তথ্য ভাণ্ডারের অভাবে করোনায় আর্থিক সহায়তা দিতে চ্যালেঞ্জে সরকার

সমন্বিত তথ্য ভাণ্ডার না থাকায় চলমান করোনাভাইরাস মহামারিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহযোগিতা দিতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সরকার।

দেশের সব নাগরিকের সাধারণ তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগীয় কমিটি গত বছর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটা প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবে একটি বিশেষায়িত কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়। কর্তৃপক্ষ জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজটি করবে।

চার মাসের বেশি সময় ধরে প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পড়ে আছে।

ওই কমিটির প্রধান ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সুলতান আহমেদ সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমরা এখন পর্যন্ত কোনও সাড়া পাইনি।’

তিনি জানান, ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (সিআরভিএস) অব দ্য ক্যাবিনেট ডিভিশন’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য একটা প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনার উদ্দেশ্যে তারা এ প্রস্তাব রেখেছিলেন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর জাতীয় পরিচয়পত্রসহ এ সংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় আসা উচিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটা প্রস্তাব পাঠায়। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মন্তব্য জানিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সুলতান আহমেদকে প্রধান করে এ বিষয়ে সাত সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়।

বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) প্রকল্পের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় অনেকগুলো ইলেক্ট্রনিক তথ্যভাণ্ডার তৈরি করলেও, সেগুলো চাইলেও সরকারের অন্য কোনো মন্ত্রণালয় কিংবা সংস্থা ব্যবহার করতে পারে না।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবনা তৈরির ক্ষেত্রে তারা একটি ‘সমন্বিত তথ্য ভাণ্ডার’ এর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন। যেখানে সব নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যসহ জন্ম ও মৃত্যু সনদ, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত কাজের তথ্যের পাশাপাশি সব ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্য থাকবে। একবার তথ্যভাণ্ডারটি তৈরি হওয়ার পর এক জায়গা থেকেই বিভিন্ন সংস্থা প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো নিতে পারবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন একটি তথ্যভাণ্ডার থাকলে সরকারের জন্য মহামারির সময়ে দরিদ্র মানুষের কাছে আর্থিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার কাজটিও সহজ হতো।

যেমন, গত বছরের মে মাসে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতার বাইরের ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষের প্রত্যেককে আড়াই হাজার টাকা নগদ প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সুবিধাভোগীদের আওতায় ছিল রিকশাচালক, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষক, দোকান কর্মচারী, ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, পোল্ট্রি ও পরিবহন শ্রমিক।

কিন্তু উপকারভোগীদের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় মাঝপথেই টাকা বিতরণের কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। তালিকায় অনেক সামর্থ্যবানের নামও এসেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল।

এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ ওই তালিকায় থাকা ১৫ লাখ মানুষের হাতে প্রণোদনার অর্থ হস্তান্তর করেনি। কারণ তালিকায় থাকা অনেকে আগেই বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। আবার অনেকে প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার জন্য যে তথ্য দিয়েছিলেন তা জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা তথ্যের সঙ্গে মেলেনি।

সমন্বয়হীন তথ্যভাণ্ডার

বাংলাদেশে সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (সিআরভিএস) ওয়েসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা বেশকিছু ইলেক্ট্রনিক তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছে। যেমন, নির্বাচন কমিশনের তৈরি এনআইডি তথ্যভাণ্ডারে ১৮ বছরের উপরে ১০ কোটি মানুষের তথ্য আছে। আবার স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে ১০ কোটি ২০ লাখ লোকের তথ্য আছে।

এদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়মিত ১০ কোটি মানুষের ওপর স্বাস্থ্য শুমারি পরিচালনা করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দরিদ্রতার তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজ দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সবগুলো তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে। যা চাইলে অন্য সংস্থাগুলো ব্যবহার করতে পারে না। তাছাড়া, ওই সব তথ্যভাণ্ডারে একই মানুষের নাম একাধিকবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিনা তাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

কর্মকর্তারা আরও বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসতে পারেন এমন অনেকের নাম ওই সব তথ্যভাণ্ডারে নেই। তারা ভিজিডি প্রকল্প, বিধবা ভাতা কিংবা প্রতিবন্ধী ভাতার মতো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘খারাপ সময়ে সত্যিকারের সুবিধাভোগীদের সহযোগিতা করতে হলেও একটা সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার দরকার।’

অতিরিক্ত সচিব সুলতান আহমেদ বলেন, ‘গণমাধ্যম অনেক সময় যথাযথ তথ্য-উপাত্তের অভাব ও সরকারি তহবিল অপব্যবহারের বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। এর কিছু সত্য, কিছু সত্য না। যদি এর জন্য পৃথক একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়, তাহলে এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে।’

প্রয়োজন সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেনের মতে, যদি নাগরিকদের জন্য একটি সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার থাকে, তাহলে সরকারি তহবিলের অপব্যবহার রোধ করা সহজ হবে।

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর জন্য সুবিধাভোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ছাড়াও, সরকার ৫০ লাখ দরিদ্রকে প্রণোদনার অর্থ দিতে চাইলেও কিছু জটিলতা ধরা পড়ে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া বিআইডিএসের ‘পোভার্টি ইন দ্য টাইম অব করোনা: ট্রেন্ডস, ড্রাইভারস, ভালনারেবিলিটি অ্যান্ড পলিসি: রেসপন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নেওয়া অনেক প্রকল্পের অর্থ অপব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে। যা শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাজে লাগেনি।

বিনায়ক সেন মনে করেন, কেবল ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থ প্রদান করলেই এই অপব্যবহারের সমস্যা সমাধান হবে না।

তালিকায় এখনো অনেক ভুয়া সুবিধাভোগী আছে। কিন্তু, যথাযথ তথ্যের অভাবে তাদের চিহ্নিত করা কিংবা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব না উল্লেখ করে বিনায়ক সেন বলেন, ‘সুতরাং এমন অপব্যবহার চলতে থাকবে।’

এই অর্থনীতিবিদের পরামর্শ, এ ধরনের সমস্যা সমাধানে সরকার ভারতের আধার কার্ডের মতো কর্মসূচি চালু করতে পারে। এতে করে তালিকা থেকে ভুয়া সুবিধাভোগীদেরও বাদ দেয়া যাবে।

বিনায়ক সেন বলেন, আধার কার্ডের জন্য তৈরি তথ্যভাণ্ডারে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব, মুঠোফোন নাম্বার এমনকি সে এ পর্যন্ত কোনও কর্মসূচির আওতায় সুবিধা পেয়ে থাকলে তার তথ্যও থাকবে।

আধার হচ্ছে ১২ অঙ্কের পরিচয় শনাক্তকারী একটি অনন্য নম্বর। ভারতের সব অধিবাসীকে তাদের বায়োমেট্রিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিনামূল্যে জাতীয়ভাবে এই নম্বর দেওয়া হয়।

ভারতীয় নাগরিকরা যেন যুক্তিসঙ্গত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সুবিধা ও ভর্তুকি পেতে পারেন তার জন্য প্রাথমিকভাবে এই কার্ডটি চালু করা হয়েছিল। তবে, এখন তা অর্থ ও কর পরিশোধ থেকে শুরু করে আরও অনেক কাজে লাগছে। সব ভারতীয় নাগরিকের জন্য কার্ডটি বর্তমানে একটা প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

8h ago