সম্প্রদায়ের সেতুবন্ধনে কাজী আবদুল ওদুদের ভূমিকা

বাংলা অঞ্চলে দশকের পর দশক চলছে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার সংকট। চিন্তাশীল মানুষের অভাব, না পরিস্থিতি বৈরী তা তর্ক সাপেক্ষ। তবে এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ চালাতে একজন বুদ্ধিজীবীকে চারটি চাপ সহ্য করতে হয়— প্রথমত, কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া, যা একজন বুদ্ধিজীবীর উত্তেজনা ও আবিষ্কারের প্রত্যয়কে দমিয়ে রাখে; দ্বিতীয়ত, বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিক বিভাজন; তৃতীয়ত, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, ক্ষমতা কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রয়োজন ও সুবিধার প্রতি তীব্র ঝোঁক এবং চতুর্থত, পেশাদারিত্ব…
Kazi Abdul Wadud
কাজী আবদুল ওদুদ

বাংলা অঞ্চলে দশকের পর দশক চলছে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার সংকট। চিন্তাশীল মানুষের অভাব, না পরিস্থিতি বৈরী তা তর্ক সাপেক্ষ। তবে এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ চালাতে একজন বুদ্ধিজীবীকে চারটি চাপ সহ্য করতে হয়— প্রথমত, কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া, যা একজন বুদ্ধিজীবীর উত্তেজনা ও আবিষ্কারের প্রত্যয়কে দমিয়ে রাখে; দ্বিতীয়ত, বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিক বিভাজন; তৃতীয়ত, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, ক্ষমতা কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রয়োজন ও সুবিধার প্রতি তীব্র ঝোঁক এবং চতুর্থত, পেশাদারিত্ব…

এডওয়ার্ড সাঈদের এ মতবাদ প্রকাশিত হলে ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সে ঢেউ এশিয়াতেও লাগে। কথাগুলো দীর্ঘদিন পর প্রাসঙ্গিক মনে হলো কাজী আবদুল ওদুদকে নিয়ে লিখতে বসে। তিনি আমাদের চিন্তার আদর্শ, নতুন ধারণায় শিখিয়েছেন সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে দায় ও দায়িত্বসহ ভাবতে। হিসাব করে বলা যায় তিনি প্রকৃতার্থে একজন প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, সমাজচিন্তক ও বুদ্ধিজীবী। এসবের মধ্য দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে ভেবেছেন। নিবিড়ভাবে ভূমিকা রেখেছেন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সেতু বন্ধন তৈরিতে। প্রচলিত সমাজ ও জীবনাচারের অসারতাকে বাদ দিয়ে জাগিয়ে তুলতে জীবনোৎসর্গ করেছেন। বিশেষ করে, বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম পুনর্জাগরণের অন্যতম অগ্রপথিক ঢাকার প্রথম প্রগতির মাইলফলক ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের’ সংগঠক হিসেবে ছিলেন অনবদ্য।

কাজী আবদুল ওদুদ গতানুগতিক ভাবনার বাইরে সমাজ ও সম্প্রদায়ের নানা সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন। মিলনের মনোভাব গড়ে তুলতে মননশীল সাহিত্যচর্চাকেই জরুরি মনে করেছিলেন তিনি। ফলে প্রগতিশীল যুক্তিবাদী আবদুল ওদুদের সারথি হয়েছিলেন অনেকে। যেমন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, মোহিতলাল মজুমদার, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, আবুল হুসেন, কাজী আনোয়ারুল করিম, আবদুল কাদির প্রমুখ।

সমন্বিত আঙ্গিনায় সৃজনশীল মানুষের বিচরণ রাতারাতি বাড়তে দেখা যায়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতাকেন্দ্রিক রেনেসাঁও এমনটি ছিল। যেমন– যুক্তি ও মননশীলতায় সামাজিক মুক্তির জন্য কাজ করেছেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ।

প্রসিদ্ধ এ কৃতী ব্যক্তির পরিচয় দিতে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, ‘কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন জাতিতে ভারতীয়, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে মুসলমান, জীবনদর্শনে মানবিক, মতবাদে রামমোহনপন্থি, সাহিত্যে গ্যেটে ও রবীন্দ্রপন্থি, রাজনীতিতে গান্ধী ও নেহরুপন্থি, অর্থনৈতিক শ্রেণিবিচারে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, সামাজিক ধ্যানধারণায় ভিক্টোরিয়ান লিবারেল। কোনরূপ চরমপন্থায় তার বিশ্বাস ছিল না।’

আমরা এ কথার প্রমাণ পাই ১৯১৯ সালে প্রকাশিত প্রথম ‘নদীবক্ষে’ উপন্যাসেই। পদ্মাপাড়ের বাগমারা গ্রামে বড় হয়ে ওঠা ওদুদ তুলে ধরেছিলেন উত্তাল পদ্মার বুকে মাঝিদের সংগ্রামমুখর জীবন ও সাধারণ কৃষকদের চালচিত্র। প্রান্তিক মানুষের জীবনের দুঃখ-বেদনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা গ্রামীণ কৃষি জীবনের যে ছবি তিনি এঁকেছেন তা অনবদ্য। প্রশংসিত হয়েছে অনেক।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ওদুদের উপন্যাসের বিষয়বস্তুর নতুনত্ব, মাধুর্য ও সহজিয়া সুর পাঠককে মুগ্ধ করে। এইভাবে আলোড়ন তুলে।’

পরবর্তীতে, ওদুদের মুগ্ধতায় গবেষক উত্তম কুমার রায় ‘কাজী আবদুল ওদুদ: জীবন ও সাহিত্যকর্ম’ (বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়) অভিসন্দর্ভে তার সাহিত্যকর্ম মূল্যায়ন করেছেন।

খ.

ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোতে কাজী আবদুল ওদুদের জন্ম। যেকোনো মুক্ত পাখির জন্য পরাধীনতার শিকল অসহনীয়। তখনো আত্মপরিচয় নিয়ে দোলাচলে থাকা জাতি। দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষে জর্জরিত সমাজ। মানুষের মাঝে দেখেছেন অহেতুক চিন্তা- বিশেষ করে রক্ষণশীলতা, পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কার। যা আধুনিক সমাজের জন্য বাধা। অন্যদিকে, ব্রিটিশ শাসন কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজের আত্ম-আবিষ্কারের পথকে সুগম করে দেয়। আর সেই সময় বাঙালি মুসলমান আত্মসংকট মীমাংসায় দ্বিধান্বিত থাকে। কালক্রমে বিশ শতকে বাঙালি মুসলমান সমাজকে চারপাশ থেকে উজ্জীবিত করে নতুন আলো।

আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে ওদুদ লিখেন-

পিতা ছিলেন বুদ্ধিতে একান্ত খেয়ালী, কিন্তু অতি স্নেহময় অন্তঃকরণের, আত্মীয় স্বজনের দুঃখ আদৌ সহ্য করতে পারতেন না। আয় সামান্য কিন্তু পরিজনদের দান করতে মুক্তহস্ত। কিন্তু এই ঢিলেঢালা মানুষটির আত্মসম্মানবোধ ছিল অসাধারণ। রেলওয়েতে চাকরি করতেন সাহেবদের সঙ্গে মারামারি করে চাকরি ছেড়েছেন বহুবার। দরিদ্র আত্মীয়দের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতেন। বড়লোক আত্মীয়দের গ্রাহ্য করতেন না। আমার মা ছিলেন দৃঢ় চরিত্রের ও প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন, কিন্তু কর্তৃত্ব ও অবিলাসিনী। বাবা আমার বুদ্ধিমত্তা পছন্দ করতেন। কিন্তু আমি যে শান্তশিষ্ট এটি খুব পছন্দ করতেন বলে মনে হয় না। (আমার জীবন কথা/ কাজী আবদুল ওদুদ)

আত্মমর্যাদার পরিবারে নানা গল্পে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষ করেন ওদুদ। তারপর কিছুদিন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে (কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে) বসবাস করেন। সেখানে কবি-সাহিত্যিকদের আনাগোনা- আড্ডা হতো। আড্ডায় অংশ নিতেন যুদ্ধ-ফেরত কাজী নজরুল ইসলামও। আড্ডা-সূত্রে নজরুলের সঙ্গে পরিচিত হন কাজী আবদুল ওদুদ। কিশোর বয়সে লেখালেখি শুরু করা ওদুদ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যে আরও অনুপ্রেরণা পান। এখানে পরিচয় হয় পরবর্তী জীবনের কর্মযোগী প্রতিথযশা চিন্তাবিদ আবুল হুসেনের সঙ্গে। পরিকল্পনা করেন নতুন কিছু করার। তার আগে প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই পাটাতনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে শুরু হয় জ্ঞান আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার সংগঠন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। এটি ছিল মুক্তচিন্তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শুরু হয় প্রগতির নতুন যাত্রা।

এর সভ্যরা যে কেবল মুসলিম ছিলেন, তা নয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার, মোহিতলাল মজুমদারসহ আরও বহু অমুসলিম মনীষী ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’র সভায় অংশ নিয়েছেন এবং ছিলেন ‘শিখা’র লেখক তালিকায়। সংগঠনের স্লোগান রাখেন ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামটি রাখার দুটো কারণের কথা উল্লেখ করা রয়েছে। প্রথমত, বাঙালি মুসলিম সমাজের কাছে রেনেসাঁর বাণী তথা মানুষ-কেন্দ্রিক ইহ-জাগতিক বাস্তবতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার কথা তুলে ধরা; দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের মাধ্যমে অবহেলিত মুসলমান সমাজের জীবন-ভাবনা সঠিকভাবে চিত্রিত করা যা ওদুদের মতে মেধাবী হিন্দু সাহিত্যিকরা করতে পারেননি।

সেসময়ে পারস্যের কবি শেখ সাদি, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসি, হাফিজ ও জালাল উদ্দীন রুমি প্রমুখের উদার মানবতাবাদী ও লৌকিক ভাবনা-সমৃদ্ধ কাব্য সম্ভার তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে।

মুসলমান সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা আর হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় সাধনা করতে গিয়ে ওদুদকে সারা জীবন লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে— তার নিজের সমাজ থেকে তো বটেই বাইরে থেকেও। রক্ষণশীল সমাজের কাছে নিগৃহীত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলামও। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’র এক সভায় বক্তব্য রাখার সময় তা নিয়ে বিদ্রূপও করেন তিনি। নজরুল বলেন, ‘আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নতুন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব। আর একটা কথা- এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে, মৌলভী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ কতগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে, এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।’

রবীন্দ্রনাথ চিনেছিলেন ওদুদকে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-বিভীষিকার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাকে দু’কূলের সেতু হিসেবে দেখেছিলেন। ওদুদের সমাজ ও সাহিত্য গ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ প্রবন্ধ পড়ে বিশ্বকবি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সমালোচকদের মধ্যে আপনিই প্রথম সাহিত্যে এই লিরিকগুলির যথার্থ স্থান নির্দেশ করে দিয়েছেন সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ।’

১৯৩৫ সালে কবির আমন্ত্রণে ওদুদ বিশ্বভারতীতে ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’ বিষয়ে তিনটি বক্তৃতা দেন। সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতামালা পরে বই হয়ে প্রকাশিত হয় বিশ্বভারতী থেকে, রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা সমেত। আজকের দিনে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস ও অসম্প্রীতির এই সময় ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’, ‘শাশ্বত বঙ্গ’, ‘পথ ও বিপদ’, ‘আজিকার কথা’, ‘নজরুল প্রতিভা’, ‘বাংলার জাগরণ’সহ তার লেখাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

গ.

আবুল হুসেন, আবুল ফজল, আবদুল ওদুদের মুক্তবুদ্ধির কারণে যখন সমাজ-রাষ্ট্র তথা তারুণ্যের শক্তি বিকশিত হচ্ছিল তখনি তিনি ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হন। তাদের কাজ ক্ষমতাসীনরা ভালোভাবে নেয়নি। কোনো শাসক মুক্তচিন্তাকে গ্রহণ করতে পারে না। তাতে তাদের ‘অসুস্থ কাজ’ বাধাগ্রস্ত হয়।

তাদের নিয়ে ১৯২৯ সালের ৮ ডিসেম্বর, সন্ধ্যায় ঢাকার নবাব বাড়িতে বিচারসভা বসে। সম্পাদক-লেখক হিসেবে অভিযুক্ত হন আবুল হুসেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ধর্মাবমাননার। তাকে নিয়ে আসা হয়েছে হুমকির মুখে। আহসান মঞ্জিলে উপস্থিত না হলে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সম্ভাব্য মৃত্যুর আশঙ্কায় পরিবার থেকে বিদায় নিয়েই উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি।

সেকালে নবাব পরিবার ও মুসলিম আলেমদের প্রায় সবাই ছিলেন উর্দুভাষী। সবার সুবিধার্থে আবুল হুসেনের লেখা ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রবন্ধটি উর্দুতে অনুবাদ করে সভায় পড়ে শোনানো হয়। উর্দুতেই আবুল হুসেনের সঙ্গে চলেছিল তাদের প্রশ্নোত্তর পর্ব।

নবাব হাবিবুল্লাহ ঘোষণা দিলেন, ‘আপনি জীবনে আর কখনো কিছু লিখবেন না— এই শর্তে মুচলেকা লিখে দেন, তবেই আপনার দণ্ড শিথিল হতে পারে বা আপনাকে ক্ষমা করা যেতে পারে।’

উত্তরে আবুল হুসেন বলেন, ‘আমি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কিছু লিখব না, কিন্তু, অন্যান্য বিষয়ে লিখব- এই শর্তে আমাকে মুক্তি দেওয়া হোক।’ শেষ পর্যন্ত তারা ক্ষমাপত্র লিখে দেওয়ার বিপরীতে আবুল হুসেনকে মুক্তি দিতে রাজি হন।

এর পরদিন, তথা ৯ ডিসেম্বর তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’র সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন। তারপর ওদুদসহ একে একে সবাই চলে যান। বন্ধ হয়ে যায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’।

‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন তথা ওদুদের উদার মানবতাবাদী সংস্কার প্রচেষ্টা স্বসম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অন্যদিকে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছেও তিনি বিরাগের সম্মুখীন হয়েছিলেন। অথচ আমৃত্যু চেষ্টা করেছেন হিন্দু-মুসলমান বিরোধ মীমাংসার।

দেশ বিভাগের পর ভারত ও পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল তাকে আপনজন বলে গ্রহণের ক্ষেত্রেও দ্বিধান্বিত ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আত্মীয়স্বজন ও অনুরাগীদের অনুরোধে তিনি জন্মভূমিতে ফিরে আসেননি মূলত আদর্শগত ও রাজনৈতিক কারণে।

ইতিহাস বলে দেশ-রাষ্ট্র ভিন্ন হলেও শাসকের/ক্ষমতার রক্তচক্ষু একই। চরিত্র আলাদা কিন্তু, দৃশ্যমান অপব্যবহার একই। তৎকালীন গ্রিস জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হলেও শাসন ক্ষমতায় আসীন অভিজাত শ্রেণি সক্রেটিসের নিখুঁত যুক্তির কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। যুবকরা শাসকের অবাধ্য হচ্ছিল। সক্রেটিসের উদারতা-সততা শাসকরা মেনে নিতে পারেনি। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়— আদালতের চাপে একদিন গ্যালিলিওকেও স্বীকার করতে হয়েছিল, পৃথিবী স্থির। সেদিন গ্যালিলিও বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘তবুও পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে।’ প্রকৃত জ্ঞানীর জায়গা সবাই দিতে পারে না।

প্রাবন্ধিক মিলন দত্ত মনে করেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক জানা-বোঝা বাড়লে অবস্থার আরও একটু উন্নতি হতে পারে, এমনই মনে করতেন ওদুদ। সেই জানা-বোঝার অভাব এখনও অনেকটাই একই রকম রয়ে গিয়েছে। বাংলায় হিন্দু-মুসলমান চর্চার ক্ষেত্রে এখন কাজী আবদুল ওদুদ তাই আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। মুসলমান সমাজে একটা নবজাগরণের স্বপ্ন দেখতেন ওদুদ। ঈশ্বরের নামে প্রচারিত যে সব বিধি-বিধান জীবনে উন্নতির প্রতিবন্ধক, সেগুলো বর্জন করাই কাম্য মনে করতেন তিনি। অন্যদিকে, ধর্মপ্রাণ ওদুদ কোরান অনুবাদ করেছেন, লিখেছেন হজরত মুহাম্মদের জীবনী। আর গবেষক মাত্র স্বীকার করতে বাধ্য শিখা পত্রিকাটি স্বল্পস্থায়ী হলেও বাংলার সারস্বত সমাজে তা সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

মুসলমান সমাজ তথা পিছিয়ে পড়া সমাজ নিয়ে কাজ করেছেন, ভেবেছেন আমৃত্যু এমন উদারপন্থী বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, এস. ওয়াজেদ আলি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, এয়াকুব আলী চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ ও আবদুল কাদির। সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তা সংকটে তারা হয়েছেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রাসঙ্গিক হতে পারে সম্প্রদায়ের সেতুবন্ধনে তাদের জীবন ও কর্ম।

তথ্যসহায়ক

১. আত্মকথা/ আবুল মনসুর আহমদ

২. নির্বাচিত প্রবন্ধ/ কাজী আবদুল ওদুদ

৩. শিখা সমগ্র/ মোস্তফা নুরউল ইসলাম

৪. নির্বাচিত প্রবন্ধ /সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

৫. সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্প-ভাবনা/ মজিদ মাহমুদ

৬. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান/ মোশাররফ হোসেন খান

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Election Commission

EC seeks action against addl DIG for collecting brother’s nomination

The Election Commission has directed the home ministry to take action against Additional Deputy Inspector General of Police Md Moniruzzaman for participating in election activities on behalf of his younger brother

50m ago