাজারের বড়লেখার শাহবাজপুরে পাকিস্তানী হানাদারদের ওপর সফল আক্রমণ চালায় লেফটেন্যান্ট মোরশেদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর একটি দল। অতর্কিত এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন হানাদার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। এরপর লেফটেন্যান্ট মোরশেদসহ মুক্তিবাহিনীর সেই দলটি মাধবপুরে ফিরে আসে।
২৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সীমান্ত দিয়েই অজস্র মানুষ ভারতে আশ্রয়ের জন্যে ভারতে প্রবেশ করে। এদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যে নতুন নতুন প্রচুর আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম, নবম ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক
আরও পড়ুন:
১১ এপ্রিল, ১৯৭১: দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান তাজউদ্দীন আহমদের
১০ এপ্রিল: মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস
Comments