‘গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ আছে কলেজশিক্ষার্থীর ডায়েরিতে’

সায়েম সোবহান আনভীর। ছবি: সংগৃহীত

বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা’ দেওয়ার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলা আদালতে প্রতিষ্ঠিত করতে ইতোমধ্যে বেশ কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। আলামত হিসেবে জব্দ করা মৃত কলেজশিক্ষার্থীর লিখে যাওয়া ছয়টি ডায়েরি অভিযোগ প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে মনে করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষার্থীর যে ডায়েরিগুলো আমরা উদ্ধার করেছি, সেগুলোতে তার চরম হতাশা ও মানসিক বিপর্যস্ততা ফুটে উঠেছে। তার এই লেখা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হবে।’

ওই শিক্ষার্থীর বড় বোন জানিয়েছেন, অপরিচিত লোকজন তাকে কল করে আনভীরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলছেন। তা না হলে তার পরিণতিও তার বোনের মতোই হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন তারা। গত মঙ্গলবার শিক্ষার্থীর বড় বোন গুলশান থানায় বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় ওই মামলা দায়ের করেন।

গতকাল এই মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করেছেন বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। তবে, আগাম জামিন চেয়ে করা কোনো আবেদনের ওপর শুনানি করবে না বলে আজ বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন আদালত।

সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘... শিক্ষার্থী তার ডায়েরিতে তাদের সম্পর্ক, সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতিতে বাধা, অভিযুক্তের সঙ্গে তার সুখী দাম্পত্য জীবনের প্রত্যাশা এবং অভিযুক্তের পরিবারের বাধার কথা লিখেছেন।’

কলেজশিক্ষার্থী ডায়েরিতে তার গুরুতর হতাশার বর্ণনা দিয়েছেন এবং এগুলো মামলাটি প্রতিষ্ঠিত করতে কাজে লাগবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পুলিশ ওই ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ, শিক্ষার্থীর ফোনে থাকা তথ্য এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছে।

উপকমিশনার বলেন, ‘এসব প্রমাণ যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করার পর আমরা তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাত্রা যোগ করতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশ দ্রুত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। এটা মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে পারে। এ ছাড়া কর্মকর্তারা ডিএনএ ও ফরেনসিক পরীক্ষার ফলাফলের জন্যেও অপেক্ষা করছেন। আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় মামলাটি প্রমাণের জন্য সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ লাগবে আমাদের।’

সুদীপ চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সব প্রমাণ পাওয়ার পর পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে ভাববে। আমরা সবাই শিক্ষার্থীকে সুবিচার পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এই তদন্তে পুলিশের ওপর কোনো চাপ নেই।’

এ বিষয়ে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান তার ধানমন্ডির বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘অপরাধ যে-ই করুক, তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাব।’

এর আগে পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে ঢাকার একটি আদালত আনভীরের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

গত সোমবার রাতে গুলশানের একটা ভাড়া বাসা থেকে ওই কলেজশিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন তার বোন ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা’র অভিযোগ এনে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার বাদীর দেওয়া তথ্য অনুসারে, আনভীর ২১ বছর বয়সী ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং তাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়েছিলেন।

ভবনের নিরাপত্তা কর্মীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, ফ্ল্যাটটিতে ওই শিক্ষার্থী একাই থাকতেন। অভিযুক্ত মাঝেমধ্যে সেখানে যেতেন।

মামলার বাদী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গত ২৫ এপ্রিল তার বোন তাকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আনভীর তাকে বিয়ে করবেন না। তিনি খুব বিপদে আছেন এবং যেকোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

শিক্ষার্থীর বড় বোন জানান, পরদিন কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর তিনি বোনের মরদেহ সিলিং ফ্যানে ঝুলে থাকতে দেখেন।

তিনি বলেন, ‘নিজে যা দেখেছি এবং আমার বোন আমাকে যা বলেছে, তার ওপর ভিত্তি করে আমি আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করেছি। এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যার প্ররোচনা—তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ তদন্তের পর বলতে পারবে।’

এজাহারে মামলার বাদী বলেছেন, ২০১৯ সালে আনভীর ওই কলেজশিক্ষার্থীকে রাজধানীর বনানীর একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে নিয়ে যান এবং সেখানে তারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। গত বছর আনভীরের পরিবার তাদের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে পারে। এরপর আনভীরের মা ওই শিক্ষার্থীকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেন। তা না হলে তাকে ভয়াবহ ফল ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দেন তিনি।

হুমকি-ধামকি

শিক্ষার্থীর বড় বোন ও মামলার বাদী ডেইলি স্টারকে গতকাল জানান, মঙ্গলবার রাত থেকে তাকে অনেকগুলো অপিরিচিত নম্বর থেকে কল করা হচ্ছে। এর মধ্যে কোনো কোনো নম্বর থেকে বলা হচ্ছে, মামলা তুলে না নিলে বাদীর পরিণতিও তার বোনের মতো হবে।

যেসব নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে দুটি নম্বর তিনি ডেইলি স্টারকে দেন। এ নম্বরগুলোতে গতকাল কয়েক দফায় কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে।

বাদী জানিয়েছেন, কল করে ওইপাশ থেকে তাকে গালিগালাজ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যে তিনি বসুন্ধরার এমডির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। বিষয়টি তিনি কুমিল্লা থানাকে জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর ছেলে শারুন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তার সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর কথোপকথনের যে স্ক্রিনশট সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, তা ভুয়া।

মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘এটা ভুয়া স্ক্রিনশট। কথোপকথনটিতে কোনো তারিখ নেই। আমি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এই স্ক্রিনশটের ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখতে বলেছি। আমার কখনোই তার সঙ্গে (শিক্ষার্থী) দেখা বা কথা হয়নি।’

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

শারুন চৌধুরী বলেন, ‘আনভীরের আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত ঝামেলা আছে... এজন্য বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ ভুয়া স্ক্রিনশট ছড়াচ্ছে। আমি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ বিষয়ে সঠিক তদন্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

প্রতিবাদ

ঘটনাটি আত্মহত্যা নাকি হত্যা, সে বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে গতকাল ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানে’র কেন্দ্রীয় কমিটি বিবৃতি দিয়েছে।

সংগঠনের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল শাহিনের সই করা ওই বিবৃতিতে ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও দোষীর শাস্তি দাবি করা হয়।

আরও পড়ুন:

বসুন্ধরা এমডির আগাম জামিন শুনানি হচ্ছে না

আগাম জামিন আবেদন করলেন সায়েম সোবহান আনভীর

বসুন্ধরার এমডির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

গুলশানে ফ্ল্যাট থেকে কলেজ শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার

Comments

The Daily Star  | English

Produce 10 ex-ministers, 2 advisers to Hasina before tribunal on Nov 18: ICT

They will be shown arrested in case filed over crimes against humanity, genocide, says prosecutor

23m ago